ঢাকা-কলকাতা ভ্রমনের তিক্ত অভিজ্ঞতা
আমাদের বড় ছেলে এসএসসি সমমান পর্যন্ত দিল্লির অদূরে নৈনিতাল কনভেন্ট স্কুলের ছাত্রছিল। ঐ স্কুলের দ্বিশত প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদ্বযাপন উপলক্ষে স্কুলের প্রাক্তন স্টুডেন্ট এবং অবিভাবকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল-যার জন্য ছেলে ছুটি নেয়। সিদ্ধান্ত নিলাম এই সুযোগে আমরা ভারতে যাব এবং সম্ভব অনেকের সাথে দেখা সাক্ষাত করবো। আমরা ভারতে গিয়েছিলাম-কিন্তু ঢাকা কলকাতা আসা যাওয়ার বিড়ম্বনার কথা পাঠকদের সাথে শেয়ার করতেই এই লেখা।
ভিসা সমস্যার কথা বলি। যথা নিয়মে প্রয়োজনীয় সকল ডকুমেন্টস সহ ভারতীয় দুতাবাসে অন লাইনে আবেদন করি।সকল ফরমালিটিজ সম্পন্ন হলে আমাদের পাসপোর্ট/ভিসা ডেলিভারী টোকেন দেয়া হয়। কলকাতা-দিল্লি-নৈনিতালস্থ বন্ধুদের জানিয়েদেই-আমাদের ভারতে যাওয়ার সেডিউল। নির্ধারিত তারিখে পাসপোর্টে হাতে পেয়ে আক্কেল গুড়ুম! আমাদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয় কোনো কারন নাদেখিয়েই!
আমার পাসপোর্টে আমেরিকা-বৃটিশ, চায়নীজ, সিংগাপুরের মাল্টিপল ভিসা আছে। গত একবছরে চায়না, জার্মানী, সিংগাপুর ভ্রমন করেছি এবং মাত্র দুই মাস পূর্বে আমেরিকা-ইংল্যান্ড এবং একমাস আগে উজবেকিস্তান, সাউথ আফ্রিকা বেড়িয়ে এসেছি। গত ৩০ বছরে আমি অন্তত ৫০ বার ইন্ডিয়া ভিজিট করেছি। আমার স্ত্রী বছর কয়েক আগে ৩/৪ মাসের জন্য একাধিকবার দিল্লি ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে পড়িয়েছেন, একাধিকবার ভারতসহ ইয়োরোপের অনেকদেশ ভ্রমন করেছেন। আমার বড় ছেলে চাকুরীর সুবাদে বর্তমানে বৃটিশ, হল্যান্ড ও হংকং এর মাল্টিপল ভিসার অধিকারী। আমাদের ছোট ছেলেও বহুবার আমেরিকা-ইংল্যান্ড,জার্মানী, মালয়েশিয়া, চায়না, হংকং ভ্রমন করেছে-যার প্রমান সংযুক্ত পাসপোর্টেই আছে।
ইন্ডিয়া আমাকে যেতেই হবে-তা নয়। কিন্তু কোনো কারন নাদেখিয়ে ভিসা প্রত্যাখ্যাত হওয়া খুবই অপমান জনক! বাধ্য হয়ে আমি আমার ব্যাবসায়ীক পরিচয়ে ভারতীয় দূতাবাসের কমার্স সেক্রেটারীর সাথে দেখা করে বিস্তারিত জানাই। তিনি পূনরায় যথা নিয়মে ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমাদিয়ে তাকে টোকেন নম্বর জানাতে বলেন। আমরা তাই করি। আবারো ফ্যাসাদ! নির্দিস্ট দিনে দু’জন ভিসা পাই,ছোট ছেলের পাসপোর্ট ২ দিন পর আর বড় ছেলের পাসপোর্ট আরো ৪ দিন পর দেয়া হবে জানিয়ে ডেলিভারী টোকেনে তারিখ পূণঃনির্ধারন করে দেয়া হয়! উল্লেখ্য, দুনিয়া ব্যাপী আমরা চারজনই 'ডাবল এন্ট্রি ভিসা' পেলেও ভারতীয় দূতাবাস আমাদের ৩ জনকে দেয় 'সিংগেল এন্ট্রি ভিসা'!
