(Photo: Google)
বৃষ্টি থেমে যেতেই স্কুলের বাইরে বেরিয়ে এলো ঋভু। এতক্ষণ বসে থেকে হাঁটু আর পায়ের গোড়ালি ব্যথা হয়ে গেছে যেন। বিনা কাজে খুব বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না সে। ঘরে থাকলেও কিছু না কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একেবারেই শুয়ে বসে কাটানোটা অসুস্থতা বলে মনে হয়। এমনিতেই ডাক্তার বলেছে, ডায়েট ছাড়া ওজন অন্তত চার কিলো কমাতে হবে। কিন্তু কিছুতেই ওজন কমানো যাচ্ছে না। শক্ত ব্যায়াম করতে পারছে না ভয়ে। একবার পিঠের পেশীতে টান লেগে বেশ কষ্ট পেয়েছিল মাস খানেক। তারপর জিমে যাওয়াটাও বন্ধ।
সকালের দিকে বাচ্চা দুটোকে তৈরি করে স্কুলে নিয়ে আসে। তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমায় বিমল। আজকাল নিজেই ড্রাইভ করছে ঋভু। পুরুষ মানুষ সবাই এক না হলেও ড্রাইভার ফজর আলির চোখ ভালো ছিল না। কুতকুতে দৃষ্টিতে লালসা থাকলে কেমন ঘিনঘিনে মনে হয়। গাড়ি চালাতে চালাতে রিয়ার-ভিউ মিররে ঘন ঘন তাকাবার ফলে আইল্যান্ডে তুলে দিয়েছে কয়েকবার। অন্য গাড়িকে পেছন থেকে ঠুকে দেবার ব্যাপার তো ছিলই। তা ছাড়া একবার খুব বড় একটা এক্সিডেন্ট প্রায় ঘটিয়েই ফেলেছিল আশুলিয়ার কাছে। তা ছাড়া পুরুষের চোখে লোভটা কখনো উপভোগ করতে পারেনি সে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। যেন বাজারের কুকুর গুড়ের হাড়ির ভাঙা টুকরো চাটছে। দৃশ্যটাই অসহ্য!
আরে বাবা, একই চেহারা বারবার দেখার মাঝে কী এমন মোহ লুকিয়ে আছে? এক দুবার দেখলে কি চলে না? তার ওপর পরের বউ, ছেলে-মেয়ের মা। যার নুন খাচ্ছিস তার দিকেই লালসা মাখানো চোখে তাকানো সত্যিকার মানুষের আচরণ হতে পারে না। শেষে কী থেকে কী হয়ে যায়। তা ছাড়া সঙ্গে বাচ্চা দুটো থাকলে নিজেকে আরো বেশি দুর্বল মনে হয়। এতটা আতঙ্ক মনের ভেতর পুষে রেখে সুস্থ ভাবে চলাচলই দায় হয়ে যাবে ভেবে, বাড়তি সতর্কতা হিসেবে গতমাসে ছাড়িয়ে দিয়েছে ফজর আলিকে। অবশ্য ফজর আলি জানতে চেয়েছিল কী অপরাধে তার চাকরি যাচ্ছে। বিশেষ কারণের কথা বলেনি ঋভু। শুধু বলেছিল, তোমার ড্রাইভিং খুবই বাজে। একমাসের অগ্রিম বেতনের সঙ্গে বাড়তি আরো এক মাসের বেতন দিয়েছে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আনন্দে। ফজর আলি চলে যাওয়াতে নিরাপত্তাহীনতার ভয়টাও কেটে গেছে। তা ছাড়া নিজের গাড়ি নিজে চালালে ক্ষয়-ক্ষতি কমই হয় বলে যাদের গাড়ি আছে এমন অনেকের মুখেই শুনেছে সে।
বিমল দশটার দিকে যাবে এয়ারপোর্টে। তাকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে আবার এগারোটায় ফিরে আসতে হবে স্কুলে। স্কুল ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত থাকতে হয় গেটে।
আজকাল অনেক নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই তো পনের বিশ দিনের বেশি হবে না, মুনার ক্লাসের একজনকে মিথ্যে বলে নিয়ে গিয়েছিল কিডন্যাপাররা। তাই মুনা আর বিন্নিকে সে বলে রেখেছে যে, অচেনা বা মুখচেনা কেউ যদি এসে বলে, তাকে বাবা অথবা মা পাঠিয়েছে ওদের নিয়ে যেতে, তাহলে ভুলেও যেন কারো সঙ্গে না যায়। স্কুলের বাইরে থাকলেও তার মনের ভেতরটা আকুলিবিকুলি করে সব সময়।
তাড়াহুড়ো করে স্কুল থেকে ঘরে ফিরে এসে ঋভু দেখল, বিমলের কোনো প্রস্তুতিই নেই। নিশ্চিন্ত মনে মুভি দেখছে। ঋভুকে দেখতে পেয়েই কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল সে। সোফা থেকে উঠেই যেন হামলে পড়বে এমন একটা ভাব দেখতে পেয়ে সে বলল, তোমার মতলবটা তো ভালো মনে হচ্ছে না!
