বিউটি বোর্ডিং'এ এক দিনঃ
এদেশের প্রবীন কবি-সাহিত্যিক এবং প্রবীন রাজনীতিবিদের কাছে পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং এক ঐতিয্যবাহী নাম। যারা শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে খোঁজ়খবর রাখেন-তাদের কাছে এই নাম এখনো তাঁদের রক্তে নাচন ধরায়। বর্তমান শিল্পী সাহিত্যিকদের মনে ঈর্ষা যাগায়-আহা! আমিও যদি সেই আড্ডায় যোগ দিতে পারতাম! এ নামের সাথে আমরা পাঠক সমাজ অনেক পরিচিত। ঢাকার বাসিন্দা হয়েও সেই বিউটি বিউটি বোর্ডিং'এ আমারই মত আমার অনেক বন্ধুদেরও কোন দিন যাওয়া হয়নি। পহেলা বৈশাখ আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু অনেকদিন পর একসাথে হয়েছিলাম এক আড্ডায়। ওখানেই সিদ্ধান্ত নিলাম একদিন আমরা বিউটি বোর্ডিং দেখতে যাব। দিন তারিখ ঠিক করে ২৯ মে ২০০৯ তারিখ নির্দিস্ট সময়ে এক এক করে আমরা সবাই জাতীয় যাদুঘরের সামনে একত্রিত হই। একটা মাইক্রোবাসে করে আমরা ৮ বন্ধু চলে যাই বিউটি বোর্ডিং।
পুরনো ঢাকার নর্থ ব্রুক হল রোড, বাংলাবাজার, লালকুঠি আর প্যারিদাস রোডের সংযোগ স্থল থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলে হাতের বাঁয়ে পরবে ছোট্ট একটা গলি, যার নাম শ্রী দাশ লেন। এই লেনে ঢুকে সামান্য কিছুদূর গেলেই চোখে পরবে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড। আহামরি নয়, তবে সেটাই ইতিহাস বিখ্যাত "বিউটি বোর্ডিং '। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই বোর্ডিং'র যাত্রা শুরু হয়েছিল খুব সাধারন ভাবে। তারপরই অনেক অসাধারন সব ঘটনা ঘটেছে এখানে।আমরা সৌভাগ্যবান। আমরা বসে যখন চিড়া দৈ খাচ্ছিলাম তখন সেখানে আসনে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং ইতিহাসবিদ প্রফেসর মুনতাসীর মামুন, সৈয়দ শামসুল হক সহ আরো কয়েকজন প্রবীণ গুণীজন। আমরা তাঁদের সাথে কথা বলি। ওনারাও আমাদেরকে চমতকার করে বর্ণনা করেন বিউটি বোর্ডিং'র ইতিহাস।উল্লেখ্য যে, আমার বন্ধু প্রফেসর ফ্রান্সিস রোজারিও'র সাথে ডঃ মুনতাসীর মামুন স্যারের তত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সখ্যতা দীর্ঘ দিনের। ফ্রান্সিস আমাদের সবাইকে তাঁর সাথে এবং মামুন স্যার তাঁর সংগীদের আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।ওনারা আজ এসেছেন-"বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ ট্রাস্ট" এর সাংগঠনিক কাজের জন্য। আমরাও এই সংগঠনের সাথে নিজের সম্পৃক্ততার ঘোষনা দিলাম।
দেশ ভাগের পরথেকেই বাংলাবাজার এলাকাটি মুদ্রণ এবং প্রকাশনার প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসাবে প্রগনিত হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে শিল্পী-সাহিত্যিকদের আসা-যাওয়া বেড়ে যায়। তাঁদের প্রতি দিনের আডডার যায়গা হয়ে দাঁড়ায় এই বিউটি বোর্ডিং।