আমি তো সেই আমি, যে তোমাকে ভালোবেসে গেছি জন্ম-জন্মান্তরে
এমন কি নুহের নৌকায় যখন আশ্রিত ছিলাম
অথবা তারও অযুত নিযুত শতক পরে
কুরুক্ষেত্রের দুর্বিসহ রণাঙ্গণে; তার পরের আরও কয়েক নিযুত শতক অতিক্রান্তের পর
জাপানিরা যখন ফেলছিল বোমা পার্ল হারবারে
কিংবা নিতে প্রতিশোধ নির্মমভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল আমেরিকা জীবন্ত হিরোশিমাকে;
তীব্র ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে ধূলোমাখা, কাদামাখা মুমূর্ষু আমি
শুধু ভালোবেসে গেছি তোমাকেই, জপে গেছি প্রতিটি নিঃশ্বাসে তোমারই নাম।
'৫০এর মন্বন্তরে অথবা '৭৪এর হাভাতে দিনে নগরের খা-খা ডাস্টবিনের মতন দুর্ভিক্ষের বছর
ক্ষুধাক্লিষ্ট অনাহারী আমি বাঁচতে আকুল হয়েছি শুধু তোমাকেই মনে করে;
'৭১এ ঘাতকেরা যখন বেয়নেট বাঁধা বন্দুক হাতে ঘরে ঘরে দিয়েছিল হানা
খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করেছিল রক্তাক্ত আমার জন্মভূমিকে
ব্যথা কাতর আমি তখনও কেবল তোমাকে ভালোবেসেই
একটি স্বাধীন দেশের আশায়
অকুতোভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি মহান মুক্তিযুদ্ধে।
পাহাড়ি বালিকা জাসিন্তা যখন আমার আশপাশে দিনরাত
হাসি গানে, অভিমানে, বুননে ব্যস্ত ছিল অনাগত দিনের নির্বিরোধ স্বপ্নগুলো
তখনও আসলে নতুন ধানের মিহি সুবাসের মতো তুমি লেপ্টে ছিলে আমার মননে।
শুধু কি তাই?
সখিনা যখন আমাকে ভালো বেসে বেসে মুখে মুখে তুলে ফেলেছিল অফুরান ফেনা
সাদিয়া তখন নকশীকাঁথা আর নীল পাঞ্জাবি কিনে বন্ধুর প্রেমিককে অমরতা দিতে দৃঢ় কল্প;
(যদিও পরে জেনেছি মামুনই ছিল তার উপলক্ষ্য);
তবু মামুদ হোসেনের অনিশ্চিত ভালবাসায় আস্থা হারিয়ে একদা আমাকে যে দেখিয়েছিল
ভাটির দেশে ধাবমান তার ঐতিহ্যবাহী জরাজীর্ণ সাম্পান;
বিনিময়ে আমি তাকে দিয়েছিলাম দোর্দণ্ড প্রতাপের এক স্থিরচিত্র মাত্র;
অথচ তখনও তোমার শ্রী মুখ উঁকিঝুঁকি মেরে গেছে আঁধার ছাপানো জোনাকীর মতো।
মানুষের মন!
সে নারী হোক অথবা পুরুষ পুঙ্গব
ভালোবাসার ছলাকলা, নানা কলা আরও কত কলা পাকিয়ে ফেলে লহমায়
অথচ ফতুল্লাবাসী বাবুরামের বোনকে পাকানোর আগেই
হাঁচিতে-কাশিতে হয়েছিল জরজর কতিপয় চতুর ললনা আর দুর্বিনীত পাঁকাল;
যারা আমাকে উড়িয়ে নিচ্ছিল শরতের খণ্ডিত মেঘের মতন;
তবু হিমাচল হয়ে তুমি অধরের উষ্ণ বাধে দেখিয়েছিলে নতুন ঘর;
সমুদয় অতীত বুকে নিয়ে নদীভাঙা গ্রাম যেমন লীন হয়ে যায় মেটে জলে।
মূলত সেদিন থেকেই বুঝেছি জীবনের স্থিরতা।
তারপর দেখ, পিতার মূর্খ সন্তানেরা যখন যুথবদ্ধ হয়ে
ঈর্ষাতুর কেউটে সাপের খোলসের মতো আমাদের করেছিল পরিত্যাগ
তবু আমি ছাড়িনি তোমাকে; কতিপয় দালালের কারসাজি সত্ত্বেও অবাক, মুগ্ধ ছিল গ্রামবাসী।
পরিজন-স্বজনহীন আমি তখনও তোমাকে ভালোবেসেছি বিপুল;
যেন বটবৃক্ষ নিরলস বিলায় সঘন নির্মল ছায়া।
কিংবা যখন আমাদের বিরুদ্ধ সময়ে মাঠ থেকে শাকপাতা তুলে
নিদারুণ অভাবে কাটছিল কাল; কথিত বন্ধুরা আমার এসওএস পেয়েও
কী যে কঠিন এক নীরবতায় এড়িয়ে গেছিল আমাকে। হতবাক আমার ঘরে
ধারকরা চালে প্রতিদিন চুলায় চড়েছে হাড়ি
তখনও ম্লান হয়নি তোমার প্রতি আমার দুর্নিবার প্রেম।
অবশ্য ওরা তো জানে না, কে তুমি?
দেখেনি তোমার হৃদসিন্দুকে বৈভবের চ্ছটা
আমাকে নিবিড় আলিঙ্গনে বেঁধে রাখা
তোমার সুদৃঢ় বাহুবন্ধন...
আচ্ছা, আজ না হয় বন্ধ থাকুক ওসব বাখানি;
এখন কী বা আসে যায় তাদের জ্ঞান বা অজ্ঞানতায়?
তারা তো আজ দূর অতীতের বিচ্ছিন্ন কংকাল;
পুরাকালের নোনাধরা ধূসর ফসিল!
আমরা তো বেশ আছি! নাকি সন্দেহ আছে কোনো?
৬ অক্টোবর, ২০১৯
কারবালা।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৯ ভোর ৫:২০