বন্ধু আমার............
কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই............গানটা যদি আজ বন্ধু দিবসে মান্না দের মত দড়াজ গালায় গাইতে পারতাম-তাহলে খুব ভালো লাগত। কিম্বা "রঙ ধনু ভালো লাগে, নীল আকাশ ভালো লাগে, ভালো লাগে তারার উঠোনে জেগে থাকা সেই রাত-বন্ধু তোমায় মনে পরে......... "। কবি আর গীতিকারের এমন হৃদয় উষ্ণকরা পকংতিমালার আকুতি-তাহলে কি সুন্দরইনা হতো! গান গাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্ত মনে মনে প্রিয় গান বলার/ আবৃতি করার অভ্যাস আমার আছে।
জীবন যাপনে ব্যস্ততা যাদের অফুরান, বন্ধুত্ব তারেদের কাছে প্রান খুলে শ্বাস নেবার এক স্থান। অন্যদিকে বন্ধুত্বের অসংখ্য আড্ডা আর ভাল্লাগা নিয়ে যাদের দিনমান কেটে যায়-তাদের কাছে জীবনের বাস্তবতাটাই যেন এক শংখনীল কারাগার! বন্ধুত্বতা আসে আমাদের কংক্রিটের স্তুপে ভরা শহরে। বন্ধুত্ব তার গান শুনিয়ে যায় গ্রামের মেঠোপথে। বন্ধুর পথে আলোকিত সপ্ন দেখায় প্রিয় বন্ধুরা। আবার হাসিকান্নার ভাগাভাগিতে বন্ধুরাই শুনিয়ে যায় আশা জাগানিয়া সময়ের গান।
বন্ধুত্বের সমস্ত রং আর রূপ গায়ে মেখে যারা এখনো তুমুল আড্ডায় মেতে আছেন তাদের কাছে বন্ধুত্বের সকল উপমাই অর্থহীন। তাই বন্ধু দিবসে এরা কখনো দলছুট হয়ে ছুটে যান না হলমার্ক কিংবা আর্চিস এ। ই-কার্ড আর গ্রিটিংস এর ভিড়ে তাদের কখনো মনে করিয়ে দিতে হয় না বন্ধু দিবস নামে আপাত অর্থহীন একটা দিনের কথা। তবু এই পৃথিবীর অসংখ্য দিবস আর অর্থহীন আচার-উৎসবের মাঝে যদি বন্ধু দিবস নামে একটা দিবস এসেই যায়, ক্ষতি কী! যদি হাজারো ব্যস্ততার ভিড়ে একটি দিন এসে মনে করিয়ে যায় ফেলে আসা কোনো বন্ধুদিনের কথা তাহলে সেটিই বা দোষের কী। তাই আমরা গুটিকয় আধুনিক মানুষ, আধুনিকতার স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া কিছু মানুষ এখনো ভালোবাসি এই দিবসের মাঝে আটকে যাওয়া বন্ধুত্বকে।
আসলে বন্ধু আর বন্ধুতা যাদের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী তারা একমুহূর্তেও জন্যও মন থেকে আড়াল করতে পারেন না বন্ধুদের। জীবনের সংকটে এরা ছুটে যান বন্ধুদের কাছে। আবার আনন্দ, উল্লাস কিংবা দিন শেষের অবসরেও এরা ভালোবাসেন বন্ধুত্বের কলতান শুনতে। বন্ধুত্বের পরিপূরক সম্পর্কের মাঝে এরা খুঁজে পান জীবনযাপনের ভিন্ন রস। অন্যদিকে যন্ত্রনগরে অবাক প্রহর কাটানো যে যন্ত্রমানুষেরা এরই মাঝে ভুলতে বসেছেন তাদের স্বর্ণালী বন্ধুত্বের প্রহরগুলোকে, তারাও কিন্তু ঠিকই মিস করেন তাদের