এই বিল্ডিং'এ বিউটি বোর্ডিং চালু হবার পুর্বে সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত সাপ্তাহিক "সোনার বাংলা" পত্রিকা অফিস হিসেবে পরিচিত ছিল। এই পত্রিকা অফিসের সুত্র ধরেই এখানে জমে ওঠে শিল্পী সাহিত্যিকদের জম্পেশ আড্ডাস্থল। আর এখান থেকেই শুরু হয়-বাংলাবাজারকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চা। গত বিংশ শতকের ৫০-৬০ দশকের তুমুল তুখোড় আড্ডাবাজদের আড্ডাস্থলে পরিনত হয় এই বোর্ডিং। আড্ডাপ্রিয় বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষগুলোর প্রিয় গন্তব্যস্থল ছিল এই ঘুপচি গলির ছোট্ট দালানের বিউটী বোর্ডিং। সোনার বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবার পর দালানের দোতলায় গড়ে ওঠে স্বল্প দামের আবাসিক হোটেল। এই হোটেলে শুধু তখন চা-নাশতা পাওয়া যেত। উল্ল্যেখ্য যে, কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা এই সোনার বাংলা পত্রিকায় ছাপা হয়েছি ১৯৪৯ সনে।
কবি শামসুর রাহমান থাকতেন আশেক লেনে, এবং কবি শামসুল হক থাকতেন লক্ষ্মীবাজারে। আর বিউটী বোর্ডিং'র সাথেই অন্য আর একটা পুরনো দালানের দোতলায় থাকতেন কবি শহীদ কাদরী।কবি শামসুর রাহমানের সাথেই এই বিউটি বোর্ডিং'ই পরিচয় হয়েছিল কবি শামসুল হকের। এখানে আড্ডা দিতে আসতেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান সহ অনেকেই।বিকেলে বোর্ডিং'র সবুজ চত্তরে এক কাপ চা কয়েকজনে ভাগ করে খেতে খেতে তখনকার শিল্পী সাহিত্যিকেরা মেতে উঠতেন জমজমাট আড্ডায়। এখানেই আড্ডায় আরো যোগ দিতেন-ব্রজেন দাস, উপমহাদেশের প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দোপধ্যায়, খালেদ চৌধুরী, সমর দাস, ফজলে লোহানী সহ অনেক সিনিয়র লেখিয়েরা। নতুন শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন-জসীম উদ্দীন, আল মাহমুদ, প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ, কায়সুল হক, সমুদ্র গুপ্ত, মোহাম্মদ রফিক, মোশাররফ করিম, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিকুন নবী(র,নবী), জিয়া আনসারী, অসীম সাহা, আহম্মদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ, দেবদাস চক্রবর্তী, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, জহীর রায়হান, ইমরুল চৌধুরী সহ আরো অনেকেই। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আড্ডা দিতে আসতেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, গাজীউল হক, কম্রেড আঃ মতিন, অলি আহাদ, সাইফুদ্দীন মানিক প্রমুখ। এখানে যে শুধু আড্ডা হতো তাই নয়-পাশাপাশি চলত মতবিনিময়, বিতর্ক, সাহিত্যচর্চা।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর আজ পর্যন্ত যেসব প্রতিথযশা সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব আছেন তাঁদের বেশীর ভাগেরই পদধূলি পরেছে এই বিউটি বোর্ডিং'এ। দেশ ভাগের কিছুদিন পর সোনার বাংলা প্রেসটি নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়।