আমাদের জাতীয় জীবনে একুশের প্রেরণা
ভাষা আন্দলনের মাস ফেব্রুয়ারী।এই মাসটাকে আমরা প্রধানত পালন করি(মুলত উদ্বজ্জাপন করি) শুধু মাত্র বইমেলা এবং একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমেই। এখানেই এখন বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর ব্যাবসায়ীক আধিপত্তবিস্তারের একটা মওকা! এই মাসজুড়েই সামু ব্লগেই অনেক তথ্যমুলক লেখার সাথে পুরোনো গতানুগতিক লেখাও ছিল।ব্লগার আসীফ মহিউদ্দীন ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগম সম্পর্কে বিস্তারিত একটি পোস্ট লিখে পাঠকদের ভাষা আন্দোলনের নারীদের অংশ গ্রহনে নতুন একমাত্রা উপস্থাপন করেছেন।যদিও ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগম সম্পর্কে আমরা আগেও অল্প বিস্তর জেনেছি। যেসময়ে ভাষা আন্দোলনে নতুন নতুন "ভাষা সৈনিক"দের আবির্ভাব ঘটছে সেখানে আসিফ মহিউদ্দীনের পোস্টিটি অবশ্যই সময়ের দাবী পুরনে সহায়ক হয়েছে।
ভাষা আন্দোলন শুধুই যে ভাষার অধিকার আদায়ের স্বীকৃতি থেকে বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় জীবনে প্রতিটা সংগ্রাম আর স্বাধীকার আন্দোলনের প্রেরণা হয়েছে-আমি সেই দিকে একটু আলোচলা করতে চাই।
ভাষার মাস মানেই ফেব্রুয়ারী। ফেব্রুয়ারী মানেই "একুশ'। আর 'একুশ' বলতে আমরা বুঝি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের কথা। এ আন্দোলন ছিল এই জাতির গর্ব। কারণ পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন এ জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে, সাহস যুগিয়েছে, ধাবিত করেছে বৃহত্তর অর্জনের দিকে। ভাষা আন্দোলনের অপরিসীম অবদানের কথা আমাদের জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমাদের জাতিসত্তার বিকাশের মূলে নিহিত রয়েছে একুশের চেতনা। বাংলাভাষার আন্দোলন বাঙালি জাতি গঠনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে। এবং ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমাদের জাতি ইতিহাস ধীরে-ধীরে অগ্রসর হয়েছে। যার ফসল আমাদের স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
একুশের আন্দোলন এক গৌরবের উপাখ্যান। এর প্রেরণা সৃষ্টির ধ্বংসের নয়। এর প্রেরণা নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির বিকাশের প্রেরণা। এর প্রেরণা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার প্রেরণা। সর্বোপরি একুশের প্রেরণা অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের দাবিতে আন্দোলন ও বিক্ষোভের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতিদানের জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৭ সালের ভারত বিজ্ঞপ্তি এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয়ের কিছু সময় পরেই সূচনা হয় এ আন্দোলনের। উর্দুকে নব প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়া ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তৎকালীন পাকিস্তানে বাংলাভাষী মানুষ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর উপর ভিন্ন একটি ভাষা চাপিয়ে দেয়া এ দেশের অগ্রসরমান তরুণ ছাত্রসমাজ মেনে নিতে পারেনি। বস্তুত বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দান তারা সমীচীন বলে মনে করে। তাই তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলে। পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছরের মধ্যেই তথা ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ক্রমান্বয়ে এই দাবি ব্যাপকতা লাভ করে।
১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই সংগ্রামকে তীব্রতর করে এবং সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে তদানীন্তন সরকারের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে মিছিল বের করে। মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। বরকত, সালাম, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বাংলা ভাষা ভিত্তিক একটি জাতীয় রাষ্ট্র উত্থানের বীজ বপন করা হয়। বস্তুতপক্ষে ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে, আমাদের সকল কর্মকাণ্ডে, আন্দোলনে, সংগ্রামে, সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অশেষ প্রেরণা যুগিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও প্রেরণা যোগাবে। এটি একটি মহান আন্দোলন- যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারণের জন্য। ভাষা আন্দোলনের সাফল্য পরবর্তীকালে আমাদের জাতীয় জীবনে এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিল।
পৃথিবীতে ভাষার জন্য কোনো জনগোষ্ঠীর আত্মত্যাগের এমন উদাহরণ সত্যিই বিরল। এ আন্দোলন শিক্ষা দেয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে। এ আন্দোলন প্রেরণা যোগায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বিপ্লবের। এ আন্দোলন উৎসাহ যোগায় মাথা নত না করবার। একুশের চেতনা সাহস যুগিয়েছে এ জাতির স্বাধিকার আন্দোলনে; সাহস যুগিয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে; প্রেরণা যুগিয়েছে স্বাধীনতার আন্দোলনে; প্রেরণা দিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়।
আমাদের জাতির সমসাময়িক কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে আমাদের যা কিছু মহান অর্জন তার পিছনে কাজ করেছে যে অদৃশ্য শক্তি তা ছিল একুশের চেতনা এবং একুশেরই অনুপ্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের দু’বছর পরেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ এবং মুসলিম লীগের পরাজয় একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ যে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল সেই মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয়-সাত বছরের মধ্যেই শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। এর প্রধান কারণ এ অঞ্চলের মানুষ মুসলিম লীগকে পাকিস্তানি শাসক এবং শোষক শ্রেণীর এবং উর্দু ভাষার স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে। তাই তারা এর বিরোধী শক্তি যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দান করে। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটিও এখানে গুরুত্ব লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণা এ নির্বাচনকে প্রভাবিত করে।
