বাবা নাইজেরিয়া থেকে আমাদের নিয়ে দেশে ফিরতে ফিরতে ফেব্রুয়ারি মাস এসে গেছিল, চারদিকে একটা বসন্ত বসন্ত ভাব। এর মধ্যেই স্কুলে ভর্তি হতে গেলাম আমরা তিন ভাই বোন। ভাইয়া আপুর যেহেতু এক বছর লস হয়ে যায় তাই নতুন ক্লাসে উঠতে হলে পরীক্ষাতে বসতে হবে......... কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং ‘এক দুই তিন’ আর ‘অ আ ক খ’ লিখে আমারো জীবনের প্রথম পরীক্ষা দিতে হলও যদিও পরীক্ষা ব্যপারটা তখনও বুঝেই আসে নি। হেড স্যর বাবাকে বললেন আপনার ছেলের হাতের লেখার অবস্থা ত করুন। সে হাতের লেখা এখনও বড়ই করুন, তার সাথে সাথে অনেক কিছুই করুন লিখতে গেলে বিশাল ফিরিস্তি হয়ে যাবে। পরদিন বাবা হাত ধরে নিয়ে ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে এলেন তা বেশ মনে পড়ে, ভাইয়া আপুরা ডে শিফটে তাই বাবাই নিয়ে এসেছিলেন। সারা ক্লাসে পরিচিত বলতে একজন সে আমাদের ছোট বেলার পাশের বাড়ির সুমি। স্যার এলেন, ড্রয়িং ক্লাস নেন তাই স্যারের নাম ড্রয়িং স্যার। আমার আগে পচানব্বই জন ছাত্র ছাত্রী আর আমি ছিয়ানব্বইতম। প্রথম পিরিয়ডে আমাদের সবাইরে স্যার একাই সামলাইতেন, শুধু তাই নয় আমার মত নতুন কেউ ক্লাসে যোগ হলেও স্যারই খুজে নিতেন। স্যরের একটা মজার অভ্যাস ছিল সবার নামের সাথে মিলিয়ে একটা ছোট কবিতা রচনা করতেন—আমার কবিতাটা এখনও মনে পড়ে।
"সৈয়দ মুনিমুস সালাম,
বলতে আরাম........."
দ্বিতীয় দিন দেখলাম স্যরের রোল কলের সাথে সাথে সবাই বেশ উচ্চ শব্দে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে...... সবচেয়ে ভাল লাগল রনি বলে আমাদের সহপাঠীর পদ্ধতিটা। সে শুধু দাড়িয়ে না, মিছিলের মত হাত উচু করে বিকট শব্দে হল কাপিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিত, তার চোখেও ছিল হাই পাওয়ারের চশমা। আমার রোল আসতে আমিও তার অনুকরণে মিছিলের মত হাত উচু করে বিকট শব্দে হল কাপিয়ে বললাম ‘বেগম স্যার’। আমার ধারনা ছিল সবাই ‘বেগম স্যরই’ বলে, এভাবে এক বছর চলে গেল স্যার অবশ্য ধরতে পারলেন না। দ্বিতীয় শ্রেনিতে প্রথম দিন ক্লাস-- আমরা ছিয়ানব্বই জন তিন সেকশনে ভাগ হয়ে গেছি, ক্লাস রুমও ছোট। আমার রোল আসতেই সেই পুরান অভ্যাস মতই মিছিলের মত হাত উচু করে বিকট শব্দে হল কাপিয়ে বললাম ‘বেগম স্যার’।নতুন ক্লাস টিচার স্যার বললেন কি বললি? আমি অবশ্য দ্বিতীয়বার মিন মিন করে বেগম স্যার রিপিট করলাম। স্যার বুঝলেন গোঁড়াই গলদ রয়ে গেছে, আমাকে দাড় করিয়ে রেখে সবারটা বেশ মনযোগের সাথে শুনতে লাগ্লেন। এক জন অবশ্য কি যে বলল স্যর হেসে হালকা কান মলাও দিলেন যদিও কারণটা তখন ঠিক বুঝতে পারলাম না ...... পরে অবশ্য তাকে টিফিন পিরিয়ডে জিজ্ঞেস করলাম তুই কি বলেছিলি যে স্যরে হেসে দিলেন। জবাবে ও অবশ্য একটু লজ্জা লজ্জা গলায় বলল এতদিন ও বলে এসেছে ‘প্রেম স্যার’...... এখনও মনে হলে মনের অজান্তেই হেসে ফেলি।