কয়েক বছর খালি থাকার পর প্রেসের মালিক জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের কাছথেকে যায়গাটি বুঝেনেন প্রলহাদ চন্দ্র সাহা। পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে প্রলহাদ চন্দ্রের মেয়ের নামে চালু করেন বিউটি বোর্ডিং। বোর্ডিং'এ প্রথম থেকেই দু'একটি রুম ভাড়া দেয়া হতো আবাসিক হোটেল রুম হিসেবে। ব্যাবসা সম্প্রসারনের সাথে সাথে তথা কাস্টমার সংখ্যা বৃদ্ধিপাবার সাথে সাথে আবাসিক রুমের সংখ্যাও বাড়ানো হয়। এখানে আড্ডা জমজমাট হবার অন্যতম কারন ছিল হোটেলে সুলভমুল্যে চা-কফি, চপ-কাটলেট'র সহজ প্রাপ্যতা। এখান থেকেই ১৯৫৬ সনে প্রকাশিত হয় কবিতাপত্র "কবি কন্ঠ"। তারপর আহম্মদ ছফার স্মপাদনায় প্রকাশিত হয় "স্বদেশ" এবং আরো বেশ কয়েকটি সাহিত্য সাময়িকী। কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখালেখি করার জন্য একটা নির্দিস্ট টেবিল এবং চেয়ার ছিল। এই বিউটি বোর্ডিং'এ বসেই ততকালীন পুর্ব পাকিস্তানের প্রথম পুর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচিত্র "মুখ ও মুখোশ"এর পরিকল্পনা করেছিলেন পরিচালক আব্দুল জব্বার খান।
১৯৭১ সনে পাক হানাদার বাহিনী বিউটি বোর্ডিং'র মালিক প্রলহাদ চন্দ্র সাহা সহ আরো ১৬ জনকে ধরে নিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হয়া করে। প্রহলাদ বাবুর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার চলে যায় কলকাতায়। দেশ স্বাধীন হবার পর কয়েকজন পারিবারিক বন্ধুর ডাকে প্রহলাদ বাবুর পরিবার দেশে ফিরে এসে আবার হাল ধরেন বিউটি বোর্ডিং এর। পরিবারের কতিপয় সুহৃদের সহায়তায় পাকিস্তানী হানাদারদের ধংশস্তুপের ভিতর থেকে প্রহলাদ সাহার পুত্র তারাক চন্দ্র সাহা আবার পুনর্জীবিত করে গড়ে তোলে সেই ঐতিয্যবাহী বিউটি বোর্ডিং। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বিউটি বোর্ডিং আগের মত আর জমেনি। তরাক চন্দ্র সাহা পুরনো সেই আড্ডাটা আবার জমাতে যোগাযোগ করেন সেই সব পুরনো আড্ডাবাজদের সংগে। ১৯৯৫ সনের আগস্ট মাসের ৪ তারিখ আয়োজন করা হয় "আড্ডা পুনর্মিলনীর"। সেদিনের আড্ডায় পুরোনো আড্ডাবাজ ইমরুল চৌধুরীকে আহবায়ক করে গঠন করা হয় "বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ" নামের একটি সংগঠন। ২০০৩ সনে গঠন করা হয় "বিউটি বোর্ডিং সুধী সংঘ ট্রাস্ট"। ঐ ট্রাস্ট থেকে গুণী সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বদের সম্মানিত করা হয়। প্রতিবছর পুনর্মীলনীর দিন একদিনের জন্য জন্য হলেও সেইসব পুরনো দিনের আড্ডাবাজদেরত সাথে নতুন নতুন কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা চলে বিউটি বোর্ডিং'র সবুজ চত্তরে। পুরনোগন তাদের সৃতি শেয়ার করেন নতুনদের সাথে।এই হলো বিউটি বোর্ডিং এর ইতিহাস।
আমাদের আতিথিয়েতায় লাঞ্চ করে মুনতাসীর স্যার, সৈয়দ শামসুল হক তাঁর অন্যান্য ৬ সংগীদের নিয়ে চলে যান। তিনি যাবার পুর্বে জানান-তোমরা আরো কিছুক্ষণ থাকলেই অনেক পুরোনো আড্ডাবাজদের দেখা পাবে। আমরা থাকি সন্ধে পর্য্যন্ত। ততক্ষণ পর্য্যন্ত এখানে আসেন কার্টুনিস্ট র,নবী, শিশু সাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ, কন্ঠ শিল্পী আঃ জব্বার সহ অনেকেই। রাতেই নাকি আড্ডাটা জম্পেশ হবে.........
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৩২