রাজনৈতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করা যায়। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে এক শ্রেণীর মানুষ সহজাতভাবে এমনিতেই দাঁড়িয়ে যায়। তাই এ ধরণের সন্ত্রাস খুব দীর্ঘমেয়দি হয়ে গেলে গণআন্দোলন অবধারিত। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, সাক্ষ্য দিচ্ছে ঋজু হয়ে। কিন্তু যে সন্ত্রাস নিরীহ ভঙ্গিমায় শুরু করে ফালাফালা করে দেয় দেশ আর সমাজ তা হলো তথ্য সন্ত্রাস।
আমাদের নিকট অতীত বলছে তথ্য সন্ত্রাসে সারা দেশ বিপর্যস্ত হয়েছিল মাহমুদুর রহমানের আমাদের দেশ পত্রিকার মাধ্যমে। শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলন যখন জামায়াত-শিবিরকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল, যখন তারা বাংলাদেশে অচ্ছুৎ এবং বিপন্ন হয়ে যাচ্ছিল তখন সবচেয়ে বড় আঘাত হানে আমার দেশ পত্রিকা। শাহবাগে ফ্যাসিবাদে পদধ্বনি শিরোনামে একটা ব্যানার হেড করেছিল ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে। এরপর একে একে অংশগ্রহণকারিদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে সারা দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উস্কানি দিয়েছিল। নড়বড়ে ভীতসম্পন্ন ধর্মান্ধরা ভেবেছিল এই বুঝি তাদের পূর্বপুরুষী ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে!
সৃষ্টিকর্তা সর্বেসর্বা বিশ্বাসে যারা ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল একদিন তাদের কাছে মুহুর্তেই ধর্মের অবতার হয়ে ওঠে মাহমুদুর রহমান আর আমার দেশ পত্রিকা। সে সময়ে আমার দেশ পত্রিকা যেভাবে তাদের নয়নের মনি হয়ে ওঠেছিল মনে হয় সেরকম ভাবে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকেও ভাবেনি। আমি আমার এই জীবনে কোন লোককে তার ধর্মগ্রন্থ পড়বার নেশায় এতটুকু দেখিনি যেটুকু দেখেছিলাম আমার দেশ পত্রিকা নিয়ে। আমি দেখিনি কোথাও ধর্মগ্রন্থ পড়তে প্রয়োজনে ফটোকপির আশ্রয় নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমার দেশ পত্রিকা উচ্চমূল্য ফটোকপিও করে বিক্রি হয়েছিল। ধর্মের নাম নিয়ে এভাবে বিশ্বাস আর আকর্ষণের এই বেচাকেনাতে কত লোক যে নিজের অলক্ষ্যে ধর্মচ্যুত হয়েছে সে হিসাব কে দেবে; কে নেবে?