স্কুল ছিল পাহাড়ের কোল ঘেষে, পাশে লম্বা লম্বা ইউকেলিপটাস গাছ। তাতে বড় বড় ছিমের মত বিচিযুক্ত ফল ঝুলে থাকত আমরা নাম দিয়েছিলাম বাদর লাঠি। সুউচ্চ গাছে লাঠির মত লম্বা দেখেই বোধ হয় এ নাম করন। তবে বাদর লাঠি গাছে বানর সাহেবদের দেখা মিলত কদাচিৎ। এমনি একদিন আমারা ক্লাস রুমে ঢুকতেই দেখলাম এক বানর মহাশয় মহাআনন্দে ব্লাকবোর্ডের উপর হাত পা ছড়িয়ে বসে। আমদের আনেককে দেখে বোধ হয় তার সারকাস দেখানোর ইচ্ছা হলো, দুবার ডিগবাজি দিয়ে লাফ দিয়ে স্যারের টেবিলে এসে বসলো। আমরা যখন তুমুল উত্তেজনার সাথে বানরের লাফঝাফ দেখায় ব্যস্ত তখনি স্যর উদ্যত বেত হাতে প্রবেশ করলেন। স্যরের উদ্যত বেত দেখেই কিনা বানর মহাশয় ব্লাকবোর্ডের উপর এককোনায় গুটিশুটি মেরে বসে। সেই স্যার আবশ্য আমাদের বানর বলেই সম্বোধন করতেন তাই নতুন বানরের আগমন তার গোচরে এল না। তবে বিপত্তি ঘটলো রোলকলের সময়। স্যার রোলকলের খাতা খুলতেই বানর সাহেব নড়ে চড়ে উঠলেন এবং স্যরকে নকল করে বিপুল অন্গভন্গি শুরু করলো। আমরা তুমুল কলরব আর হাসিতে তার এই কর্মকান্ডকে স্বাগত জানালাম।
স্যর যদিও আমাদের বানর, বানরের জাত ইত্যদি বলে ফেনা তুলেন সত্যিকারের বানর দেখে উনি বেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন এবং রোলকল বাদ দিয়ে টিচার্সরুমের দিকে ছুটলেন। ইতিমধ্যে বানর স্যার, স্যরের বেত আর রোলকল খাতা দখলের মাধ্যমে স্যর হিসাবে আর্তপ্রকাশ করলো।
তবে একটু পরে হারুনভাই আর স্যর একত্রে প্রবেশ করলেন। তাদের দেখেই বানর বাদরামি বাদ দিয়ে ব্লাকবোর্ডের কোনায় গিয়ে বসল। স্যরের নির্দেশে আমরা সবাই বের হয়ে আসলাম। শুধু বানর মিয়াকে বহু ভয় দেখিয়েও বের করা গেল না, সম্ভবত বিনামূল্যে শিক্ষা অর্জনের এ সুযোগ সে ছাড়তে নারাজ। তাই বানরের গনা খুজতে নাসির ভাইকে পাঠান হল। নাসির ভাই নিজেই একটু বোকাসোকা টাইপের ছিলেন তাই এমন কাউকে খুজে পে্লেন না উল্টা আরো কিছু কৌতূহলী লোক জোগাড় করে আনলেন। তবে আবুল ভাই নামে এক মালি ছিলেন তিনি তার পানির পাইপ ক্লাস রুমের দিকে তাক করতেই বানর রুমের দরজা দিয়ে তীব্র গতিতে পালাল। তবে যাবার সময় আমাদের এক সহপাঠীর খাতা আর স্যরের বেত ছিনতাই করে নিয়ে গেল। সুউচ্চ ইউকালিপটাস গাছে বসে এক হাতে খাতা আর এক হাতে লাঠি নিয়ে সে বিচিত্র অন্গভন্গি করতে লাগলো। আমরা স্যরের বেত ছিনতাই হওয়াতে খুশি হলেও স্যর রসিকতা করে আমাদের বললেন " দেখিশ তোদেরর খাতার মত তোদের বসার জায়গাগুলো না বানরে দখল করে!"