এবার শুরু হোক ভ্রমন কাহিনীঃ-
ব্যাবসায়ীক জীবনে সব সময়ই ভারত যাতায়াত করেছি বিমান পথে। ছোট ছেলের ইচ্ছায় এবার সিদ্ধান্ত নেই ট্রেনে কোলকাতা পর্যন্ত যাবো-এবং কোলকাতায় একদিন যাত্রা বিরতি দিয়ে পর দিন '‘রাজধানী এক্সপ্রেস'’এ দিল্লি যাবো। সেমতেই কলকাতার বন্ধু মিঃ মুন্ড্রা কলকাতা-দিল্লিতে হোটেল, ট্রেন রিজার্ভেশন করে রাখেন। ইচ্ছেছিল দিল্লি থেকে বাই এয়ার ঢাকা ফিরবো। কিন্তু বাই এয়ার ফিরে আসার আশা বাতিল হয়ে যায় ‘সিংগেল এন্ট্রি’ ভিসার জন্য।
২০০৮ সনের ৮ এপ্রিল "‘মৈত্রী এক্সপ্রেস"’ নামে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার সরাসরি ট্রেন চালু হয়। আগেই জানতাম ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ ছাড়ে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে। বুকিং দেয়ার জন্যে যাত্রার ৫ দিন আগেই লোক পাঠাই স্টেশনে কিন্তু ৩ দিনের বেশী আগাম বুকিং দেয়ার কোনো সিস্টেম নেই মৈত্রী এক্সপ্রেসে। তাও আবার টিকিট কাটতে হবে কমলাপুর থেকে। কমলাপুর স্টেশনের এক কোণে পাওয়া যায় ‘"আন্তর্জাতিক টিকেট কাউন্টার" নামক কাঁচা হাতে বল পেনে বাংলায় সাদা কাগজে লেখা সাইন বোর্ড। কাউন্টার থেকে জানানো হয়-টিকেট ক্রয়ের জন্যে অবশ্যই আগাম প্রয়োজন ভারতীয় ভিসার। শুধু পাসপোর্ট-ভিসাই যথেষ্ট নয়,টিকেট ক্রয়ের জন্যে নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে হবে যাত্রীকে স্বয়ং।
অবশেষে ফর্ম পূরণ করে যাত্রীপ্রতি ১৯১০/- টাকায় প্রথম শ্রেনীর টিকেট কিনি। যেহেতু অজ্ঞাত কারনে বড় ছেলের ভিসা পাবো যাত্রার দিন-তাই ওর পাসপোর্ট নম্বরের ভিত্তিতে আরেকটি টিকেট ইস্যু করার জন্য অনূরোধ জানাই। কিন্তু কঠোর আইনে’র কারণে কিছুতেই টিকেট ইস্যু করতে রাজি হলেন না ইস্যু ক্লার্ক মহোদয়,যদিও ইস্যুকৃত টিকেটের কোথাও ভিসা নম্বর কিংবা এই সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। যাত্রার দিন বিকেল সাড়ে চারটায় পাওয়া গেলো বড় ছেলের ভিসাসহ পাসপোর্ট। কিন্তু কমলাপুরের ‘আন্তর্জাতিক টিকেট কাউন্টার’ বন্ধ হওয়ার সময় হচ্ছে ‘বিকেল ৫টা’। যানজটপূর্ণ ঢাকার গুলশান ভারতীয় দূতাবাস থেকে কমলাপুরে ৩০ মিনিটে পৌঁছানো অসম্ভব। অতএব একই পরিবারের ৪ যাত্রীর ৩ জন ট্রেনে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ‘"যাত্রী-অবান্ধব"’ নীতিমালার কারণে বড় ছেলে বিমানে কলকাতা যায় অতিরিক্ত টাকা খরচ করে।
