চিকিতসা সেবায় দেশের ধনাঢ্য ব্যাক্তিত্বদের অবদান।
গত বছর দুই দফায় ২৪ দিন স্কয়ার হস্পিটালে থাকতে হয়েছিল। ৩০ ডিসেম্বর ২০১১ থেকেই শারিরিক কিছু সমস্যা দেখাদেয়। যার জন্য আবার স্কয়ার হাসপাতালে যাই।অনেকগুলো “টেস্ট” করিয়ে অবশেষে হস্পিটাল নিবাসী হই ৫ দিনের জন্য। পূর্বাপর ঐ হস্পিটালে আসা যাওয়ারপথে বেশ কয়েকজন জীর্ণ শীর্ণ, হতদরিদ্র রোগীদের হস্পিটালের গেইটে দাড়াতে দেখি-চিকিতসার আশায়। ঐসব রোগীদের নিশ্চই জানা নেই-স্কয়ার নামক হস্পিটালের "সেবা" সব "সেবা প্রার্থী"র জন্য নয়! কৌতূহল বশতই আমি ঐ রোগীদের প্রতি লক্ষ রাখি। ফলাফল ঐ হতভাগ্য অসুস্থ্যরা হস্পিটালের নিরাপত্তা রক্ষীদের গলাধাক্কায় ১০০ফিট দূরত্বে রোডের উল্টাদিকে দাড়ানোরও সুযোগ পায়না!
এই হস্পিটালে আউটডোর চিকিতসা প্রার্থীদের সর্ব নিম্ন ফিস দিতে হয় ৮০০টাকা(কন্সাল্টেন্সী ফি কিম্বা অন্যান্য খরচাপাতি কেমন-তা না ই বল্লাম)! দেশ বিদেশের বহু নামী হাসপাতাল দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সর্বত্রই দেখেছি “ইমার্জেন্সী/ফার্স্ট এইড” চিকিতসার জন্য একটা ইউনিট থাকে। যেখানে দূর্ঘটনা জনিত রোগীদের প্রাথমিক চিকিতসা দেয়া হয়-প্রায় বিনে পয়শায়। কিন্তু এই হস্পিটালে বিনে পয়শায় কিছু নেই! এদেশের লক্ষ লক্ষ লোকের পক্ষেই ৮০০ টাকা বাতসরিক চিকিতসা ব্যায়ও সম্ভব হয়না। এমন অনেক রোগীই জানেননা-এই হস্পিটালের বিলাশী,রাক্ষুসী চিকিতসা খরচের কথা। তাই দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই এখানে চিকিতসার আশায় আসেন। কিন্তু কি আর্শ্চয্য! একটা সেবা প্রতিষ্ঠানের স্মার্ট নিরাপত্তা রক্ষীদের নূণ্যতম সৌজন্যতা নেই একটা অসুস্থ্য মানুষের প্রতি! দরিদ্র অসুস্থ্য রোগীদের শুধু টাকা নেই বলেই সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়াই শেষ কথা নয়-উপরি অপমান গলাধাক্কা!
দেশবাসী জানেন-স্কয়ার হস্পিটালের মালিক দেশের স্বনামধন্য একজন ব্যাবসায়ী-যিনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আদর্শ স্থানীয় একজন শিল্পপতি আমি নিজে অতি নগণ্য এক মানুষ হয়েও দেশ বরেণ্য এই শিল্পপতিকে অজস্র ব্যাবসায়ীদেরমত আমিও আদর্শ মানি, শ্রদ্ধা আর সম্মানে স্যালুট করি। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র শিল্পপতি যিনি ব্যাবসায়ীক জীবনে একদিনের জন্যও ব্যাংক লোন ডিফল্ডার নন। ইনিই অন্যতম শিল্পপতি যিনি শ্রমিক বান্ধব হিসেবে আন্তর্জাতিক ভাবে সুনাম অর্জন করেছেন।এই শিল্পপতি প্রায় ২৫ হাজার লোকের কর্ম সংস্থান করেছেন। গত ১০ বছর যাবত দেশের সর্বচ্চ আয়কর প্রদানকারী ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের গৌরব অর্জনের পাশাপাশি প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশীক মূদ্রায় রাস্ট্রীয় কোষাগার পূর্ণ করেছেন(সম্প্রতি ভ্যাট ফাঁকির একটা অভিযোগ স্কয়ার গ্রুপ সম্পর্কে আছে)। স্কয়ার গ্রুপের বাতসরিক টার্ণওভার ১০ হাজার কোটি টাকার উর্ধে! এত এত সাফল্যের পরেও জাতীয় ভাবে জনকল্যাণে চ্যারিটিমূলক কোনো প্রতিষ্ঠান করেননি স্কয়ার গ্রুপের মালিক পক্ষ। তারা নাকরেছেন একটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, নাকরেছেন দরিদ্র জনগনের জন্য একটি হস্পিটাল।যা কিছু করেছেন-সবই ব্যাবসায়ীক মনোবৃত্তিতে।
দূনিয়ার শীর্ষস্থানীয় দুই ধনী ব্যক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক মহতী কার্য্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী টাটা, বিড়লা গ্রুপসহ অসংখ্য ব্যাবসায়ী জনকল্যাণ তথা মানব সেবায় অসংখ্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল গড়ে মানবতা ও মানবিকতায় ইতিহাসে স্থান করে নিচ্ছেন। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, টাটা, বিড়লাদেরমত বিলিওনার আমাদের দেশে নাথাকলেও অন্তত জনা বিশেক ব্যাবসায়ী/শিল্পপতি আছেন-যাদের মিলিয়ন,বিলিয়ন টাকা আছে। প্রতি ডলার সর্বনিম্ন ৮০ টাকা হিসাবেও এক বিলিয়নে ৮০০০ কোটি টাকা হয়। ৮০০০ কোটি টাকার ধনসম্পদ আমাদের দেশের অন্তত ২০ জনের আছে বলে আমার ধারণা। কিন্তু সেই ৮০০০ কোটি টাকার মালিকদের কারোরই তেমনকোনো সামাজিক,মানবিক সেবামূলক অবদান নেই!