আমার দেশ পত্রিকা ধর্ম নিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিল। বক ধার্মিকেরা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই সুড়সুড়ি অবশ্য শুরু করেছিল ইনকিলাব নামক পত্রিকাই। রাজাকার মাওলানা মান্নানের পত্রিকা ইনকিলাব সব সময়েই বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতার সাথে সংশ্লিষ্ট। শাহবাগ আন্দোলনের শুরু থেকেই তারা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল আমার দেশ পত্রিকার সাথে। একই বলয়ের অন্যান্য পত্রিকা নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম একইভাবে একই কাজ করে আসছিল। দুঃখজনকভাবে সত্য যে দীর্ঘদিন ধরে এই পত্রিকাগুলোর তথ্যসন্ত্রাসকে সহ্য করা হচ্ছে। ফলে এক আমার দেশ পত্রিকা অনেক দেরিতে বন্ধ হলেও অন্যান্য পত্রিকাগুলো থেকে গেছে বহাল তবিয়তে এবং তারা তাদের স্বভাব কাজগুলো করেই যাচ্ছে।
আমরা অনেক আগেই দাবি জানিয়েছিলাম মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার এবং আমার দেশ পত্রিকা নিষিদ্ধের। কিন্তু সরকার সময়মত কোন উদ্যোগ নেয়নি। আমার দেশ পত্রিকা প্রিন্ট সংস্করণ অবশ্য বন্ধ হয়েছে কিন্তু মুল ক্ষতিটা করে গেছে তার আগেই। আমার দেশ পত্রিকার রেখে যাওয়া অধ্যায়টুকু এখন সম্পাদনের দায়িত্ব নিয়েছে ইনকিলাব, নয়া দিগন্ত ও সংগ্রাম। তারা একইভাবে মিথ্যাচারের মাধ্যমে তথ্য সন্ত্রাস করছে এবং ধর্মান্ধতাকে উস্কে দিয়ে যাচ্ছে নিয়ত।
নিকট অতীতের কথা স্মরণ করলে দেখা যায়, যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের রায় আসার পর থেকে সারাদেশে জামায়াত-শিবির চরম নাশকতা সম্পাদন করে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তার মধ্যে এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে তারা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। সাতক্ষীরা, বগুড়া, রাউজানসহ জামায়াত-শিবির কবলিত এলাকায় জামায়াত-শিবির সর্বেসর্বা। সরকারি দল আওয়ামীলীগের স্থানীয় নেতৃত্ব মুচলেকা দিয়ে চলাফেরা করে বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ। দেরিতে হলেও ‘মিনি পাকিস্তান’ সাতক্ষীরায় কিছু দিন আগে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। সে অভিযান নিয়ে মিডিয়ায় অনেক অপপ্রচার হয়েছে। অপপ্রচার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে রাজাকার মাওলানা মান্নানের ইনকিলাব পত্রিকা যৌথবাহিনীর অভিযানে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা’ এরকম মিথাচারভিত্তিক এবং উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচার করে তথ্যসন্ত্রাস করেছিল। অনলাইনে জামায়াত-শিবিরবান্ধব বেশ কিছু লোক একে ভারতবিরোধী ফ্লেভার দিতেও চেয়েছিল। ইনকিলাব পত্রিকার মিথ্যাচার ও উস্কানির কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পর অনলাইনে দুঃখপ্রকাশ করে সে সংবাদ প্রত্যাহার করেছিল। সংবাদ প্রত্যাহার আর দুঃখপ্রকাশের আগেই প্রকৃতপক্ষে অপপ্রচারটি সব মহলে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ফলে এটা ধারণা করা যায়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে সংবাদটি প্রচার হয়েছিল সেটা সফল হয়েছে। তাই ছোট্ট করে দুঃখপ্রকাশের চাইতে পুর্বের মিথ্যাচারের শক্তি ছিল অনেক বেশি। এই তথ্যসন্ত্রাসের ফলে যে ক্ষতি সম্পাদিত হয়েছিল সেটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব না, হয় নি এবং হবেও না। যার ফল ঘরে তুলেছে জামায়াত- শিবির।
সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য সন্ত্রাসের মূল কারিগর যদি হয় আমার দেশ পত্রিকা তবে তার সবচেয়ে নিকটতম স্থানে নিশ্চয়ই ইনকিলাব, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ ও মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে অনেক দেরিতে অনেক জল ঘোলা করেই। সাতক্ষীরার ঘটনায় ইনকিলাবের অফিস সিলগালা করে দেয়াটা ইতিবাচক একটা উদ্যোগ হলেও মনে করি এই উদ্যোগও নেয়া হয়েছে অনেক দেরি করেই। মনে রাখতে হবে এই ইনকিলাব পত্রিকা আমার দেশ পত্রিকার সাথে রীতিমত প্রতিযোগিতা করেই তথ্য সন্ত্রাস করেছে।
আমার দেশ, ইনকিলাব, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম এই প্রিন্ট মিডিয়াগুলোই কেবল তথ্য সন্ত্রাসের সাথে জড়িত তা নয়। এর সাথে আছে কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন পোর্টাল। আমার দেশ আর ইনকিলাবের পর এদিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত। অতি সুশীল যারা তাদের অনেকেই ভুরু-নাক কুঁচকে বলবে তাহলে দেশে তথ্য অধিকারের থাকলো কী? বিনয়ের সাথে তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই অধিকার যখন সন্ত্রাসের পর্যায়ে চলে যায় তখন সেটাকে আর সাংবিধানিক অধিকারের পরিধির মধ্যে রাখা যায় না; রাখা উচিতও না!
