ইমামতী- 'আজব এক চাকরি'!
"আজব এক চাকরী- ইমামতী"- এই শিরোনামে একটা লেখা অনলাইনে দীর্ঘদিন যাবত দেখতে পাচ্ছি। সামাজিক ভাবে আমি একটা মসজিদের ব্যবস্থাপণার সাথে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলাম। "আজব এক চাকরী- ইমামতী" বিষয়বস্তু নিয়ে আমি আমার যৎকিঞ্চিত অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিঃ-
আমাদের পারিবারিক ওয়াকফা করা জমিতে নির্মিত মসজিদের বয়স অর্ধ শত বর্ষ অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে আরও দুই যুগ আগে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি সেই মসজিদের একজন মোতয়াল্লী হলেও ব্যবস্থাপনায় আমার কোনো ভূমিকা নাই। সব ক্ষমতা জোরজবরি মসজিদ কমিটি নামের লুটেরাদের।
প্রায় এক বিঘা জমির উপর নির্মিত এই মসজিদ শুরুতে ছিলো শুধু একটা টিনের ঘর। মসজিদ- মক্তব্যের সাথে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জীন-খাদেমদের কোনো রকম আবাসিক ব্যবস্থা। সময়ের ব্যবধানে ৯৫% ব্যক্তিগত অনুদান ও ৫% সরকারী সহায়তায় দশ কোটি টাকা ব্যয়ের সেই মসজিদ এখন অত্যাধুনিক ছয়তলা ভবন। প্রতি ফ্লোর ৬ হাজার স্কয়ার ফুট। সাথে একটা এতিমখানা কাম হাফেজী মাদরাসা। মসজিদের ভিতর বাহির মিলিয়ে একসাথে ১২ শত জন মুসুল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদ সংলগ্ন যায়গায় চার তলা একটা ভবন নির্মাণ করে নিচ তলায় ১৪ টা দোকান "নয়ছয়" করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে- যা থেকে ভাড়া পাওয়া যায় তিন লাখ টাকা(প্রতিযোগিতা মূলক ভাবে পজিশন ভাড়া দেওয়া হলে আরও ৪/৫ লাখ টাকা বেশী পাওয়া যেতো)। ২য়, ৩য় তলায় মাদরাসা-এতিমখানা ও ৪র্থ তলায় মাদরাসা শিক্ষক এবং এতিমদের আবাসিক ব্যবস্থা।
সম্প্রতি একজন সককারী ঈমাম নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেওয়া হয়। ঈমামের শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ স্বীকৃত মাদরাসা থেকে কোরআনে হাফেজ, মাওলানা ও মুফতি হতে হবে। উল্লেখিত যোগ্যতার প্রায় দেড়শজন আলেম ইমাম পদের জন্য আবেদন করেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ইমাম নিয়োগ দেওয়ার জন্য মসজিদে নির্দিষ্ট দিনে ইমাম প্রার্থীদের পরীক্ষা/ইন্টারভিউ নিতে ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে বিশেষজ্ঞ আলেমদের নিয়ে আসা হলো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ইমাম প্রার্থীদের যাতায়ত, থাকা, খাওয়া নিজ নিজ দ্বায়িত্বে হলেও ইসলামী ফাউন্ডেশন এর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ আলেমদের সম্মানী, যাতায়ত, খাওয়া বাবদ বাজেট হলো ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। অবশেষে অনেক যাচাই বাছাইয়ের পর মসজিদের ইমামের বেতন মাত্র ঠিক হলো মাত্র ১৪ হাজার টাকা! দুই ঈদে এক মাসের সম পরিমান দুই বোনাস। ইমাম সাহেবের থাকার জন্য মসজিদের সিঁড়ির নিচে টয়লেট সংলগ্ন জানালা বিহীন একটা খুপরি ঘর। এই ঘরটা মূলত একটা স্টোর রুম। ইমাম সাহেবের খাওয়ার ব্যবস্থা মসজিদের সাথে এতিমখানা-মাদরাসার ছাত্র শিক্ষকদের সাথে।
এই মসজিদ-মাদরাসা-এতিমখানার আয়ের কিঞ্চিত বর্ণনা দেইঃ-