পাকিস্তানের শাসকচক্র তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে বিমাতাসুলভ ব্যবহার শুরু করে। কেন্দ্রে কোয়ালিশন শাসক দলগুলোর চক্রান্তের কারণে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভিত একেবারে নড়বড়ে হয়ে ওঠে। ঘন ঘন সরকার বদল এবং এর উত্থান-পতন ও স্বার্থান্বেষী দলগুলোর হানাহানির সুযোগ নিয়ে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। তারপর ইস্কান্দার মীর্জাকে অপসারিত করে নিজেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। সারা পাকিস্তানে কায়েম করেন স্বৈরতন্ত্র। তার দীর্ঘ দশ বছরের স্বৈরশাসনের মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার হরণ। পশিম পাকিস্তানীরা ছলে বলে কৌশলে দমন নীতি চালু করে এবং সকল ন্যায্য অধিকার থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে বঞ্চিত করে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সকল সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার করে এক সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তান গড়ে তোলাই ছিল আইয়ুব শাহীর মূল লক্ষ্য। আইয়ুব শাসনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদমুখর হয় পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ। প্রতিবাদ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ সহজেই অনুমেয় যে এই ছাত্রসমাজ ছিল ভাষা আন্দোলনের উত্তরসুরী। বাষট্টির শেষভাগে এই আন্দোলন তীব্রতর হয় এবং সমগ্র ষাটের দশকে এ আন্দোল, সংগ্রামের বিস্তার ঘটে। আমি মনে করি বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, যা গণ-আন্দোলনের রূপান্তরিত হয়, তারও মূলে ছিল একুশের প্রেরণা।
ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে তথা সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চাকে নিরুৎসাহিত করতে চেষ্টা চালানো হয়। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পরিবর্তে আইয়ুব খান পাকিস্তানি সব ভাষার সমন্বয়ে "লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্ক" উদ্ভাবনের প্রস্তাব দেয়ারও চেষ্টা করেন। এই ধরনের অদ্ভুত এবং আকস্মিক পরিকল্পনা এদেশের মানুষকে ব্যথিত করে। পাকিস্তানী শাসকদের ধারণা ছিল যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতি থেকে সরিয়ে আনতে পারলেই এদেশের বাঙালিকে খাটি পাকিস্তানি বানাতে পারবে। সেই পরিকল্পনার মূলছিল এ ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আসলে পাকিস্তানী আইয়ুব শাসকগোষ্ঠী ছিল অদূরদর্শী। বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাত হানতে গিয়ে তারা একে করে দিল আরো গতিশীল। ভাষা এবং সংস্কৃতির আন্দোলন হলো আরো মজবুত ও বলিষ্ঠ। বলাবাহূল্য, এ আন্দোলনের মূলে ছিল একুশের চেতনা।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, একুশ আমাদের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, উনসত্তরে গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূলে ছিল ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতি শোষণ, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত হয়। নয় মাসব্যাপী এ মুক্তিযুদ্ধে শ্রেণী বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শরিক হয়। মুক্তি পাগল বাঙালি জাতি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ভীতু বাঙালি বীর বাঙালিতে পরিণত হয়। সশস্ত্র এই সংগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙালি জীবন বিসর্জন দেন। স্বাধীনতার জন্য এত বিশাল আত্মত্যাগের কাহিনী মানব ইতিহাসে বিরল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা ফরাসি বিপ্লবের চেয়েও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ত্যাগ তিতিক্ষার আরো বড় উদাহরণ। এ আমাদের জাতির এক গৌরবময় উপাখ্যান- আমাদের জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের সফলতা আমাদের আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমি মনে করি, ভাষা আন্দোলনের চেতনা এবং অনুপ্রেরণাই আমাদের টেনে এনেছে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মুক্তি সংগ্রামে।
একাত্তর পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে, একুশ এখনও এই জাতিকে প্রেরণা যুগিয়ে চলেছে। আমাদের বিভিন্ন অর্জনের ক্ষেত্রে এর প্রমাণ মেলে। অনেকে হয়তো মনে করেন শুধু আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই একুশের চেতনা সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমি মনে করি, একুশের চেতনা আরো অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত। বস্তুতপক্ষে, একুশের চেতনা জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে নিহিত রয়েছে। জাতীয় জীবনের প্রতিটি অর্জনকে এটি অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা আশা করতে পারি যে- আমাদের সাহিত্যে, কাব্যে, সংগীতে, চিত্রকলাসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গে এর অনুপ্রেরণা আরো মূর্ত হয়ে ধরা দেবে এবং যুগ যুগ ধরে আমাদের জাতি ভবিষ্যত চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে।
(এই পোস্ট লিখতে আমি শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর এর লেখা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং এম,এ বার্ণিক এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বই থেকে বিভিন্ন তথ্য উপাত্য সংগ্রহ করেছি)