হাজী মূহম্মদ মহসীন, অশ্বিনী কুমার দত্ত, ব্রজ মোহন দত্ত, আনন্দ মোহন, ব্রজলাল দত্ত, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর পর পাকিস্তান আমলে আগাখান, আদমজী, দাউদ-ইস্পাহানী, বাওয়ানী ফাউন্ডেশন বিভিন্ন বৃত্তি দিত প্রতিবছর। সেইসব ধানাঢ্য ব্যাক্তিত্বরা বিভিন্ন নামের ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে এসব ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিক্ষা, সাহিত্য- সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করেছেন, বৃত্তি দিয়ে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশে আগাখান, আদমজী ইস্পাহানী, বাওয়ানীদের প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল এখনো চলছে। ঐ সময়ে বাঙালিদের মধ্যে আর পি সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী হাসপাতাল/মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দাণবীর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সেই আমলের শিক্ষানুরাগী করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীর করটিয়া সা’দত কলেজ এখনও আমাদের সামনে দৃস্টান্ত হয়ে আছে। স্বাধীনতার পর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সর্বজনাব ডাঃ ইব্রাহীম সাহেবের প্রচেস্টায় নির্মিত বাংলাদেশ ডায়বেটিক হাসপাতাল এবং সিরাজগঞ্জে খাজা এনায়েতপুরী হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ ছাড়া জাতীয়ভাবে পরিচিত আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করারমত নেই। যাও দুএকটি আছে তা সরকারী তথা জনগনের ট্যাক্সের টাকায় গড়া হলেও পিছনে ক্ষমতাকেন্দ্রীক নামকরন ও রাজনৈতিক দূর্বিসন্ধি হাসিলের চেস্টা ভিন্ন অন্যকিছু নয়! প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর শত কোটি টাকা স্কুল-কলেজের গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি এবং চিকিতসা সেবায় দিয়ে আসছে। কিন্তু পোশাকশিল্পে হঠাৎ রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়া মানুষগুলো এককভাবে বা সামগ্রিকভাবে কোথাও কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করছেন বলে দেখিনি। দেখিনি বেক্সিমকো’র সালমান এফ রহমান,ইউনিক গ্রুপের নূর আলী, যমুনা গ্রুপের নূরুল ইসলাম বাবুল,বসুন্ধরা গ্রুপের শাহ আলম,ট্রান্সকম’র লতিফুর রহমান, ওপেক্স গ্রুপের ক্যাপ্টেন সিনহা,প্রান গ্রুপের মেঃজেঃ আমজাদ খান চৌধূরীসহ এমন আরো অন্তত ২০টি বিখ্যাত গ্রুপের মালিকদের কোনো চ্যারিটি ট্রাস্ট করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেক্টরে জনসেবা করতে!