আয়ের নিয়মিত উৎস মুসুল্লীদের এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের দান খয়রাত এবং কোরবাণীর সময় পশু কোরবাণীর চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করা। মসজিদটি সম্পুর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং এলইডি লাইজ সজ্জিত হলেও জানালা বিহীন এতিমখানায় টিমটিম করে জ্বলা লাইট আর ক্লান্তিকর অবস্থায় ঘুরতেথাকা ফ্যান। মাসজিদের পায়খান প্রশ্রাবখানার ফ্লোরও অত্যাধুনিক টাইলস/মার্বেল পাথরে মোড়ানো। কিন্তু ইমাম সাহেবের থাকার রুমের কথা আগেই বলেছি।
গত ৩০ বছর যাবত আমি লক্ষ্য করছি- মসজিদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রগুলো ৩/৪ বছরের মাথায় বদল করা হয়। যা মসজিদের ফান্ড থেকে কেনা হয়না। সবই মসজিদের মুসুল্লীদের দান। তিন বছর আগে একজন ধনাঢ্য ব্যাক্তি একাই ১০ টন ক্যাপাসিটির ২৬ টা এসি দান করেছিলেন ইন্সটলেশন খরচ সহ। কিন্তু ঈমাম সাহেবে থাকার রুমে ২০ বছর পুরনো ফ্যান এখনো ঘেনর ঘেনর করে ঘুরছে। মসজিদের অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ৩/৪ বছর পর পর বদল করা হয়, প্রায় প্রতি বছর মসজিদের কার্পেট বদল করা হয় মুসুল্লীদের টাকায়। প্রতি দিন মুসুল্লীদের দানে দান বাক্সে হাজার টাকা এবং প্রতি জুম্মায় মসজিদে মুসুল্লীরা দান করেন গড়ে ৫০ হাজার টাকা। রমজান মাসে এই দাণের পরিমাণ দশ লক্ষাধিক টাকা। এরশাদ সরকার মসজিদের পানি ও বিদ্যুৎ বিল মাফ করে দিয়ে ছিলেন- সেই প্রথা এখনও বহাল আছে। তবে ইদানীং বিদ্যুৎ বিলের অর্ধেক মসজিদ কমিটিকে দেওয়ার নির্দেশনা চালু হয়েছে। এতো এতো সুবিধাদি এবং প্রাপ্তিতে মসজিদের ফান্ড কোটি কোটি টাকা হলেও (যদিও মসজিদ ফান্ডের হিসাব কমিটির প্রভাবশালী সদস্যরা ছাড়া অন্যরা জানেনা) ইমাম সাহেবের বেতন এবং সুযোগ সুবিধায় কোনো পরিবর্তন নেই।
এতিমখানার ছাত্রদের জন্য কোনোদিন চাল কিনতে হয়না। প্রতি মাসেই বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিরা যে চাল দান করেন তা মাদরাসা/এতিমদের উদ্ববৃত্ব থেকে যায়। অনেক সময় কেউ কেউ কার্টুন ভরা তেল, বস্তা বস্তা ডাল-আটা, চিনিও দান করেন। কোরবানীর সময় কোরবানীদাতারা যে পরিমাণ গোশত দান করেন- সেই গোস্ত অল্প অল্প করে সারা বছর এতিম ছাত্র শিক্ষকরা খায়। সামগ্রীক ভাবে এতিমখানার ছাত্র শিক্ষকদের খাবারের মান অত্যন্ত খারাপ।
অর্থাৎ মসজিদ কমিটির নির্দেশে ইমাম সাহেব মসজিদ-মাদরাসা
এতিমখানার জন্য যা কিছু চান- সাথে সাথে মুসুল্লীরা আলাদিনের চেরাগ নিয়ে সব চাহিদা পূরণ করেন। অল্প ব্যবহৃত পুরনো পণ্য (এসি, সাউন্ড সিস্টেম, কার্পেট ইত্যাদি) মসজিদ কমিটির কেউ কিম্বা তাদের বাছাই করা ব্যবসায়ী নাম মাত্র মূল্যে খরিদ করে নেন। মসজিদের ইমাম সাহেবের চাকরির স্থায়িত্ব নির্ভর করে কতটা আবেগ দিয়ে ওয়াজ নসিহত করে বেহেশতের লোভ দেখিয়ে মুসুল্লিদের মন গলিয়ে দান খয়রাত জোগাড় করতে পারে তার উপর।
আগের ইমাম সাহেব এই মসজিদে ২৮ বছর ইমামতী করে মারা গেলেন। ইমামের পরিবারের জন্য মসজিদ কমিটি কিছুই করলো না। তাঁর পরিবার কেমন আছে, সেই খোঁজ নেওয়ার জন্য কেউ যাননি।
দিনশেষে ইমাম সাহেব ও তার পরিবারের সদস্যরাও মানুষ! সমাজের অবহেলিত একদল মানুষ। এ জাতির কাছে ইমামরা অবহেলিত! এভাবেই ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ২০/২৫ হাজার টাকা বেতনে শেষ হবে ইমাম সাহেবদের ঈমামতীর জীবন। মসজিদ কমিটি তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করবে। এদিকে আবারও মসজিদে ইমাম নিয়োগের ঘোষণা হবে। কিন্তু ইমাম সাহেবদের আর্থিক অবস্থান বদলাবে না।
তাই মহান আল্লাহ জেনো সমস্ত মৃত এবং জীবিত ইমামদের পরিপূর্ণ মর্যাদা দান করেন, আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