পথশিশুদের ব্যাংকঃ
পথশিশুদের ব্যাংক-এটা আবার কি? পাঠকের মনে এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। আমরা যাদের টোকাই বলে দূরে ঠেলে দেই এমন হাজারো সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা মিলে এই নগরীতে প্রতিষ্ঠা করেছে "শিশু উন্নয়ন ব্যাংক" নামক তাদের একটি স্বপ্নের ব্যাংক। এই ব্যাংকের লেনদেন এখন কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এই নগরীতে এই ব্যাংকের রয়েছে ১২টি শাখা। এই ব্যাংকের ম্যানেজার, জিএম, এজিএম-সবাই পথশিশু। বয়স ১০-১৬ বছর।
পথশিশুদের ব্যাংক মালিকও পথশিশুরাই। পথশিশুরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় বিভিন্নভাবে। কেউ বাবা-মার সাথে ঝগড়া করে, কেউ সৎ মার অত্যাচারে, কেউ অভাবে পড়ে। এই নগরীতে এসে প্রথমে আশ্রয় নেয় ফুটপাত, বাস স্টেশন, লঞ্চ স্টেশন, রেল স্টেশনে। তারপর শুরু করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এই জীবন সংগ্রামে এসব পথশিশুরা আয়ের জন্য শুরু করে হকারি, কুলিগিরি, আড়ৎ-এর কাজ, কাগজ বা বোতল কুড়ানোসহ নানা কাজ। কঠোর পরিশ্রমে আয় করা সঞ্চয় নিরাপদে রাখা হয় আরও কঠিন। পথশিশুদের এই নগরীতে আত্মীয়-স্বজন নেই বলে তাদের ঠকাতেও কেউ ভয় করে না। পথশিশুরা নিজেদের সঞ্চিত টাকা সাথে নিয়েই ঘুরে বেড়ায়। রাতের আঁধারে অনেক পথশিশুর টাকা চুরি হয়ে যায়। ছিনতাইকারী, নেশাখোর, নিপীড়িত ভাষমান পতিতাদের দালাল, এমন কি টহল পুলিশও অনেক সময় হাতিয়ে নেয় তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয়।
আমাদের ছয় বন্ধুর আর্থীক সহয়তায় গড়া "আপরুটেড চাইল্ড রিহেবিলিটেশন ফাউন্ডেশন"। ২০০১ সন থেকে আমরা কাওরান বাজারের পথশিশুদের সপ্তাহে চার দিন একবেলা করে খাবার এবং নাইট স্কুলে অবৈতনিক শিক্ষা দানের সুযোগ করেদিয়েছিলাম। মাত্র ১৫/১৬ জন শিশু নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই ১৫/১৬ জন শিশু দিনের বেলা কাঁচাবাজারে টোকাইয়ের কাজ করে কিছু উপার্জন করতো। তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে এবং সদস্যদের নিয়ে প্রথমে আমরা পথশিশুদের জন্য একটা সমবায় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই। পথশিশুরা প্রথমে আপরুটেড কর্ম কর্মকর্তাদের কাছে তাদের সঞ্চিত টাকা জমা রাখা শুরু করে। এভাবে টাকা রাখতে রাখতে পথশিশুদের সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে জমাদানকারী পথশিশুর সংখ্যাও। ২০০৩ সালের শেষদিকে আপরুটেড চাইল্ড রিহেবিলিটেশন ফাউন্ডেশন এর পথশিশু রাজু মল্লিক, রেশমা আক্তার, আখি, নাজমা বেগম, ফাতেমাসহ আরও অনেক পথশিশু নিয়ে/দিয়ে এই সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে।
"শিশু উন্নয়ন ব্যাংক" এর স্বপ্নদ্রষ্টা আপরুটেড চাইল্ড রিহেবিলিটেশন ফাউন্ডেশন এর শ্রমিক সদস্য রাজু মল্লিক জানায়, "আমরা পথশিশুরা এই সমাজে সুবিধাবঞ্চিত। পথশিশুরা বেঁচে থাকার জন্য কিছু না কিছু আয় করি। আগে আমাদের খাওয়ার পর হাতে যেই টাকা থাকতো তা নিরাপদে রাখার জায়গা ছিল না। হাতে জমা থাকা টাকা বন্ধুদের বুদ্ধিতে নষ্ট করতাম। হিরোইনচিরা ছোড পাইয়া মাইরা টাকা নিয়া যাইতো। দোকানে রাখলেও ঠিক মতো ফেরৎ পাইতাম না। এরপর আমরা কয়েকজন মিলে কারওয়ান বাজারে এক বড় ব্যাংকে যাই। কিন্তু ব্যাংকের দারোয়ান ব্যাডায় আমাগোরে ব্যাংকে ঢোকাতো দূরের কথা ব্যাংকের সামনেও দাঁড়াইতেও দেয় না। পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। তখন আমাদের সার্বিক সহায়তা দেয় "আপরুটেড চাইল্ড রিহেবিলিটেশন ফাউন্ডেশন" কর্তিপক্ষ। তারা আমাদেরকে সংগঠিত করে ব্যাংকে নিয়েগিয়ে একটি একাউন্ট খুলে দেবার ব্যাবস্থা করে"। ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিয়ে রাজু মল্লিকদের স্বপ্ন স্বার্থক হয়। বর্তমানে শিশু উন্নয়ন ব্যাংকের ১১টি শাখায় মোট অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের সংখ্যা ২ হাজার ৭৮২ জন। শিশু উন্নয়ন ব্যাংকের বর্তমানে জমাকৃত আমানত ৬৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৮৭ টাকা(৩০ জুন, ২০০৯ইং)। যা সুদে-আওসলে কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে!