বন্ধুদের। কিন্তু "যতদিন এই দেহে আছে প্রাণ" ততদিন শুধু "মিস" করার মাঝেই কেন আটকে থাকবে আপনার গর্ব করার মতো বন্ধুতাগুলো? কেন স্রেফ ফেসবুক এর স্ট্যাটাস পড়েই জানবেন বন্ধুর খবর! অচেনা ব্যস্ততার গন্ডি থেকে কেন আরেকটিবার এসে দাঁড়াবেন না চেনা বন্ধু সড়কে? হয়তো বলবেন, বন্ধুদের খবর তো নিতেই চাই কিন্তু সময় যে হয়ে ওঠে না। অথবা ঈর্ষাকাতর কেউ তার অভিমানের ঝাপি খুলে বলতে পারেন, "আমার খবর তো ওরা কেউ নেয় না। তাহলে আমি-ই বা কেন.."। বন্ধু দিবসে এই অভিমানগুলোকেই না হয় ছুটি দিন। অন্তত একটিবার তার কথা মনে করে ফিরে যান বন্ধুবৎসল কোনো আড্ডায়। যেখানে বন্ধুত্বের রঙ ব্যস্ততার আঁচরে দিনের পর দিন ধূসর হয়ে পড়ছে, সেখানে নতুন এক পড়ত রঙ চড়ানোর দায়িত্বটাও না হয় তুলে নিন নিজের কাঁধে। আর যারা গ্রামের টি-স্টল কিংবা কলেজ ক্যাম্পাস কিংবা করিডোরগুলোকে প্রতিদিনই মুখরিত করে রাখছেন নানা রঙের বন্ধুতায়, তারাও সকল স্বার্থ আর সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে ভালোবাসতে শিখুন বন্ধুকে।
চিন্তার চারদেয়ালে হঠাত করেই কড়া নাড়ে ফেলে আসা দিনের অতি প্রিয় কিছু মুখ। মনে পড়ে- আমার প্রিয় বন্ধু, অকালে হারিয়ে যাওয়া আমার সহদরা বুবু'র কথা। আমার জন্মের পর থেকে জীবনের ১৫ বছর পর্যন্ত আমার জীবনে বুবুই ছিলেন-আমার মা, বাবা, ভাই, বোন সর্বপরি এক মাত্র বন্ধু! আমার সেই বন্ধু, আমার প্রিয় বুবু হারিয়ে গিয়েছেন যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায়না-সেই দেশে। বুবু, তোমাকে আমি অনেক মিস করি। প্রতিটা মুহুর্ত আমি তোমাকে মিস করি। তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি বুবু। মনে পরে বুবু'র মতো অসংখ্য বন্ধুর কথা। কোথা থেকে যেন রাজ্যের স্মৃতি আর প্রশ্ন এসে ভর করে মনের অচীন কোণে। আচ্ছা নাসিরটা কি আগের মতই "তালপাতার সেপাই" আছে? ফরিদ, সানি, জুবেরী ওরা কি আমেরিকা থেকে আমাকে মনে করে? নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ তপন কি লন্ডনে বসে আমার কথা ভাবে? বাবু কি তার সুইডিশ বৌ নিয়ে সুখী? কিরন, অর্চনা, তোরা এখন কোথায়? তোদের হিমুদা'র জন্য এখনো কি তোরা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে থাকিস? মাসীমা কি এখনো পুঁজো শেষে আমার জন্য নারিকেলের নাড়ু তুলে রাখেন? মনিদীপা দি' কি আমার বুবুর কথা মনে করে এখনো কাঁদে? এসব কথা কেন আমার সব সময়, প্রায় প্রতিদিনই মনে পড়ে? কেন ওদের কথা শুধুই বন্ধু দিবসের জন্যই রক্ষিত থাকেনা?