তথ্যসন্ত্রাস অনেক পুরনো এবং চলমান রোগ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে ভীতিকর রোগের নাম হচ্ছে ৫৭ ধারা আইন। আইনের ভাষায় যার নাম দেখা হয়েছে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ (১) ধারা [তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০১৩] । এই আইনের কারণে শুধু ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে এই অভিযোগে যে কাউকে কোনরূপ গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া পুলিস গ্রেফতার করতে পারে এবং গ্রেফতার পরবর্তি সময়ে জামিনের বিধানও সীমিত রাখা হয়েছে। ফলে এই আইনের অপপ্রয়োগের শতভাগ সম্ভাবনা রয়েছে। এই আইনে মানুষজন অভিযোগ দিতে পারে, পুলিস অভিযোগ নিতে পারে এবং গ্রেফতারের ক্ষমতাও পুলিশের হাতে। অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার এবং এরপর কোন ধরণের শুনানি ছাড়াই জেলে পুরে রাখার সম্ভাবনার বিপরিতে মানবাধিকার কিংবা আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এই অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে- ‘কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানী প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ’। আইনের এই ধারায় যে কোন ধরণের অপপ্রচারের ইঙ্গিত দেওয়া হলেও মুল আইনে কোথাও এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। ফলে পুরো ধারাতে ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়ের ধারণা দেওয়া হয়েছে বলে প্রকাশ। এবং আমরা ঘৃণাভরে লক্ষ্য করছি যে এ পর্যন্ত যতবার এই ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে তা ধর্ম সম্পর্কে কাল্পনিক ধারণাপ্রসূত। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দিন দিন এই মাত্রা বাড়বে বৈ কমবে না!
ব্লাসফেমি মানে হচ্ছে ধর্ম অবমাননা, ধর্ম নিন্দা কিংবা ঈশ্বরের অবমাননা। সাধারণ অর্থে ব্লাসফেমি বলতে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনকে বুঝানো হয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে এই আইনটি পৃথিবীর কয়েকটি মুসলিম দেশ যেমন- আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, মালয়েশিয়াতে প্রচলিত থাকলেও এই আইনের গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগে যখন প্রাচীন রাজা বাদশাদের বলা হতো ঈশ্বরের একমাত্র প্রতিনিধি। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ছিল ঈশ্বরের বিরোধিতা। তাই ঈশ্বরবিরোধী তথা রাজা-বাদশাহ বিরোধী কোন জনমত যাতে মাথাচাড়া না দিয়ে ওঠে সে জন্যে এই কালাকানুনের প্রবর্তন হয়।
বাংলাদেশে কী এই আইন আছে? খুব সাটামাটাভাবে যদি উত্তর দেওয়া হয় তবে উত্তর হবে- বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইন নেই। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে এই আইন আছে অন্য মোড়কে। যার নাম- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬। সর্বশেষ সংশোধন হয় ২০১৩ সালে। আইসিটি আইনটি প্রথম প্রচলন করা হয় ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর। তারপর ২০০৯ সালে আইনের ১৮ ধারায় সংশোধনী আনা হয়। ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই আইনের বেশ কিছু ধারায় সংশোধনী আনা হয়। শুরু থেকেই এই আইনের ৫৭ ধারা বাক স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হয়ে আছে। অনেকের আশঙ্কা আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ‘ব্লাসফেমি’ আইনের বাংলাদেশি সংস্করণ। আইসিটি আইনের সর্বশেষ সংশোধনের জন্যে সংসদের কাছে যায় নি সরকার, রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই আইনের সংশোধনী গৃহিত হয়েছে। যা সংসদকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটা খারাপ উদাহরণ।