সকাল ৭:১৫ মিনিটে ট্রেন ছাড়ার কথা থাকলেও ৭:৪৫ মিনিটে যাত্রা করলো। কারণ ৭:১৫ হচ্ছে কমলাপুরের টাইম,মানে ট্রেন ঢাকা ক্যান্ট. থেকে ছাড়লেও সময় দেখানো হয়েছে কমলাপুর থেকে ছাড়ার! অবশেষে ২৩৬ আসনের ট্রেনটি মাত্র ৬০ জন যাত্রী নিয়ে যাত্রা করলো কলকাতার উদ্দেশ্যে। ১০ মিনিট চলার পর টঙ্গীর কাছে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ হিসেবে গার্ড জানালেন ‘'নোয়াখালী লোকাল’'কে পাস দিতে ‘মৈত্রী’ ট্রেনটি দাঁড়িয়ে আছে। মানে আন্তর্জাতিক একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে,লোকাল একটি ট্রেনকে ‘অগ্রাধিকার’ দিতে। পথে পথে নানা স্থানে আরো বেশ ক’বার ট্রেনটি থামে একই কারণে। ঈশ্বরদি গিয়ে ১০-১৫ মিনিট থেমে থাকে ট্রেনটি "‘তেল/পানি"’ নেয়ার জন্যে,যদিও সেখান থেকে কোনো যাত্রী উঠতে কিংবা নামতে দেয়া হয় না। অবশেষে দর্শনা পৌঁছলে সকল যাত্রীকে সঙ্গে থাকা সব মালপত্র নিয়ে নামতে হয় কাস্টম চেকিংয়ের জন্যে,যদিও ট্রেনে ওঠার আগেই মালপত্র স্কানিং করে ট্রেনে তোলা হয়েছিল। ট্রেনটি প্লাটফর্মের চেয়ে বেশ উঁচু হওয়ার কারণে যাত্রীদের নিজ উদ্যোগে মালপত্র নিয়ে কাস্টম হলে গিয়ে ‘চেকিং’ করিয়ে আবার ট্রেনে ওঠা খুবই বিরক্তিকর ও ঝামেলাপূর্ণ।
বাংলাদেশ বিড়ম্বনা পর্বের পর শুরু হয় ভারত বিড়ম্বনা পর্ব। ট্রেনটি বিশাল খাঁচার ভেতর দিয়ে ভারত তথা ‘"গেদে"’ স্টেশনে প্রবেশ করে। গেদে-তে ইমিগ্রেশন শেষে সব যাত্রীকে ভারতীয় কাস্টমের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়,জবাব দিতে হয় নানাবিধ প্রশ্নের। পরীক্ষা পাসের পর সব যাত্রীদের গেদের একটি কক্ষে যুক্তিহীন কারণে গাদাগাদি করে ২ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় ট্রেনটি 'ছাড়ার ‘টাইম'’ হওয়ার জন্যে-অথচ স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনেই আমরা উঠে আড়ামে অপেক্ষা করতে পারতাম। ইমিগ্রেশন-কাস্টম শেষ হলেও কোনো যাত্রীই ‘গেদে’ থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যেতে পারে না-সেই যাত্রীর গন্তব্য গেদে কিংবা এর কাছাকাছি হলেও,তাকে কমপক্ষে ১১৮ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কলকাতা চিত্পুর স্টেশনে নেমে আবার ফিরে আসতে হয় অন্য উপায়ে!
দিল্লি থেকে আবার ফিরে আসি কলকাতা। কলকাতা থেকে ট্রেনে ঢাকা ফেরার টিকেট কিনতে যাই ‘"ফেয়ারলি প্যালেস/হাউস"’। কাউন্টারের ভদ্রমহিলা ডাউশ সাইজের ইংরেজি-হিন্দি বাই ল্যাঙ্গুয়াল ফর্ম পূরণ করতে বলেন যথারীতি প্যাসেঞ্জারের স্বাক্ষরসহ। ৪টি ফরম পূরণ করে যাত্রীর স্বাক্ষর হোটেল থেকে করিয়ে পাসপোর্টসহ জমা দিলে কাউন্টার থেকে জানানো হয়,টিকেট ক্রয়ের জন্যে ৪ যাত্রীর সশরীরে উপস্থিতি কিংবা ‘'লেটার অব অথরিটি' লাগবে টিকেট কেনার জন্যে,মানে কলকাতার “"হয়রানী কুআইন”" ঢাকার চেয়ে এক ডিগ্রি ওপরে। একটি কুপে ৪-৬টি সিট থাকলেও,হয়রানিমূলকভাবে ৪টি সিট দেয়া হয় দুটো বগীর ৩টি কুপে! অনেকক্ষণ খ্যাচাখ্যেচি করেও টিকেট চেঞ্জ করে একত্রে বসার টিকেট পাইনি।
