“মা কয়টা খয়রাত দেন”।
“যাও ভাগো! খয়রাত নাই”- মা বাজখায় গলায় ফকিরটাকে বিদায় করেন।বুবুনের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ও জানালা দিয়ে দখলো ফকিরটা যাচ্ছে। ও হাত নেড়ে ডাকে ফকিরটাকে, ওর জমানো টাকা থেকে কিছু দিবে মনে করে।
কিন্তু যেই না ও লুকানো টাকা বের করেছে বড় আপু কোথা থেকে এসে, “তোর কাছে না টাকা পাই না”- বলেই সব বাজেয়াপ্ত করে ফেলল। ফকিরটা কিছু না পেয়ে বুবুন কে গালাগাল করতে করতে চলে গেল। ও যতই মন ভালো করতে চাচ্ছে ততই মন খারাপ হচ্ছে। মনটা কিছুতেই আর ভালো হচ্ছে না। বার বার সে ভালো করতে চাচ্ছে ততই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই তো ভাইয়ার ঘরে গেল একটু সিডি প্লেয়ারে গান শুনবে বলে। ভাইয়া পড়ব বলে ধুম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ও কিন্তু ঠিক দেখেছে ভাইয়া কানে হেডফোন লাগিয়ে মজাসে গান শুনছে। ওকে একটু দিলে কি হতো। এরপর মায়ের ফোনটা থেকে একটু মিশুকে যেই না ফোন দিলো, মা এসে কান মলে দিলো.... "সারাদিন খালি ফোনে বকবক।" ওর দুচোখে পানি চলে এসেছিলো অনেক কষ্টে কান্না লুকিয়ে রুমে ঢুকলো না যাও, বড় আপু খেও খেও করে উঠলো। ও জানে এ সময় বড় আপু লুকিয়ে কার সাথে জানি কথা বলে মোবাইলে আর ওকে দেখলে হৈচৈ শুরু করে। তো ও যাবে কোথায়?
মাঝে মাঝে ওর মরে যেতে ইচ্ছে করে। তখন সবাই বুঝবে বুবুন কি ছিলো। এমন সময় বাজখাই গলার স্বর শুনেই ও বুঝে গেল বাবা এসেছে। আরেক দফা বকা খাওয়ার ভয়ে ও তাড়াতাড়ি সিড়ির ঘরে লুকায়।
বাবা বাসায় ঢুকেই চিৎকার শুরু করেন, “বুবুনটা কই ? আজ ওর মাস্টারের সাথে দেখা হলো”। বুবুন ভাগ্যিস লুকিয়ে ছিলো না হয় কিছু উত্তম মধ্যম খেতেই হতো। যা হোক ও চুপি চুপি ছাদে চলে এলো। সারা ছাদ তেতে আছে এই ভর দুপুরে। পা দিলেই ফোসকা লেগে যাবে। ও কোনরকমে টান্কির পাশে ছায়ায় এসে বসলো। এ জায়গাটা বেশ ঠান্ডা..... মাঝে মাঝে ফুরফুরে হাওয়াও বয়ে যাচ্ছে।
বুবুন হাফ ছেড়ে বাচলো।
সামনে পরিক্ষা কোন স্যরের সাথে যে ওর বাবার দেখা হলো কে জানে। ও ঠিক করলো বিকালের আগে বাসায় যাবে না। তখন বাবা বাইরে হাটতে যাবে তখনই ফিরলে তার কোন বকা খেতে হবে না। ও ছাদে শুয়ে পড়ে। উপরে বিশাল আকাশ, নীল রংএর কার্পেট যেন বিছিয়ে রয়েছে। বুবুন হটাৎ আবিস্কার করলো সাদা সাদা চলন্ত মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন ও উড়তে শুরু করেছে।
মেঘের পিঠে চড়ে ওর মনটা হটাৎ ভালো হয়ে গেল।
মন ভালো হলে ও ফিরতি পথে চললো। সূর্য ঢলে পড়ছে, ছাদটও বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। ও পা টিপে টিপে বাসায় ঢুকে পড়ে, ওর -বাবা ঘুম। টেবিলে ঠান্ড ভাত বেড়ে রাখা। কেউ ওকে খুজলোও না.... । ও তাই খেয়ে নিলো। এমন সময় মা এসে বসলো, “কিরে কই গেছিলি সবাই খেয়ে ফেলল”।
ও চুপ কর থাকে।
'থালাটা ধুয়ে রাখিস' বলে মা তরকারি ভাত সব ফ্রিজে ভরতে থাকেন। ও খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে রুমে গিয়ে দেখলো ভাইয়া কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুমিয়ে.. ও পাশে শুয়ে পড়লো।
বিকালে ভয়ে ভয়ে উঠলো। বাবা আবার হৈচৈ শুরু করেন কিনা। দেখলো ওর ভাইয়াও বল নিয়ে বসে আছে, বাবার ভয়ে বের হতে পারছে না। ওদিক থেকে ভাইয়ার বন্ধু তুহিন খালি দূর থেকে উকি দিচ্ছে, ওদের বল না হলে বিকালে খেলা হবে না।