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সব অনুষদ মিলিয়ে বিরাট র্যগ আনুষ্ঠান হতো। শুনলাম ফিডব্যাক আসবে সেবার, তাই স্কুলে গিয়ে যখন দেখলাম আর্ধেক ক্লাস খালি তখন আবাক হবার কিছুই ছিলো না।যাইহোক, টিফিনের সময় ছেলেদের বাকি আংশের মধ্যে কিছু খুব ভালো ছাত্র ছাড়া বাকি আংশের প্রায় সবাই স্কুল পালালাম।আমর যখন স্কুল আন্গিনা পেরিয়ে বেশ কিছু দূর চলে এসেছি ঠিক তখনই বিপত্তি...... দেখলাম নুরল করিম স্যার বেশ দ্রুত গতিতে আসছেন। তখনভার্সিটি ক্যম্পাস জুড়ে কিছু মুড়িরটিন বাস বেশ ঘুরে বাড়াতো। তারই একটা থেমে থাকা বাসের পাশেই সবগুলোগা ঢাকা দিলাম। আশা, স্যার আমাদের দেখতে পবেন না। যখন বাসের তলা দিয়ে উকি দিয়ে দেখছি স্যার গেলেন কিনা... দেখি ওপাশ থেকে স্যারও বাসের তলা দিয়ে উকি দিয়ে দেখছেন একদম যেন শুভ দৃষ্টি বিনিময়। স্যার অবশ্য আর কিছু না বলেয় চলে গেলেন, যদিও মনটায় দমে গেলো। তবে যাই হোক প্রাথমিক ধাক্কা সামলে আমরা রওনা হলাম, যা হবার তা পরে দেখা যাবে। স্টেজ করা হয়েছিলো বড়ো মাঠে, গিয়ে দেখি লোকে লোকারন্ন। ওপেন ইয়ার কনসার্ট বলে কথা। ভার্সিটির ভাইরা তখন একেক জন একেক সাজে স্টেজের সামনে....।নাচা গানা আর হৈহৈএ ভরপুর বড়মাঠ ।তখনও ফিডব্যাক আসেনি, কি সব নাম না জানা বাউল আর ব্যন্ডদল অখাদ্য পরিবেশন করে যাচ্ছিল। আর তাতেই সবাই নেচে গেয়ে আর গলা মিলিয়ে চলছিলো। দেখলাম এক বড়ো ভাই মাথার চুলকেটে "Mr T" সেজে হেভি ড্যান্স মারতাছে আর আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে পিন্টু মাথায় একটা লম্বা চোংগা মতো লাগিয়ে তার সাথে সাথে ব্রেকডেন্স.... আর যায় কোথায়... আমরাও হৈহৈ কর ছুটলাম।যখন ফিডব্যাক আসলো তখন একপশলা বৃস্টি যেন অভর্থনা জানলো.. মনে আছে মাকছুদ বেশ কাদো কাদো সুরে বলেছিলো এটাই তার করা সেরা কনসার্ট, কি জানি সব স্টেজেই বলে নাকি। শেষ গান ছিলো 'মেলাই যাইরে...' শেষ বিকালে দুবার গেয়েছিলো আর আমরাও পাগোলের মতো গলা মিলয়েছিলাম মনে আছে। যখন ফিরছিলাম তখন হাত দিয়ে দেখেছিলাম মাথার চুলেও কাদা পানি। বাসায় এসে প্রথমে মার কান মলা দিয়ে শুরু তারপর বাকিগুলো আর নাই বললাম...
