রাজ্যের নাম মেঘালয়, ঢুকতে হবে সিলেটের তামাবিল দিয়ে।তাই একদিন আগেই রওনা দিলাম।হরতাল মাত্র ভান্গছে আর রাতের ট্রেনের টিকেট তাও আবার অনলাইনে কাটা।যেতে হবে নিদেনপক্ষে আধা ঘন্টা আগে।আগেই সব ব্যগ গুছিয়ে রাখা ছিলো। কিন্তু বের হতে হতে যথারীতি দেরি।ওদিকে আমার ভাইগ্না ভাইগ্নী ভাইস্তা আর প্রিয় পুত্র সবাই কোরাস যোগ করে দিলো আমার সাথে যাবে। অনেক বুঝ টুঝ দিয়ে সবগুলোরে ঠান্ডা করে যেইনা বের হইছি কিন্তু কোনো টেক্সি পাইনা।অবশেষে না পারতে ব্যাটারী রিক্সাই শেষ ভরষা....।
যখন পৌছলাম আমার কলিগরা উদিগ্ন মুখে আমারে খুজছে।সারা রাত লোহালক্কড়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে চললাম উদয়ন এক্সপ্রেসে...ট্রেনের যা বাহার। সকালে পৌছে যে হোটেলে উঠলাম বেশ ছিমছাম। তবে পানির বদলে ট্যাং এর শরবত বাথরুমের পানি।বুঝলাম এ দিয়ে গোছল দিলে খবর আছে। তবুও কোনরকমে গোছল সাইরে দিলাম একটা ঘুম। জুম্মার দিন আগে থেকেই ইচ্ছা ছিলো হযরত শাহজালাল (র এর মসজিদে জুম্মাটা পরবো।
গিয়ে দেখি জনাকির্ন অবস্থা.... কোন রকমে রাস্তাতেই গামছা বিছিয়ে নামাজ পড়লাম, পরে নামাজ শেষে গেলাম মসজিদের ভিতর। ছায়া ছায়া কেমন জানি শান্ত ভাব এই মহান ব্যক্তিত্বের মাজার ঘিরে। আর পাশেই মাদ্রাসা..কত ছাত্র তাতে ইসলামের মাধুর্য আহরনে ব্যস্ত। মাজার জিয়ারত শেষে গেলাম জাফলং...বেশ উচু নীচু রাস্তা। আশে পশে কেবল পাথর ভান্গা মেশিনের ঘরঘর শব্দ আর ধূলিদূষন। জাফলংএ হাজার হাজার পর্যটকের পদভারে মুখরিত। শিলপাটা আর পাথরের রকমারি পন্যের দোকানে ভরপূর চারধার। ছোট ছোট নৌকো করে চলে যাওয়া যায় একবারে ইন্ডিয়া সীমান্তের কাচাকাছি।
আমরাও একটা ছোট নৌকা ভাড়া করে চললাম। নীচে পাথর আর পাথর উপরে টলটলে পানি। নৌকা চলছে ধীরে ধীরে..লোকজনের বড় আগ্রহ ইন্ডিয়া সীমান্তের কছে যাওয়ার।
পরদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গেই শুনি ঢাকার বাস হাজির।কোম্পানির ঢাকার কলিগরা বউ পোলাপাইন নিয়ে আমাদের হোটেলেই রেস্ট করতে নামল।ট্রাভেল এজেন্ট বলে এইখানে রেস্টহাউসএর কোন ব্যবস্থা রাখেনি।সবাইরে গুছায় নিতে নিতে সূর্যিমামা মাথার উপর গনগনে আগুন ছড়াচ্ছেন...... এর মধ্যে হেঁটে হেঁটে বর্ডার পার হলাম। তবে ভারতীয় বর্ডারে তেমন ঝামেলা করলনা,আর লোকজনও কম।ওদিকে পাথর বোঝায় শয়ে শয়ে ট্রাক সব ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে তাই পুর এলাকা ধুলায় ধুলরন্য হয়ে আছে।বাংলাদেশ বর্ডার শেষে পাহাড় শুরু... আমাদের জন্য অপেক্ষারত হুডখোলা জীপ গুলো ধরতে বেশ খানিকটা হাঁটতে হলো।
শিলং হচ্ছে ভারতের 'সেভেনসিস্টার্স' এর অন্যতম মেঘালয়ের রাজধানী। শিলং যেতে সিলেট থেকে প্রথমে যে্তে হয় তামাবিল বর্ডারে, যেতে ঘন্টা দেড়েক লাগে। তামাবিলের রাস্তা জুড়ে ভ্রমণের অন্যরকম আনন্দ। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায় দুপাশে শুধু উচু উচু সব পাহাড়। এই পাহাড়ের উপরেই শিলং। তামাবিল হচ্ছে আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে সহজ বর্ডার।এখান থেকে কয়েক কদম পরেই ইন্ডিয়ার বর্ডার, একদম সামনা সামনি।