এই ব্যাংক পরিচালনার জন্য রয়েছে তিনটি কমিটি। অ্যাডভান্স কমিটি, ব্যবস্থাপনা কমিটি ও সাধারণ কমিটি। এসব কমিটির সদস্যরাই মূলত ব্যাংক পরিচালনা করে। আর এসব পরিচালনা কমিটির সদস্যও পথশিশুরাই। ব্যাংকের জিএম ও এজিএম ছয় মাস পর পর পথশিশুদের ভোটে নির্বাচিত হয়। ব্যাংকের জিএম ও এজিএম বিনা বেতনে এই কাজ করে। এই ব্যাংকে একাউন্ট আছে দুই ধরনের একটি হলো সঞ্চয়ী হিসাব অন্যটি হলো চলতি হিসাব। ১১টি শাখার মধ্যে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ও কমলাপুর রেল স্টেশনে রয়েছে দুটি ভ্রাম্যমান শাখা। শিশু উন্নয়ন ব্যাংকে পাশ বই, লেজার বুক ও ক্যাশ বই মেইনটেন করা হয়। অ্যাকাউন্ট হোল্ডাররা সই বা টিপসই দিয়ে টাকা জমা ও উত্তোলন করে। এ ১১টি ব্যাংক মনিটর করার জন্য রয়েছে তিন সদস্যের একটি মনিটরিং কমিটি। এই কমিটির বর্তমান সদস্য রাজু মল্লিক, রেশমা ও আখি। এ কমিটির সদস্যরা মাসিক দুই হাজার টাকা সম্মানি পায়। এ কমিটির প্রতিটি ব্যাংকে সদস্য বাড়াতেও কাজ করে। এ কমিটির সদস্য রাজু মল্লিক আগামী ৮ ই ডিসেম্বর দিল্লিতে ব্যাংকিং বিষয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পথশিশুদের ব্যাংক নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবে।
আপরুটেড চাইল্ড রিহেবিলিটেশন ফাউন্ডেশন এর অন্যতম একজন পরিচালক ক্যান্সার আক্রান্ত হবার পর তাদের কার্য্যক্রমে ভাটা পরে। তখন তারা পথশিশুদের পরিচালনার ভার তুলে দেয় পেশাদারী এনজিও "অপরাজেয় বাংলাদেশ"এর হাতে।
পথশিশু জুয়েল। সে এখন ৭০ হাজার টাকার মালিক। জুয়েলের মা মারা যাবার পর জুয়েলের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। সৎ মা জুয়েলকে সারাক্ষণ সতিনের পুত বলে অত্যাচার করতো। জুয়েলের বাবাও সৎ মাকে কিছুই বলতো না। জুয়েল রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসে এই ঢাকায়। আশ্রয় হয় অপরাজেয় বাংলাদেশে। "অপরাজেয় বাংলাদেশ" মূলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করে। অপরাজেয় বাংলাদেশের সহযোগিতায় পথশিশুর সংখ্যাও এখন অনেক বেড়েছে। অপরাজেয় বাংলাদেশের সহযোগিতায় পথশিশুরা তাদের সংগঠন অনেক বড় করে তোলে। আর এভাবেই পথশিশুদের মাথায় আসে একটি ব্যাংকের পরিকল্পনা। এ লক্ষ্যে পথশিশুরা অপরাজেয় বাংলাদেশের মাধ্যমে ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর ও এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধন করে।
শিশু উন্নয়ন ব্যাংকে যেকোন পথ শিশু অ্যাকাউন্ট করতে পারে। অ্যাকাউন্ট করতে একজন নমিনি লাগে। পথশিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্য পথশিশুর বন্ধুর নমিনি হয়। অ্যাকাউন্ট খুলতে লাগে ৫ টাকা। চালু রাখতে জমা থাকতে হয় ১০ টাকা। ছবিসহ ফরম পূরণ করতে হয়। ফরম নিজে পূরণ না করতে পারলে ব্যাংক ম্যানেজার বা সহকারী ম্যানেজার তা পূরণ করে দেয়। এ ব্যাংক থেকে পথশিশুরা