আমার ছেলে বেলার বন্ধু, আমার শিক্ষা জীবনের বন্ধু সেলিম, পাপ্পু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, মাহমুদ জয়েন্ট সেক্রেটারী, এক সময়ের তুখোড় গিটারিস্ট হায়দার ভাই(আমার কাজিন) বৃটিশ বৌ লন্ডনে রেখে, এয়্যরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শিকয়ে তুলেরেখে এখন দেশের জনপ্রিয় মানবতাবাদী কন্ঠ শিল্পী, মেজবা কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক, এম এম আকাশ প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নুরুল কবীর দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক(নিউ এজ সম্পাদক), দেবনাথ মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর উচ্চ পদস্থ্য কর্মকর্তা, ফ্রান্সিস পুরোদস্তুর অধ্যাপক এবং সমাজসেবী, চৌধুরী জাফরুল্ল্যা শরাফত দর্শক শ্রোতাদের চরম বিরক্তির কারন হয়ে এখনো খেলাধুলার কমেন্টেটরস(সত্য বলার জন্য রাগ করিসনা শরাফত)! সর্দি আনোয়ার একটা প্রাইভেট ব্যংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কাউস্যা আনোয়ার লন্ডনে, জর্দা আনোয়ার শিল্পপতি।
আমার ছেলেবেলার বন্ধু, আমার স্কুল-কলেজ লাইফের বন্ধু, প্রতি দিনের বন্ধু, চিরদিনের বন্ধু বহুল আলোচিত বীর সৈনিক কর্ণেল গুলজার উদ্দীন যার সাথে আমার শেষ যোগাযোগ হয়েছিল ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৮ ইং র্যাব থেকে সেনাবাহিনীতে প্রত্যাবর্তন এবং সিলেটের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বদলী হবার দিন। গুলজার তুই কোথায় আছিস ভাই? পিলখানার মর্মান্তিক ঘটনার সময় আমি আল্লার কাছে অনেক কান্না করে তোর জীবন রক্ষার আকুতি জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমার আকুতি আল্লাহর দরবারে পৌঁছায়নি বন্ধু। তোকে হারিয়ে আমি আমার ভাই হারিয়েছি। যেখানেই থাকিস-ভালোথাকিস। আমার জীবনের নানান ঘাতপ্রতিঘাতে তোর সহমর্মিতা, তোর অবদান, তোদের পারিবারিক স্নেহ ভালোবাসার অবদান আমি কি করে ভুলে থাকব!
কাছের দুরের, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা, তোমরা আমাকে অনেক দিয়েছো। ভালোবাসা, স্নেহ, মমতার অনেক ঋণে ঋণী করে রেখেছো আমায়। তোমাদের সহায়তা নাপেলে জন্মের সময় মাতৃহারা একটি শিশু জীবনের অর্ধশত বছর পার করতে পারতনা কোন অবস্থাতেই! তোমাদের ঋণ আমি কোন দিন শোধ করতে পারবোনা............
"ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখো আমার এ হাড়,
ছুঁয়ে ছুঁয়ে শেখো একি,
চোখ দিয়েছি প্রিয় বন্ধু,
সে চোখে দেখো পৃথিবীর রূপ একি,
তবু বন্ধু ভালোবেসো একবার...
যা ছিল সব দিয়েছি দেবার........."- সিডি প্লেয়ারে ধীর লয়ে বেজে চলেছে কৃষ্ণকলির গান। আর আমি আমার অনুভূতির প্রতিটি কোণে যেন অন্য একটা শিহরণের ডাক শুনতে পাই। আজ সারা দিনমান বাসায় থাকার দিন। আজ অলস মেঘের দিন। আজ রকিং চেয়ারে আয়েশ করে গান শোনার দিন। তবু আমার চিন্তার মাঝে কোথায় যেন একটা অস্থিরতা। কেবলই মনে হয়, আচ্ছা আজ সারাটা দিন কি বন্ধুত্বেরও দিন হতে পারতো না। হয়তো পারতো। কিন্তু হয় না। সময় আমাদের হ্যামিলনের বাঁশি দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে গেছে চেনা বন্ধুদের চেনা আড্ডাগুলোকে। এখন তাই ব্যস্ত সময় কাটে অফিসে, সংসারে। ছুটির দিনে বাইরে বেরুতে আলসেমী লাগে। বন্ধুর বাড়ির নেমন্তন্নে যাবার জন্য সময় বের করতেও হিসেবের ছক কষতে হয়। আর যান্ত্রিক জীবনে বন্ধুত্ব, আড্ডা বাঁধা পড়ে রয় যান্ত্রকিতার মাঝে।
তারপরেও প্রিয় বন্ধুরা আমার তোমরা সবাই ভালো থেকো।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০