ঋভুর কণ্ঠে সত্যিই বিরক্তি।
ঋভুকে জাপটে ধরে বুকে মুখ ডুবিয়ে বিমল বলল, প্লিজ, পুরো দশটা দিন তোমাকে পাবো না!
-তাই বলে একদিনেই চেটেপুটে খেয়ে ফেলবে?
প্লিজ, প্লিজ! বলে, ঋভুর বুকের খাঁজে চুমু খায় বিমল। তারপর কাঁধে মুখ ঘষতে আরম্ভ করে।
ঋভু ছটফট করে উঠে বলল, এই, কালকে অমন পাগলামি করার পরও তোমার আরো ইচ্ছে রয়ে গেল? বলে, নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে আবার বলল, আমার পক্ষে কিন্তু মোটেও সম্ভব না!
-সব ঠিক হয়ে যাবে।
বলতে বলতে সোফার ওপরই তাকে পেড়ে ফেলে বিমল। কিন্তু মন থেকে কোনো সাড়া পায় না ঋভু। শরীর যেন পাকা ফোড়া হয়ে আছে ব্যথায়। বিমলের যেন সে বোধ নেই। সে ব্যস্ত তার পাওনা কড়ায়গণ্ডায় উসুল করতে। ঋভু কী আর করতে পারে? তার পুরোটা দেহের মহাজন তো বিমল। মনটাই কেবল নিজের দখলে আছে।
নিজের প্রাপ্তি বুঝে পেয়ে বিমল উঠে পড়ে হয়তো বাথরুমেই যায়। ঋভু তেমনি পড়ে থাকে সোফাতে। খুব কান্না পাচ্ছিল তার। এ কেমন জীবন? বল দেখলেই যেমন লাথি মারতে ইচ্ছে হয়, স্ত্রীকে দেখলেই পুরুষদের শরীর ব্যাকুল হতে হবে? ততক্ষণে বিমল শাওয়ার সেরে ফিরে এসে তৈরি হতে হতে বলল, আমার তো কিছু গোছগাছ হলো না। সময়ও তেমন নেই।
ভোরবেলা বিমল যখন ঘুমুচ্ছিল, শাওয়ার সেরে প্রায় সবই গুছিয়ে রেখেছে লাগেজে। এখন ছোটখাটো যা কিছু নেবার তা বিমলের নিজেকেই করা উচিত। অথচ অকাজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। গতরাতে বলতে গেলে মোটেও ঘুম হয়নি ঋভুর। আসলে বিমলই ঘুমুতে দেয়নি তাকে। ভোর চারটার পর মাত্র দুঘণ্টা ঘুমুতে পেরেছিল সে। তারপরই বুয়া এসে বেল টিপতে আরম্ভ করেছিল।
বিমলের জন্য গোছানো লাগেজটা বের করে দিয়ে ঋভু চটজলদি শাওয়ার নিয়ে আসে। সকালের দিকে যে কাপড়ে স্কুলে গিয়েছিল তা না ধুয়ে আর পরা যাবে না। সময় বাঁচাতে সালোয়ার কামিজ পরে নিয়ে লাগেজটা টেনে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, তোমার কতদূর? বলতে বলতে আয়নার সামনে ফিরে এসে ভেজা চুলগুলোকে শুকিয়ে নিয়ে হালকা ভাবে বাঁধে কেবল। মোটামুটি উচ্চতার গোলগাল মুখের ঋভুকে খুব একটা সাজগোজ করতে হয় না। ঠোঁটে কেবল হালকা ভাবে লিপস্টিক ঘষে নিয়ে বলল, তুমি কি লাগেজে আর কিছু নেবে? আমি কাপড়-চোপড় দিয়েছি শুধু।
-না। কাপড়-চোপড় হলেই চলবে। ওহ আচ্ছা, শেভিং কিট দিয়েছ তো?