হ্যাঁ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রয়েছে অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারী করার যদি একই সময়ে সংসদ অধিবেশনের কোন ধরণের সুযোগ না থাকে। রাষ্ট্রপতিকে এই ক্ষমা দিয়েছে বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩(১) ধারা। যেখানে বলা হয়েছে- 'সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যেরূপ প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারী করিতে পারিবেন এবং জারী হইবার সময় হইতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে।' রাষ্ট্রপতি যখন এই অধ্যাদেশ জারি করলেন তার ঠিক একদিন আগে ১৯ আগস্ট ২০১৩ তার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে পরবর্তি সংসদ অধিবেশ আহ্বান করলেন। এই আইন সংশোধনে সরকার ইচ্ছেকৃতভাবে অনেক লুকোছাপা করেছে এবং সেটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই। এই অন্যায় আইন জারির বিষয়টিকে কেউ হয়তো অবৈধ বলতে পারবে না তবে প্রণয়নের সময় তাড়াহুড়ো প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখলে নীতি-নৈতিকতা প্রশ্নে কেউ যদি ন্যায্যতা নিয়ে কথা বলে তাহলে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বলে ধর্মকে সুরক্ষিত করা হয়েছে বলে অনেকেই যৌক্তিকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে থাকে। তাদের মতে, অনলাইনে ক্রমবর্ধমান ধর্মবিরোধী প্রচারের বিপরিতে এটা কার্যকর পদক্ষেপ। ধর্মকে সুরক্ষা করতে হবে আইন দিয়ে এটা ধর্মের সবচেয়ে বড় অবমাননা যেহেতু পৃথিবীতে কেউ বর্তমান নেই যিনি ধর্মের একচেটিয়া ঠিকাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং অথবা স্বীকৃতি পেয়েছেন। একটা রাষ্ট্র যখন ধর্মকে সুরক্ষা করতে আইন প্রণয়নের মত বালখিল্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন তখন সে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে না থাকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কেউ, না থাকে ধর্মের প্রতি সত্যিকার অর্থে বিশ্বাসী কেউ। আমাদের অশেষ লজ্জা যে একবিংশ শতকের বিশ্বের কিছু দেশ নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় অবস্থায় ফিরে যেতে চায় যেখানে ছিল রাজা-বাদশাহ মানে ঈশ্বর কিংবা স্রষ্টার প্রতিনিধি। এটা যে আদতে মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা এবং বিশ্বাসের দীনতা তা বলার অপেক্ষা রাখে না।বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইন নেই কিন্তু তদ্রূপ অনলাইনের আইন যার ৫৭ ধারা একই অর্থে ব্লাসফেমিকে নির্দেশ করে।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে আছে-“Subject to any reasonable restrictions imposed by law in the interests of the security of the State, friendly relations with foreign relations with foreign states, public order, decency or morality, or in relation to contempt of court, defamation or incitement to an offence- (a) the right of every citizen to freedom of speech and expression যার অর্থ দাঁড়ায়-“রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানী বা অপরাধ, সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে-(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার’। এই আইন সংবিধানের উল্লেখিত ধারাকে লঙ্ঘন করেছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সংক্ষুব্ধ পক্ষ দাবিদার কেউ যে কারো বিপক্ষে এই আইনের অধীনে মামলা করতে পারে এবং এই ধারা জামিনঅযোগ্য। ফলে বিচারের আগে অভিযুক্ত ব্যক্তি/গোষ্ঠী নিগৃহিত হবেন আইন-আদালতের মাধ্যমে। আইসিটি আইনের ৫৭(১) লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অনধিক দশ বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। এই সাজা ততখানি কঠোর ততখানি হালকা তার অভিযোগ।