বুবুনের বাবা চা খেয়ে বের হলেই ওর দু ভাই লাফাতে লাফাতে বের হলো। দল ভাগ করাই ছিলো, বল পেয়ে ওরা হৈ হৈ করে খেলায় মেতে উঠলো। প্রথম জুতার বাড়িটা খেয়ে ও এমন কিছু বুঝতে পারলো না, কেবল সবাইকে দেখলো ওর দিকে চোক বড়ো করে তাকিয়ে থাকতে। ওর ভাইয়া বল বাদ দিয়ে মাঠ থেকে দৌড় দিলে ও বুঝলো ওর বাবা জুতা হাতে তেড়ে আসছে। কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে। বাবা ওকে কান ধরে গরুর মতো বাসায় টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর মনে হলো ধরনি দ্বিধা হয়ে যেত। পাশের বাড়ির ছাদে ওর সহপাঠি নীলা যে রোজ বেশ মনোযোগ দিয়ে ওদের খেলা দেখে, মাঝে মাঝে থার্ড আম্পায়ারের ডিসিসন দেয়, ওর দিকে করুন চোখে তাকালো। ও আনেক কষ্টে কান্না চাপলো।
বুবুনের আর কিছুই ভালো লাগছে না। বাবা সবার সামনেই এভাবে ওকে না মারলেও পারত।ভাইয়াটা ঠিকই বেচে গেল। যত ফাটা কপাল বুবুনের।বাবা এসেই বললেন “সারাদিন পড়া লেখা নেই শুধু খেলেধুলা”। মাত্র প্রথম সাময়িক পরীক্ষাটা শেষ হল এখনি আবার “পড় পড় পড়। না পড়লে পিছিয়ে যাবে। রুমি, জয় ওরা কি তোমার মত ঘুরা ফিরা করছে না খেলধুলা করছে। এইত জয়কে দেখলাম গতকাল থেকে প্রাইভেট স্যরের কাছে যাচ্ছে। আর তুমি সারাদিন খেলায় মেতে আছ। পড়তে বস”।
ওর মনে হয় মাত্র তো পড়া থেকে উঠলাম। প্রথম সাময়িক পরিক্ষার সময় রাত দিন ত পড়ছিই। কই তখন তো কেউ খেলার কথা বলেনি। কেউতো বলে না বুবুন অনেক পড়ছ এখন খেল। ছোট বলেই বোধ হয় সবাই এত উপদেশ দেয়। উপদেশ শুনতে শুনতে ও যখন একদম বৃতশ্রদ্ধ, তখনই হটাৎ ছোট মামা হাজির। মামা আসলেই ওর মনটা ভাল হয়ে যায়। এসেই দরজায় দাড়িয়ে মিষ্টি করে বলবে আমার বুবুন মণি কই??? পকেট ভরা থাকবে চকলেট আর হাতে চিপস। মা একদম মামাকে দেখতেই পারে না। দেখলেই যথারীতি বকাঝকা শুরু করে দেন। এত বুড়োটি হইছিস এখনও কোন চাকরি বাকরি করিস না। মামা ভাবলেসহীন ভাবে শুনেন কোনকিছু বলেন না। এভাবে একদিন দুদিন থেকেই চলে যান। তবে ওদেরকে নিয়ে বিকালে ঘুরে আসেন দূর দূরন্ত থেকে। যেখানে ওদের একা যাওয়া বারন।ভাইয়াও এসে মামাকে দেখে হই চই করতে উঠল। আপা বললেন –“মামা কবে এলেন এবার কিন্তু আমাদের নিয়ে নদী ভ্রমনে যেতেই হবে। না বললে চলবে না”।– মামা গতবারও ফাকিবাজি করে চলে গেছেন।
বিকাল হতেই মামা বলে উঠলেন – “তাহলে চল আজই নদী তীরে ঘুরে আসি”। বুবুনের বুকের রক্ত ছলকে উঠে, ও কখনো নদী তীরে যায়নি। ও তো মনে মনে এই সময়ের অপেক্ষায় ছিল। আনেক শুনেছে ওর বন্ধুদের কাছে, কিন্তু যওয়া হয়নি কখনও। আজ কি ভাল কাজ করছে যে ওর এত ভাগ্য, মনে মনে ভাবার চেষ্টা করে। আপা ভাইয়াকেও ডাকা হলো।
নদীর কাছে আসতেই কেমন যেন একটা স্বেদ স্বেদ গন্ধ নাকে এসে লাগে। কেমন যেন শীতল ঠান্ডা অনুভূতি। ওর খুব ভালো লাগে। নদীর পাড়ে সব নৌকা সারি সারি। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। ছোট ছোট ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পরছে। বুবনরা এক জায়গায় এসে নিঃশ্চল দাড়িয়ে থাকে। নদী পাড়ের ফুরফুরে বাতাস ওদের গা জুড়িয়ে যায়। নদীর ঐ পাড়টা আবছা একটা অবয়ব হয়ে ভেসে আছে। মনে হয় কোন রহস্যময় নগরী খুব আকর্ষন নিয়ে দড়িয়ে আছে। বুবন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। ওর মনে হয় ওর যদি ওর আর কখনো ফিরতে না হত। মামা ওর অবাক হওয়াটা দাড়িয়ে দড়িয়ে উপভোগ করেন। নদী তীরে ছোট ছোট ঘাট। তাতে কিছু মানুষ গোছল করছে, কেও কেও কাপড় চোপড় ধোয়ায় ব্যস্ত। এর মাঝে কিছু ছেলে মেয়ে ফুটবল জাতীয় খেলায় ব্যস্ত। একটু খেলেই ওরা দল বেধে লাফিয়ে পড়ছে নদীতে। আবার কিছুক্ষন পর হৈ হৈ করে পাড়ে খেলায় মেতে উঠছে। বুবুনের খুব ইচ্ছে করে এমন হৈ হৈ করে ওদের সাথে খেলতে।
মামা বলে উঠেন, কিরে কেমন লাগছে?
