ভেতরে ভেতরে এক ধরনের কষ্টের হিমবাহ গলতে আরম্ভ করলেও তিন্নির মুখটা বেশ হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। আজকের মুহূর্তটাও যেন প্রতিদিনকার মতই ছিল স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক ছিল স্টেশনের চিরাচরিত জনাকীর্ণ ব্যস্ত প্লাটফরম। সমান্তরাল রেলের দুটো পাত। এমন কি প্রতিদিনকার বুনো গাছগুলোর বিশুষ্ক ঝরা পাতার আড়ালে কোথাও কোথাও কিঞ্চিৎ লাজুক মুখে উঁকি দিয়ে থাকা সাবেকী আমলের স্লিপারগুলোও। কিন্তু সব চেয়ে বড় পরিবর্তনটা সে দেখতে পেয়েছিল নেহালের চোখে-মুখে। যেখানে হতাশা আর বিস্ময় মিলিয়ে অদ্ভুত এক দ্যোতনার সৃষ্টি হয়েছিল। যার আড়ালে তিল তিল করে গড়া কোনো সৌধ বা ইমারতের ভাঙন শুনতে পেলেও অসহায়ের মতো কান পেতে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না।
ব্রেক অব স্টাডির কারণে দেরি করে মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে ভর্তি হয়েছিল তিন্নি। আর ক্লাসের প্রথম দিনে পরিচিতির পরপরই কেমন যেন ন্যাওটা হয়ে পড়েছিল নেহাল। ক্লাসে লাইব্রেরিতে, কখনো বা ক্যান্টিনে ছায়ার মতো প্রায় আগলে রেখেছে তাকে। কিন্তু তার মনে যে এমন কিছু একটার জন্ম হতে পারে তা কিছুতেই ভাবতে পারছিল না সে। আর সে কারণেই ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত গলে গলেও নিঃশেষ হতে পারছিল না হয়তো।
শাটল ট্রেনটা আস্তে ধীরে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জানালায় মুখ বের করে তাকিয়ে আছে নেহাল। যদিও তার মুখে স্পষ্ট হাসি দেখতে পাচ্ছিল তিন্নি, কিন্তু খানিকক্ষণ আগের চেহারার সঙ্গে নেহালের এই হাসিমুখের কোনো মিল নেই। কেউ কেউ আছে প্রচণ্ড ঝালে মুখ পুড়ে গেলেও উহ আহ করে না। কিন্তু তার মুখ চোখ সে কথা ঠিকই জানান দিয়ে দেয়। হাসির আড়ালে জীবনের প্রথম হোঁচট খাওয়ার যন্ত্রণাটা প্রাণপণে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে হয়তো। যদিও একবার কথায় কথায় বলেছিল যে, মেয়েদের সঙ্গে সে খুব একটা সহজ হতে পারে না। কেবল মিতু আর সাদিয়ার সঙ্গেই তার এক আধটু আলাপ সালাপ হয় আর তিন্নির কাছে বলা যায় পুরোপুরিই সহজ সে। আচরণে বা কথায় সেই শুরুর দিন থেকেই কোনো রকম জড়তা প্রকাশ পায়নি তার মাঝে।
একজন বিবাহিত নারীকে দেখলেই আজকালকার ছেলেমেয়েরা বুঝে ফেলে। জিজ্ঞেস করে জানতে হয় না তাদের। অথচ সে অনেকবারই সাদিয়া বা মিতুর সঙ্গে কথায় কথায় বলেছে তার সংসারের ছোটখাটো অনেক কথা। এমনকি বড় মেয়ে নিভার ছবি আঁকার দুর্দান্ত হাতের কথা। ছোট ছেলে ঋদ্ধর গেম নিয়ে নানা পাগলামির কথা। সেসবের কিছুই নেহালের কানে পৌঁছে নি এ কথাটাই বা সে কী করে মনে জায়গা দেবে?