কয়েকমাস আগে ব্যাবসায়ীক কাজে গিয়েছিলাম পাকিস্তান। লাহোরেগিয়ে দেখেছিলাম-শওকাত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার। ক্রিকেটার ইমরান খানের মা শওকাত খানম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর তিনি তৈরি করেন পাকিস্তানের একমাত্র বিশ্বমানের এই ক্যান্সার হাসপাতালটি। আমি নিজে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে দেশ বিদেশের অনেক ক্যান্সার হাসপাতাল ও ক্যান্সার চিকিতসকদের সম্পর্কে জানতে কৌতুহলী হই। পাকিস্তান গিয়ে ইমরান খানের প্রতিষ্ঠিত সেই হাসপাতাল সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে।
১৯৮৯ সালে লাহোরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট ম্যাচের পর তিনি দর্শকদের কাছে এ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠায় তহবিলের জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনে সারা দিয়ে দর্শকগন ইমরানের হাতে তুলেদিয়েছিলেন ২৯,০২,৬০০ রুপি। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তহবিল সংগ্রহের জন্য তিনি অর্ধশত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করলে নিজের প্রাইজ মানি হিসেবে পাওয়া প্রায় ১ কোটি রুপির সবটাই তিনি এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেন। নির্মাণ কাজ শুরু করে অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি পাকিস্তানের ২৭টি শহরে প্রচারাভিযান চালান এবং প্রায় ১২ কোটি রুপি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তার এ মহতী কর্মে দরিদ্র থেকে বিত্তশালী প্রায় ১০ লাখ লোক শরিক হন। ১৯৯১ সালের এপ্রিলে এই হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয় আর চালু হয় ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে। এক জাহার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এই ক্যান্সার হাসপাতাল। পাকিস্তানের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এবং অনেক বিদেশীরাও এখানে ক্যান্সারের সর্বাধুনিক চিকিত্সা পাচ্ছেন। এখানে চিকিত্সা নিতে আসা রোগীদের প্রায় ৭৫ ভাগই আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে।
হাসপাতালের একটি বুকলেট সংগ্রহ করতে যাই-যা বিনে পয়শায় দেয়া হয়। কিন্তু কেউ ঐ বুকলেট নিয়ে যেকোনো পরিমান টাকাদিলে তা মুল্য/দান হিসেবে মানি রিসিট দিয়ে গ্রহন করা হয়। সেই টাকা হাসপাতাল ফান্ডে জমা হয়। আমি ১০০ রুপীদিয়ে বুকলেট নেই(একজন বাংলাদশীর একশত টাকা দানের প্রমান ঐ হাসপাতাল ইতিহাসে লেখা থাকবে)।
বুকলেট পড়ে জানতে পারি-বাতসরিক বুলেটিনের মাধ্যমে এই হাসপাতালের যাবতীয় আয়-ব্যায় অডিট রিপোর্ট সকলের জন্য প্রদর্শিত হয়। ২০১০ সালের হিসাবে দেখা যায়, ঐ বছর হাসপাতালটির চিকিত্সাসেবা, জাকাত, অনুদানসহ বিভিন্ন খাত থেকে আয় হয়েছে ৩০১ কোটি রুপি এবং বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ২৮৮ কোটি রুপি। ১৫০টি ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্টান্ডার্ড ওয়েল ইকুইপ্ট(পুর্নাংগ) শয্যাসহ মোট ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে ২০১০ সালে ভর্তি হয়েছেন ৬৭৮৫ জন রোগী। এ সময় বহির্বিভাগে চিকিত্সা নিয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজার ১৬৫ জন রোগী। এর মধ্যে কেমোথেরাপি নিয়েছেন ২৭,৫৮৮ জন, রেডিয়েশন ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন ৪২,৮৮৮ জন, সার্জিক্যাল প্রসিডিওর ৬১০৯ জন। এছাড়া এখানে প্যাথলজি টেস্ট হয়েছে ২৮ লাখ ৫২ হাজার ৩৪৭টি এবং ইমেজিং স্টাডিজ ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৭৭টি। বর্তমানে অ্যানেসথিসিওলজি, ক্লিনিক্যাল রেডিওলজি, মেডিকেল অনকোলজি, ইন্টারন্যাল মেডিসিন,প্যাথলজি, পেডিয়াট্রিক অনকোলজি, ফার্মাসি, রেডিয়েশন অনকোলজি এবং সার্জিক্যাল অনকোলজি সেবা রয়েছে এই হাসপাতালে।
অলাভজনক এ হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিত্সা দেয়া হয়। হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন ৭/ ৮শত রোগী চিকিত্সা নিচ্ছেন মাত্র ৫ রুপীর একটি টিকেট কেটে।
ইমরান খানেরমত আমাদের দেশীয় সেলিব্রিটিরা এবং বিত্তবানেরা যদি মানবকল্যাণে এমন নিবেদিতপ্রাণ হতে পারেন, তবে দেশ ও সমাজের বহু সমস্যাই মোকাবেলা করা যায়। প্রয়োজন শুধু সৎ নেতৃত্বের উদ্যোগ ও আন্তরিকতার। সাধারণ মানুষ যোগ্য নেতৃত্ব পেলেই এগিয়ে আসবেন। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশেও এ ধরনের সফল অধ্যায় আমরা দেখতে আগ্রহী।
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আমেরিকায় চিকিতসাধীন। তিনি যে হস্পিটালে চিকিতসাধীন-সেই হস্পিটালও দুইজন দানশীল ব্যাক্তিত্বের দানে প্রতিষ্ঠিত। হুমায়ুন আহমেদ ঘোষনা দিয়েছেন-তিনিও একটি ক্যান্সার হাসপাতাল করতে চান সকলের সহযোগীতায়। আমাদের প্রত্যাশা তিনি অবশ্যই সেই উদ্যোগ নিবেন এবং সফল হবেন।