ঢাকা থেকে প্রথম শ্রেনীর ভাড়া ১৯১০/- টাকা হলেও,ভারতীয় মুদ্রায় ভাড়া নেয়া হয় ৮৬৮ টাকা,যা বাংলাদেশি ১১০০/- টাকারমত। একই ট্রেনে দু’দেশে দু’ রকম ভাড়া! ৭টা ১০-এ ‘ডিপারচার’ টাইম থাকাতে সাড়ে ছয়টায় কলকাতা স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন কোথায় জানতে চাইলে ট্রেনের এক পাতি কর্তা আঙুল উঁচিয়ে দেখায়- প্রায় ১ কিলোমিটার দূরের ট্রেনকে,যদিও প্রবেশ মুখেই প্লাটফরম খালি। যাত্রীরা তাদের ভারী লাগেজপত্র নিজে কিম্বা মাস্তান কূলিদের দ্বারা নিতে বাধ্য ১ কিঃমিঃ দূরের ঢাকাগামী ট্রেনের উদ্দেশে। স্কানিং ও সিকিউরিটি চেক শেষে মালপত্রসহ ট্রেনে ওঠার পর প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখি- ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা মাত্র ৪৫ জন! আমরা শুয়ে বসে সেই ‘গেদে’ পৌঁছে পরতে হয় আরেক পরীক্ষায়। বড় ছেলে বিমানে গিয়ে ট্রেনে আমাদের সহযাত্রী হওয়াতে ‘গেদে’র ইমিগ্রেশন অফিসার এটিকে ‘মারাত্মক অনিয়ম’ হিসেবে গণ্য করলেন-যদিও ওর ডাবল এন্ট্রি ভিসা। ইমিগ্রেশন অফিসারটি অনেক্ষণ ছোটাছুটি, কাঁইকুঁই করে সুবিধা করতে নাপেরে অন্যদিকে তাকিয়ে সীল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দেয়। আবার গেদে স্টেশনে ২ ঘণ্টা অপেক্ষা। এভাবে বিড়ম্বনার ক্রমানুসারে গেদে,দর্শনা,ঈশ্বরদির পর ‘আন্তর্জাতিক ট্রেনটি’র যাত্রীরা রাতের ‘ভুতুড়ে’ অন্ধকারে’(লোডশেডিং) ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছেন।
আমি মনেকরি-এই মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে ‘যাত্রীবান্ধব’ করা কোনো কঠিন কাজ না। টিকেট বিক্রির জন্যে পাসপোর্ট-ভিসার বাধ্যবাধকতা সম্পুর্ণ অযৌক্তিক। কোনো যাত্রী যদি টিকেট ক্রয়ের পর ভিসা জটিলতায় না যেতে পারে সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট টাকা কেটে রেখে বাকি টাকা ফেরত দিলেই আগাম টিকেট দেয়া যৌক্তিক। তা ছাড়া ‘ওপেন টিকেট’ কিংবা যাত্রার পূর্ব মূহূর্তে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে তাত্ক্ষণিক টিকেট ইস্যু করা খুবই সহজ। স্কানিং করে মালপত্র তোলার পর তা চেকিং-এর নামে পুনরায় দর্শনা বা গেদে-তে নামানোর যৌক্তিকতা কী? প্রয়োজনে বিমানের মতো যাত্রীদের ‘লাগেজ’ টোকেন দিয়ে আলাদা করে ‘গুডস ভ্যানে’ রাখা যেতে পারে। ইচ্ছে থাকলে সহজেই হতে পারে ট্রেনের ভেতরে ‘চলমান ইমিগ্রেশন’ ও চেকিং। আর ইমিগ্রেশন যেহেতু বাংলাদেশে ও ভারতের শেষ স্টেশন অর্থাত দর্শনা ও গেদে-তে হচ্ছে,তাহলে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল,ঈশ্বরদি থেকে যাত্রী উঠলে কিংবা টাঙ্গাইল-ঈশ্বরদির যাত্রীকে ঢাকা স্টেশনে এনে পুনরায় ঈশ্বরদি পাঠানো কোন্ যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য? বরং ঈশ্বরদি, সিরাজগঞ্জের যাত্রীদের ঢাকা পর্যন্ত টেনে নাএনে পথেই ওদের ড্রপ করার উদ্যোগ নিলে যাত্রী বান্ধব হবে। একই যুক্তি ভারতের বিভিন্ন স্টেশনের যাত্রীদের জন্যেও।