বারী ভাইকে কখনো সামনে হতে দেখি নাই, তবে উনার ফাইটার জেট যখন আমাদের স্কুল প্রাঙ্গনের উপর দিয়ে ঘুরে যেত আমরা সবাই ছুটে বের হতাম, বিমান দুর্ঘটনায় আমাদের ছোট কালের সেই বিমান হিরো যেদিন হারিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো| সুজন ভাই ছিলেন আমার প্রিয় বড় ভাই, যেখানেই দেখা হতো হাসি মুখে বলতেন "এসো না কোথাও বসি..." গল্পের সাথে ব্যাপক খাওয়া দাওয়া | তবে কখনই বিল দিতে দিতেন না, শুধু হাসি মুখে বলতেন ছোট ভাইদের বিল দিতে নেই! অনুরূপ ভাই ছিলেন আমাদের ঠিক দু ক্লাস আগে, উনাদের আগের ব্যাচের বিদায় বরণ অনুষ্ঠানে গিটার বাজিয়েছিলেন, যদি ভালো না লাগে দিও না মন....! হটাৎ দুজনেই কেমন হারিয়ে গেলেন, আমাদের ব্যাচের মামুন ছিল সবচেয়ে ছোট লম্বায়, চলেও গেছিলো সবার আগে! সায়েম উল বারী একবার ভট্টাচার্জ স্যার কে দেখেই দৌড় দিয়েছিলো কিন্তু স্যার ও নাছোড়বান্দা| পিছনে ছুটে ঠিকই পাকড়াও করেছিলেন, তাই ওকে দেখলেই বলে উঠতেন, "তুই আমাকে এই বয়সেই দৌড় শিকাইছিস"| আদিত্য ছিল শাহ আলম চাচার একমাত্র ছেলে.... দুজনেই খুব নিকটতম সময়ে স্মৃতি হয়ে গেছিলো আমাদের কাছে| দিয়াজ আমার বন্ধু সাজেদ বিন আমিনের ভাইগ্না তাই সম্পর্কে আমাদের পুরো ক্লাসের ভাইগ্না, খুব ছোট বয়স থেকে স্নেহের পাত্র প্রিয় কাছের মানুষ গুলো কিভাবে যেন হারিয়ে যায়..... মুসা ভাই তেমনি আরেকজন বড় ভাই খুব অকালে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বলি হয়ে গেছিলেন অনেক সম্ভবনাকে বাকি রেখে| মুশফিক ভাই আর আমাদের ক্লাস ব্যবধান মাত্র এক ক্লাস, আমার জীবনে দেখা আদর্শ ভাল ছাত্র, উনার মিষ্টি চেহারার মতো ব্যবহারও ছিল নিপাট ভদ্রতায় মোড়া| আর মার্জিয়া জাবিন দোলা আপুর মৃত্যু ছিল আমাদের দক্ষিণ ক্যাম্পাসের প্রথম দেখা অঘটন|
স্যারদের মাঝে পিটি স্যার এর কথা মনে পড়ে, আমাদের দাঁড় করিয়ে পিটির মাঝে গাধা নিয়ে তার বিখ্যাত স্বরচিত গান গাওয়াতেন| স্যার অবশ্য আমাদের স্কুলে থাকতেই মারা গিয়েছিলেন, যতদূর মনে পরে ইউনিভার্সিটি পড়াকালীন সালেহা অপার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম| পুরাতন সোলেমান স্যার আর ভট্টাচার্য স্যারকে বাঘের মতো ভয় পেলেও তাদের স্নেহ ছিল অনেক বেশি| আজিজুল হক স্যারএর ভয়ে ভুগলের পড়া আজও মনে করতে পারি, রাজন স্যার, কাজল স্যার, তাহের স্যার, ইসহাক খান স্যার, বিনোদ দাস স্যার, নূর মোহাম্মদ স্যার, মাহবুবুল হক স্যার, জালাল স্যার, অরবিন্দ স্যার, সিরাজুল মোস্তফা স্যার, হাবিব স্যার, পন্ডিত স্যার, মদন স্যার যাদের অপার স্নেহ আর শাসনে জীবনের মধুর দিনগুলো পার করেছি কেবল হানিফ স্যার আর দৌলতুল্লাহ স্যারকেই স্কুলে সংযুক্ত পেয়েছি| কলেজে পারভেজ স্যার মাহবুব স্যার দুজনেই বাংলা পড়াতেন যদিও মাহবুব স্যার খুব অসুস্থ আর পারভেজ স্যার ও না ফেরার দেশে| ইংলিশ এর ম্যাডাম আছেন, সালাম স্যার, হাবিব স্যার, শাহেন শাহ স্যার আর মোজাম্মেল স্যার আমাদের সময়ে ছিলেন নিতান্তই অভিবাকের মতো| স্মৃতির বৈঠা বেয়ে হাজারো স্মৃতি এই প্রিয় স্কুলকে নিয়ে, হয়তো দু কলমে প্রকাশ করা অসম্ভব তবু প্রিয় স্কুলের নাম যেন মিষ্টি পরশ হয়ে আসে হৃদয়ের মনিকোঠায়|
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:৫৭