এরপর আড়াই-তিন ঘন্টার পাহাড়ের পথে আকাশকে ছোঁয়ার পথ যেন। রাস্তাও বেশ ভালো এবং মাঝে মধ্যে পাহাড়ে সমতল ভুমির পরশ। পুরা ভ্রমণেই চারপাশে মুগ্ধ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট প্রকৃতিক উপকরণ সঞ্চিত আছে। প্রথমে বিশাল বিশাল পাহাড়ি পাথর যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে, পরে পাহাড়ি পথে ঝর্না আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম শিলং।
শিলং শহরটা বেশ সাজানো গোছানো সুন্দর। শহরের বাইরে থেকেই দেখা যায় সুন্দর সব একতলা, দোতলাবাড়ী, স্থাপত্য অনেকটা নেপাল ভুটানের মতই। শিলংএ খ্রীস্টান সম্প্রদায় বেশী, সেকারনে পথে পথে অনেক চার্চও, ইংরেজরা বলে গরম সাইট না পেরে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিল। অবশ্য সে সময়ে তেম্ন জন মানুষ শূন্য এই পাহাড়ি প্রান্তরে কিভাবে যে তারা ঘাতি গেরেছিল কে জানে?অবশ্য এখন শহরের অধিকাংশ দোকান চালায় বাংগালীরা, তাই কথাবার্তা বলত তেমন সমস্যা হয় না ।আমরা যে হোটেলে উঠলাম সেটা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে।অর্ধেক পাহাড়ের উপরে আর অর্ধেক নিচে...... প্রায় পুরা হোটেলটাই আমাদের জন্য বুকিং দেওয়া। আমি একটু দেরিতে গিয়ে একটা সিঙ্গেল রুম পেলাম ভাগ্যই বলতে হবে।প্রথম দিন কোন সাইট সিইং নাই তাই সবাই এলো-পাথারি ঘুরে বেড়ালাম। রাতে একা একা ঘুমাতে বেশ ভয় ভঁয় লাগল—বিদেশ বিভুই ভুতগুলো নিশ্চয় শান্ত প্রকৃতির হবে না!
ঘুরে বেড়াতে চাইলে শহরের বাইরে অসংখ্য ঝর্না, পাহাড় অভাব নেই। তবে প্রথমেই শিলংপিক দিয়ে শুরু...ওদের এয়ারবেসের ভিতর দিয়ে যেতে হয়।ভিতরে উভ-উত্তল আয়না বসান জায়গায় জায়গায়, নজরদারি করার জন্য। ভিতরে ছবি তুলা নিষেধ, দেখলাম একদল ছবি তুলে ধরা খাইছে।
তবে শিলং পিক যেটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৯৬৫ মিটার উচু— তার উপরের ভিউ পয়েন্ট থেকে খুব সুন্দর ভাবে পুরো শহরটা দৃষ্টিগোচর হয়।আছে উমিয়াম লেক নামের চমৎকার একটা লেক ,এটা শিলং থেকে একটু বাইরে। তৃতীয় সাইট সিইং ছিল ভুতের গুহা...... গুহাটা এক পর্যায়ে এমন সরু যে ওপাশে যেতে পারব কিনা সন্দেহ হয়।
তবে সাহস করে পার হলেই ওপাশে গুহার বাকি অংশে পৌঁছে যাওয়া যায়। পর দিন সকালে চলে গেলাম চেরাপুন্জি। মেঘের জন্য চারপাশে কিছু দেখা যায় না। এর মধ্যেও যা দেখলাম পাহাড়ের উপর থেকে মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যাথেষ্ট।পায়ের নিচ দিয়ে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।দূর থেকে দেখলে কুয়াশা মনে হতে পারে, আসলে সব মেঘ। মাঝেমধ্যে এমন হয় কিছু দেখা যায় না, হঠাৎ করে সব ফুঁড়ে উঠে। সঙ্গতকারণে ই এই রাজ্যের নাম মেঘালয়। মেঘের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কখনে হাত দিয়ে ধরা যায় না।