-না। ওটা বাকি আছে।
বলতে বলতে ফের লাগেজ খোলে ঋভু। তাতে শেভিং কিট রেখে ডালা লাগাতে লাগাতে বলে, আর কিছু?
-না, না। চল!
সামনে লাগেজ হাতে ঋভু। পেছনে আসে বিমল। সরাসরি গাড়িতে গিয়ে বসে সে। বাকি যা করার ঋভুকেই করতে হয়।
বিমানবন্দর যেতে তেমন একটা দেরি না হলেও হাতে কিছুটা সময় থাকা ভালো। বিমলের ধারণা, সঙ্গে তার পিএস রীতা যাচ্ছে কথাটা হয়তো জানা নেই ঋভুর। আর জানলেই বা কী করবার আছে তার। অফিসের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে তার কী বা বলার থাকতে পারে।
অবশ্য ঋভু সবই জানে। আর এ ব্যাপারটা বিমল নিজেই জানে না। ঋভুরই বা কী করবার আছে? সে তো দীর্ঘদিনের অনিয়মের দাসত্বে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। যে কারণে মেনে নিতে হয়েছে অনেক কিছুই। দুটো সন্তানের মায়া, নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে অশান্তি বলতে বিমলের স্বেচ্ছাচারী জীবন, রীতার সঙ্গে সীমাহীন মাখামাখি সহ্য না করে উপায় নেই। স্বাধীন জীবন পেতে গেলে মুনা আর বিন্নির ভবিষ্যৎ অসহায় মুখের কথা ভাবলেই হাত পা জমে আসতে চায়। মনের যাবতীয় শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায় লহমায়। তা ছাড়া তার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করতে গেলে অভ্যস্ত জীবনের হাত খরচই মিটবে না। ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া বা ছেড়ে আসা জীবনে নতুন করে অভ্যস্ত হতে যাওয়া আরো কঠিন।
রাস্তার জ্যামের কারণে ঋভুর বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। ঋভু যখন স্কুলে এসে পৌঁছোয় ততক্ষণে ছুটি হয়ে যাবার কথা। কিন্তু বাইরে কোনো স্কুলের কোনো ছেলে মেয়ে এমন কি তাদের কারো কারো বাবা-মা থাকে তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো। খুব কি বেশি দেরি হয়ে গেছে? মুনা আর বিন্নি কোথায়?
সকালের দিকে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির জল এখনো জমে আছে এদিক ওদিক। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই যেন তার। গাড়ি থেকে নেমেই ছুটতে আরম্ভ করেছিল। স্কুলের অফিস রুমে গিয়ে কাউকে পায় না ঋভু। তখনই যেন কী হয় তার, হঠাৎ চিৎকার করে উঠে বলে, দারোয়ান, বুয়া! কিন্তু সাড়া দেয় না কেউ। হঠাৎ বাচ্চাদের হট্টগোলের শব্দ শুনতে পায় সে। মুহূর্তকাল মাত্র স্থির থেকে উৎকর্ণ হয়ে শোনে সে। তারপর সেদিকেই এগিয়ে যায়।
একটি হল রুমে জড়ো হয়েছে সব বাচ্চারা। যাদের ভেতর মুনা আর বিন্নিকেও দেখা যায় অন্যান্যদের সঙ্গে হুটোপুটি করছে। তাদের দেখতে পেয়ে প্রাণে যেন পানি ফিরে আসে। একটু সুস্থির হতেই খানিকটা আগে অকারণ উদ্বেগের জন্য মনে মনে লজ্জিত হয়। আজ কত তারিখ? মাসের শেষদিন এ প্রোগ্রামটা হয়। টিচাররা এর নাম দিয়েছে স্বাধীনতার ক্লাস। এ দিন যার যেমন সময় কাটায়। বেশিরভাগ বাচ্চাই ফার্মের ঝিমোনো মুরগির মতো বসে থাকে চুপচাপ। কেউ কেউ খুব দুরন্ত। ব্যথাও পায়। তবু সতর্ক থাকে টিচাররা। মুনা আর বিন্নি যে কতটা দুষ্টুমি আর লাফালাফি করতে পারে এই একটি দিনেই বোঝা যায়। কিন্তু অন্য সময়টাতে যেন রোবট হয়ে যায়। নিয়ম মেনে সব কিছু করে যাওয়া, যাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া থাকে না সামান্য পরিমাণেও।