১৯৪৮ সালে গৃহীত Universal Declaration of Human Rights এর আর্টিকেল ১৯ এ রয়েছে-Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers. এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও বাক এবং ব্যক্তির স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অনুরূপভাবে International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) এর আর্টিকেল ১৯ ও কথাবলার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। "the right to hold opinions without interference. Everyone shall have the right to freedom of expression". কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আমাদের মহান সংবিধানকে অমান্য করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রকেও লঙ্ঘন করছে।
প্রশ্ন জাগে, অনলাইনে ধর্মের সুরক্ষা নামে কালো আইন করে আমরা কী ব্লাসফেমির মতো মধ্যযুগীয় আইনের ধারায় নিপতিত হচ্ছি? যদি তাই হয়ে থাকে তবে সেটা আমাদের জন্যে চরমভাবে হতাশার। আমরা ঘৃণাভরে এই কৌশলকে প্রত্যাখ্যান করি এবং একই সাথে বিতর্কিত ৫৭ ধারার আদলে করা অনলাইন ব্লাসফেমি আইনের বাতিলের দাবি জানাই।
তথ্য সন্ত্রাস এবং কালো আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায়। এটা সচরাচর ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে হয়ে থাকে নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার এই অপচেষ্টা তারা করে থাকে যখন শাসক চরমভাবে নিজেদের ব্যর্থ মনে করে। এখানে মনে রাখা দরকার, কোন রাষ্ট্র তার জন্মাবস্থা থেকে ব্যর্থ থাকে না; সরকারের ব্যর্থতায় এক সময় রাষ্ট্রও ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ব্যর্থ রাজা-বাদশাহরা তাদের ব্যর্থতাগুলো ঢাকতে ব্লাসফেমির মতো কালাকানুন করেছে, বর্তমান বিশ্বে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে এই আইন আছে এবং অন্য মোড়কে কিছু রাষ্ট্র সেগুলো তার নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টার মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন আইন করে যাচ্ছে। আমরা মনে করছি, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা তেমনই এক আইন; যা সরাসরিভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক!
তথ্য সন্ত্রাস এবং বাক স্বাধীনতাহীনতা একটা সমাজ, একটা রাষ্ট্রকে ক্রমে ধ্বংসের অতলে নিপতিত করে। আমাদের দেশে ব্লাসফেমির মত কালাকানুন না থাকলেও ধর্মকে উপজীব্য করে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ব্লাসফেমির মতো আইনকে আবারও সামনে নিয়ে আসে। তাই সংবিধানের প্রতি সম্মান রেখে অবিলম্বে ৫৭ ধারা বাতিল করা উচিত। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কোন ধর্মরাষ্ট্র নয়, ধর্মকে ভিত্তি করে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি।
বাক স্বাধীনতা নাগরিকের প্রধানতম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা যেমন না ঠিক তেমনিভাবে না কণ্ঠরোধের অপচেষ্টা। কারো কোন কথায় কোথাও, কোনোদিন কারো ধর্ম ধ্বংস হয়ে যায়নি, যাচ্ছে না এবং যাবেও না। কিন্তু একে উপলক্ষ করে উগ্র ধর্মান্ধরা চিরদিন ঘোলা জলে মাছ শিকার করেছে। কিছু রাষ্ট্র তাদেরকে সহযোগিতা করেছে। ধর্মরাষ্ট্র এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র যদি করে করুক তবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কেন করবে?
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এবং নাগরিকের বাক স্বাধীনতার মতো সাংবিধানিক অধিকারকে রক্ষা করতে অবিলম্বে কালাকানুন ৫৭ ধারা বাতিল করতে হবে; এ ছাড়া বিকল্প নাই।
█ █ █ ব্লগার/ফেসবুকার রাহী-উল্লাসের মুক্তি চাই █ █ █
█ █ █ █ কালো আইন ৫৭ ধারা বাতিল চাই █ █ █ █