ঋণও নিতে পারে। ঋণ বিতরণের জন্য আছে ঋণ কমিটি। সবজি বিক্রির ব্যবসা, ফলের ব্যবসা, আইসক্রিম বিক্রি, পেপার কেনা বেচাসহ ভাল কাজের জন্য তিন হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারে। এই ঋণ নিতে লাগে না কোন জামানত বা সাক্ষী। ডাচ-বাংলা ব্যাঙ্ক ফার্মগেটের ১৫২ পূর্ব তেজতুরী বাজার ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাব আছে ১৩৭ জনের। আর চলতি হিসাব রয়েছে ২৪১ জনের। এ ব্যাংকে নুপুর নামের এক পথশিশুর জমা করেছে ৫৫ হাজার টাকা। এই টাকা সে কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে জমিয়েছে। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া। নুপুর এখন ইউসেপ স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। সে আরও বলে, আমি তো কম্পিউটার চালাতে জানি। ভবিষ্যতে আমি এই টাকা দিয়ে কম্পিউটারের দোকান দেবো। আমার দোকানে পথশিশুদের কম্পিউটার শেখাবো। বাকপ্রতিবন্ধী ফরিদা গার্মেন্টসে চাকরি করে এই ব্যাংকে জমিয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। পথশিশু ফরিদা ছোট বেলা থেকেই আছে, অপরাজেয় বাংলাদেশে। সে বলতে পারে না, তার গ্রামের নাম, তাই তার বাবা-মার কাছেও পৌঁছে দিতে পারেনি অপরাজেয় বাংলাদেশের কর্মীরা। এই টাকা জমিয়ে কি করবে- জানতে চাওয়া হলে ফরিদা হাত ইশারা করে দেখায় প্লেনে চলবে। তার অন্য পথশিশু বন্ধুরা জানায়, ফরিদা টাকা জমিয়ে বিদেশে চাকরি করতে যেতে চায়।
আমার আলাপ হয় অপরাজেয় বাংলাদেশের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আমেনা খাতুন এবং সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার সেজুতি বড়ুয়ার সাথে। তাঁরা জানান, অপরাজেয় বাংলাদেশ সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে। আমরা পথশিশুদের সকল কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই কাজ করি। পথশিশুরা নিজেদের ব্যাংক নিজেরা চালাচ্ছে এটাই ওদের অংশগ্রহণ। যাদের জন্য উন্নয়ন তাদের যদি সেই কাজে অংশগ্রহণ না থাকে তাহলে সেই উন্নয়ন অনেক সময় সার্থক হয় না। পথশিশুরা শুধু ব্যাংকই চালাচ্ছে না, তারা অন্য পথশিশুদের বুঝাচ্ছে, কেন সঞ্চয় করতে হয়। এইডস কি, কিভাবে এইডস ছড়ায়, তাদের কি কি অধিকার আছে। অপরাজেয় বাংলাদেশে যেসব পথশিশু থাকে তারা কি খাবে কিভাবে থাকবে, তারাই ঠিক করে; আমরা শুধু বাস্তবায়ন করি। আমরা ওদের উপর কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেই না। পথশিশুদের এ ব্যাংক নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছে হাজারো পথশিশু। তারা আশা করে-এই ব্যাংক একসময় অনেক বড় ব্যাংক হবে, তারা তাদের জমানো সঞ্চয় দিয়ে হবে স্বাবলম্বী। হাজারো পথশিশু চোখে-মুখে এই স্বপ্ন নিয়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে এই নগরীতে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:১২