আরাম, আয়েশ আর আধুনিকতার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে অথবা সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে গিয়েই কিনা জীবনের স্বাভাবিকতায় ভাটা পড়ছে দিনদিন। অথচ ঋভু হয়ে উঠবার আগে কৃষকের মেয়ে রিজিয়া বানু এমনটা ছিল না। এমন কি আধুনিক ঋভুও কি সত্যিই আধুনিক হয়ে উঠতে পেরেছে? বাইরে বাইরে ঋভু হয়ে উঠতে পারলেও ভেতরে ভেতরে সেই রিজিয়া বানুকেই ছটফট করতে দেখে। ছোটখাটো অপ্রাপ্তি, রাগ-অভিমান, খুনসুটি এসব নিয়ে কি খুব মন্দ ছিল রিজিয়া বানু? সে জীবনে তবু কিছুটা হলেও প্রাণ ছিল। আনন্দ ছিল। ভোগের সঙ্গে কিঞ্চিৎ ত্যাগও। কিন্তু এ জীবনে চাক্ষুষ প্রাপ্তি আর প্রাচুর্যের বাইরেও যে ভিন্ন কিছু থাকতে পারে, তা যেন অনুভব করবার অবসর পাওয়াটা আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।
ডানা কেটে দিয়ে বনের পাখিকে হয়তো পোষ মানানো যায়। সোনার শেঁকলে বাঁধলে পাখি আর তার পালনকর্তার মান বাড়ে। কিন্তু পাখির স্বাভাবিক জীবনের মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় বন্দিত্ব নামের উপসর্গ।
আজ তো দেখাই পেলাম না আপনার!
খানিকটা অনুযোগের সুরে বলে ওঠে শফিক হাজারি। যাও শাড়ি পরা অবস্থায় একটু বিজলির মতো দেখলাম, তাও আবার পালটে এসেছেন। বলে, দাঁত দেখিয়ে হাসে সে। মৃদু স্বরে আবার বলে, ভাইজান কি সন্ত্রাস চালিয়েছিল?
-ধ্যাত! এমন কেন মনে হয় আপনার? সবগুলোই শয়তানের হাড্ডি!
খুব ঝাঁঝ দেখিয়ে বলতে পারলেও গম্ভীরতা বজায় রাখতে পারে না।
লোকটা বেশ হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল। চুল দাড়ি কিছুটা বড় হলেও সারা বছর একটি মাঙ্কি ক্যাপ থাকে তার মাথায়। বিন্নির মিস জাহানারার মতে মাথার টাক আড়াল করতেই স্মার্টনেসের ছুতোয় ও কাজটি করে। কোনো কারণে হয়তো বিয়েটা করতে পারেনি। অথবা তা নিয়ে ভিন্ন কোনো কষ্টের গল্প আছে। সখ্যতা গাঢ় হবার পরও সে দিকটি নিয়ে কেন যেন কোনো রকম কৌতূহল প্রকাশ করতে আগ্রহ হয়নি ঋভুর। হতে পারে তা জানবার পর, নিজের অতীতের অন্ধকারে আলো পড়বার কারণে নিজেকে আড়াল করতে পারবে না লোকটা। ছন্দ কেটে যেতে পারে স্বাভাবিক সম্পর্কের। থাকুক শফিক হাজারি যেমনটা আছে। অন্তত একঘেয়ে জীবনে কিছুটা হলেও বৈচিত্র্যের সন্ধান দিতে পেরেছে লোকটা। এটাই তার জন্যে অনেক প্রাপ্তি। খুঁচিয়ে সুস্থ অংশে ক্ষত সৃষ্টি করতে চায় না।
শখের কবি হলেও কবিতা মন্দ লেখে না। অন্তত ঋভুর কাছে ভালোই লাগে। মাঝে মধ্যে লেখায় অনেকটা বিষাদ ছেয়ে থাকে। তবু সেই বিষাদেরও আলাদা একটি সৌন্দর্য আছে। শফিক হাজারি মাঝে মধ্যেই জেগে ওঠা ঘূর্ণির মতোই খ্যাপাটে হয়ে ওঠে। একটু আড়াল পেলেই জাপটে ধরে আগ্রাসী চুমু খাবে। হাজারির এমন দুর্বৃত্তায়ন ভালোই উপভোগ করে ঋভু। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে রাগ দেখালে পালাতে পালাতে শফিক হাজারি বলে, বক্ষিল! সিন্দুকে তুইল্যা রাখেন। ভালো কিশমিশ হবে!