ফেরার পথে কোরবান ব্রিজ হয়েএলাম...... নায়ক রাজ অমিতাভ বচ্চন বলে তার কুরবান ছবির একটা দৃশ্য ধারন করেছেন এই ব্রিজে, তাই এর নাম কোরবান ব্রিজ। অবশ্য সিনেমার আগে যে ব্রিজের নাম কি ছিল কে জানে? কিন্তু কোরবান ব্রিজের পাশে ফটো সেশন করতে গিয়ে আমাদের এক সদস্য প্রায় কুরবানী হয়ে যাচ্ছিল...... পাহাড় থেকে পড়ে তার দুই তিন জায়গায় ইনজুরি হয়ে গেল।তাই পরের সাইট নঅকালিকাই ফলসে পৌছতে একটু দেরিই হলো।
নঅকালিকাই ফলসের পাশে এক মায়ের ছেলে হারানর হৃদয়বিদারক পৌরনিক কাহিনী বেশ বড় করে লেখা।তবে আমরা সহজে বলার জন্য নোয়াখালী ফলস ই বলতাম।শিলং এর আবহাওয়ার কোন আগামাথা নেই।এই ঝুমঝুম বৃষ্টি, এই রোদ আবার এইঠান্ডা, ক্ষনে ক্ষনে অযেদার চেইঞ্জ।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাতের এলাকা চেরাপুঞ্জি গেলাম পরদিন। শিলং থেকে সম্ভবত ঘন্টা দুয়েকের পথ চেরাপুঞ্জি।ওখানে পৌছেই বুঝতে পারলাম কেন এটাকে বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপাতের এলাকা বলে।পুরো পথ কুয়াশাচ্ছন।স্থানে স্থানে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই ঘুরে বেড়ালাম।
ড্রাইভার আমাদের একটা ইকো পার্কে নিয়ে গেল।ওখানে সাতটা ঝর্ণার একটা অর্ধবৃত্তের মত আছে।নাম সেভেন সিস্টার ফলস অনেকটা বড় ফলসের এর মত ভূপ্রকৃতি।ঘুরে বেড়ালাম, ফলসের উৎপত্তির দিকেও কিছুদূর গেলাম। ঝর্ণায় তখন অবশ্য খুব বেশি পানি ছিল না।
শিলং ছেড়ে আমরা সীমান্তের বেশ কাছাকাছি একটা গ্রামে গেলাম, এটা বলে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম।তবে বেশ ছিমছাম—আমরা চা খেলাম, কেউ কেউ আবার বাতাবি লেবু কিনে খেল।সেই গ্রামের লোকজন একটা গাছের উপর মাচামত করছে...... ওখান থেকে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ দেখা যায়।যাদের মোবাইল বাংলাদেশি সিম ছিল তারা কথাও বলতেপারল—মোবাইলের নেটওয়ার্ক ত আর সীমানা মানেনা।
আসার পথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল, ঠিক তখনই এক জায়গায় প্রকৃতির এক অপূর্ব রুপ দেখা গেল! রাস্তা থেকে নীচে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে সুন্দর এক রংধনু !অসাধারণ ! নীচ থেকে উপরে অনেক রংধনু দেখেছি, কিন্তু উপর থেকে নীচে এই প্রথম !
পার্কের নাম “লেডিহায়দারি পার্ক”।লেডি হায়দারি ছিলেন একজন “ফার্স্টলেডি”, আসামে গভর্নরের স্ত্রী।পার্কের সাথে আবার চিড়িয়াখানা ফ্রি।ভালই লাগল।বুঝতে পারলাম শিলংবাসী একটু ঘুরতে ফিরতে এখানে আসে। পাহাড়ী এলাকায় পার্ক খুজে পাওয়াতো আসলেই একটা দারুণ ব্যাপার।পরিবার গুলো তাদের শিশুদের নিয়ে এসেছে, ওরা মজা করে খেলছে।
পরে গেলাম লাইভ রুটব্রিজ- অনেকগুলো গাছের শিকড় বাকড় জড়িয়ে একটা ব্রিজের মত হইছে।নিচে ঝরনার পানি মাটি ধুয়ে নেমে গেছে বহু নিচে...... তাই লাইভ রুট ব্রিজ। তবে সাইটে পৌঁছতে বহুদূর পথ পায়ে হেঁটে নামতে হ্য়।
এই সব দেখেই ফিরতি পথ ধরলাম...সবশেষে একটা ঝর্ণা দেখা গেল, নাম “এলিফ্যান্টফলস”।এই ফলসটাই বেশ বিশাল আর অনবরত পানির কলকাকলি। উপর থেকে আবার বাংলাদেশও দেখা যায় ।বর্ডার ক্রস করতে করতে বিকেল। প্রায় তিন চার দিন পর আমার প্রিয় সদেশ.......
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৩০