ও বলল, “খুব ভাল মামা খুব ভালো... তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না”।
আপা ত বলেই উঠল –“নৌকা চড়তে ইচ্ছে করছে মামা”।
মামা হাসেন। বুবুনের ভাইয়া আর মামা মিলে একটা নৌকা ভাড়াও করে ফেললেন। একবার মাঝ নদী থেকে ঘুরে আসতে পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু সমস্য বাধল টাকা নিয়ে। মামার কাছে এত টাকা নেই। তবে আপা আর ভাইয়া তাদের জমান টাকা বের করল। ভাড়া হয়ে আর কিছু টাকা হাতে রয়েয় গেল যা হোক। বুবুন বসল এক পাশে ওর মামার সাথে আর অন্য পাশে ওর আপা আর ভাইয়া। নৌকাটা প্রথমেই একটু দুলে উঠল। ওরা বেশ ভয় পেয়ে গেল, অবশ্য নৌকার মাঝি অভয় দিল। ছলাত ছলাত শব্দে দাড় বেয়ে নৌকাটা মাঝ নদীর দিকে ছুটে চলল। ওরা জলে হাত ডুবায়, মিষ্টি ঠান্ডা পানি। কত নৌকা নদীর মাঝে বেয়ে চলছে। বুবুনের আপু ওর দিকে পানি ছুড়ে মারে, জবাবে ঔ ছুড়ে। নৌকার মাঝি আবার সাবধান করে দেন—পইরা যাবা কিন্তু। কিছুক্ষন চলার পর মাঝিও গান ধরে--বুবনের খুব ভালো লাগে। এতটা ভালো আর জীবনে কখনও লাগেনি।
“চল, একটু নাস্তা করে নেই। কেমন যেন খিদে খদে লাগছে”- মামা বললেন।
“মামা এসব খোলা খাবার খাওয়া মোটেই ভাল না, মা মানা করছেন”।
“আরে রাখ, ঐ দেখ গরম জিলেপী ভাজা হচ্ছে। গরম জীনিষ হেভী মজা হবে মনে হচ্ছে”।
সুতরাং বুবনরা তিনজন আর মামা এসে বসলেন নদীপাড়ের ছোট দোকানের এক পাশে। বড় কড়াই করে জিলাপী ভাজা হচ্ছে। সবাই আশেপাশে ছোট ছোট টুলে বসে ছোট বাটিতে করে খাচ্ছে। বুবনেরবয়েসি একটা ছেলে সবাইকে হাতে হাতে বিলি করছে।
কি খাবেন মামা? ছেলেটা জীগ্যেস করে।
জীলাপি নিয়ে আয়, গরম গরম আনবি।
বুবনের খুব অবাক লাগে ছেলেটার কথা শুনে। কত অবলীলায় একজন অচেনা লোককে মামা বলে ডাকলো।
জীলাপি মারাত্নক গরম, হাত দিয়ে ধরাই কঠিন। ওরা ফু দিতে থাকে, নদীর উদাসী হাওয়াও যেন ওদের সাথী হয়। জিলাপী মুখে দিয়ে বুবনেরর মনে হয় অমৃত, মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই যেন মাখনের মত মুখের সাথে মিশে যাচ্ছে। ও খুব তৃপ্তি করে খায়, ওরা আরো দু বাটি নিল- টাকা থাকলে হ্যত আরও খাওয়া হত।
বাসায় ফিরতে ফিরতে বুবুনের মনে হয় আসলে আজ ওর মনের কষ্ট গুলো সব মুছে গেছে। এমন কি কাল বাবার মারের কথাও আর মনে থাকে না। আসলে জীবনটা এমনই, একদিন খুব খারাপ গেলে আরেকটা দিন খুব মধুর কাটে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:০৫