-শয়তান!
মনে মনে গালি দিলেও আজকাল বেশ টের পায় যে, তাতে খানিকটা সুবাসের মতো আদর আর প্রশ্রয়ও মিশে থাকে। মাঝে মাঝে বিমল দেশের বাইরে থাকলে, মাঝরাতে তার নাক ডাকার মৃদু শব্দ না থাকলে রাতগুলো বড্ড নিঝুম আর দীর্ঘ মনে হয়। সে সময় শফিক হাজারিকে ফোন দিলে সে বলে, ঘুম পাড়াইতে আসবো? মনে হাজারো ইচ্ছে থাকলেও কোনোদিন হ্যাঁ বলবে না সে। পুরুষগুলো অল্পতেও তুষ্ট থাকে আবার সুযোগে সবটাই গিলে ফেলতে চায়। সে তুলনায় হাজারি কখনো লঙ্ঘন করবে না তার সীমা। স্বভাবে দুর্বৃত্ত হলেও জাগ্রত বিবেক বোঝা যায়।
বাচ্চাদের স্বাধীনতার ক্লাস শেষ হয় হয়তো। মুনা আর বিন্নিকে হাসি মুখে লাফাতে লাফাতে আসতে দেখা যায়। ঘামে ভেজা চেহারা। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে দুজনের হাতে দিয়েই তার চোখ পড়ে, হাজারি কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিমলের চোখে কখনো এমন কিছু দেখেছে কি? মুগ্ধতা বা বিস্ময়ের বদলে সব সময় একটি লালা মিশ্রিত চটচটে চাহনি থাকে তার।
কখন আসলেন, আবার যাচ্ছেনও? হায়রে আমার কপাল!
হাজারির কণ্ঠে সত্যিকার আক্ষেপ শুনে চমকে ওঠে ঋভু। একবার চোখ তুলে তাকায়। সহানুভূতির সুরে বলে, আজকে আর ডাকাতি করা গেল না?
তৎক্ষণাৎ জিভে কামড় দিয়ে, দু হাতে নিজের দু কানের লতি ছুঁয়ে শফিক হাজারি বলল, ডাকাতি হবে কেন? আমার জন্যে তো এটা লক্ষ্মীর প্রসাদের এঁটো পাতা!
মুনা আর বিন্নির ব্যাগ দুটো দুহাতে ঝুলিয়ে নিয়ে ঋভু বলল, পুরো প্রসাদ পেতে একদিন মন্দিরে চলে আসেন।
কথাটা শেষ করে আগ্রহ নিয়ে ঋভু তাকিয়ে ছিল শফিক হাজারির মুখের দিকে। হঠাৎ করেই সেখানে কেমন একটা মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়। দৃষ্টি আনত করে সে বলে, আমি যে দলিত। হরিজন।
এমন রহস্যময় কথা বোধগম্য হয় না ঋভুর। মনে মনে বিরক্ত হয় সে। কেড়ে খেতে সমস্যা নেই, দান গ্রহণে যত সমস্যা। লোকটাকে পুরোপুরি বুঝবে কবে? মেয়েরা পুরুষদের বুঝতে পারে কথাটা তাহলে পুরোপুরি সত্যি নয়। শফিক হাজারির মতো কিছু পুরুষ প্রকৃতই দুর্বোধ্য হয়। গাঢ় অন্ধকারের মতোই দুর্জ্ঞেয় আর রহস্যময়।
(সমাপ্ত)
***আগে প্রকাশিত।