ক্লাসে আসবার পথে বা কখনো কখনো শাটল ট্রেনে আসা যাওয়ার পথেও দেখা গেছে সে সাদিয়া অথবা মিতুর সঙ্গে ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করছে। আর তাদের মুখে একবারও কি প্রকাশ পায় নি বা কোনোভাবে কি উঠে আসেনি তার প্রসঙ্গ? মানুষ তো সুযোগ পেলেই পরচর্চায় লিপ্ত হয়। তা ভালো কিংবা মন্দ যে কোনো অর্থেই হোক। অথচ কী এক অজানা কারণে ব্যাপারটা নেহালের কাছেই অজ্ঞাত থেকে গেল? বিভ্রান্তি কি এমন করেই মানুষকে গ্রাস করে ফেলে?
যদিও তার মেয়ে নাইনে পড়ছে তবু নতুন পরিচিত কেউ কেউ বলে উঠেছে, হায় আল্লা, আপনার মেয়ে যে অত বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছেই হচ্ছে না। অবশ্য কারো কারো বিশেষ করে মেয়েদের অমন বাড়িয়ে বলাটা প্রায় স্বভাব বলা যায়। তাই ব্যাপারগুলোকে তেমন একটা পাত্তা দেয় নি এতদিন। সত্যিই যে তাকে ঘিরে এমন একটা রহস্যময় ব্যাপার কাজ করছে টের পেলে আরো আগেই ভেঙে দিতে চেষ্টা করতো।
বয়সে কম বলে তার প্রতি একটা স্নেহসূলভ দৃষ্টি ছিল তার। আর সে কারণেই মাঝে মাঝে ছোটখাটো গিফট কখনো বা একসঙ্গে ক্যান্টিনে খেয়ে বিলটা সে নিজেই দিয়ে দিয়েছে কতবার। হতে পারে এটাকেই তার প্রতি দুর্বলতা ধরে নিয়েছিল নেহাল। আচ্ছা ছেলেটা অমন স্টুপিড কেন?
নিজের ওপরই ভীষণ রাগ হতে থাকে তিন্নির। আরে মনের ভেতর পুষে না রেখে একবার আভাসে ইঙ্গিতে জানালেও তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যেতো। শুধু শুধু মনের ভেতর অতটা কষ্টের বোঝা নিয়ে যেতে হতো না শেষ দিন। সে তো নিভার বাবা দিদারের কাছে সব কিছু অকপটে বলে ফেলতে পারবে। তা ছাড়া তার মনে কোনো রকম দুর্বলতারও জন্ম হয় নি যে তা ভুলতে কিছুটা হলেও মনের ওপর চাপ পড়বে। অথচ খুবই মামুলী একটা ভুলের বোঝা তাকেই কিনা বয়ে নিয়ে যেতে হবে বাড়ি অবধি। যার খেসারত দিতে হবে নেহাল নামের স্টুপিডটাকে। হতে পারে এ ব্যর্থতা বা কষ্টের কথা চিরকাল তাকেই বইতে হবে মনের ভেতর। অন্যের হাসি ঠাট্টার পাত্র হবার ভয়ে দেখা যাবে কখনো প্রকাশই করতে পারলো না ঘটনাটা।
ক্লাস, নোট, শিক্ষার নানা সরঞ্জাম বা বইপত্র কিছুর প্রয়োজনে যখনই দিদার সঙ্গ দিতে পারেনি তখনই শরণাপন্ন হতে হয়েছে নেহালের। আর নেহালও যেন বলার সঙ্গে সঙ্গেই উড়ে চলে আসতো। এমন ব্যাপারগুলো আগে কখনোই খেয়াল হয় নি তিন্নির। একবার রিকশায় যেতে যেতে খোলা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছিল বলে নেহাল বলেছিল, তোমার চুলগুলো তো দারুণ ঘন। একটু ছুঁয়ে দেখতে দিবা?
আনমনে বা নেহালের কথায় ততটা গুরুত্ব দেবার ছিল না বলেই তরল কণ্ঠে বলে উঠতে পেরেছিল তিন্নি, তোর ইচ্ছে হলে দেখ!
এক গোছা চুল হাতে নিয়ে নেহাল বলে উঠেছিল, প্রতিদিনই কি শ্যাম্পু কর? অমন ঝরঝরে থাকে কীভাবে? তেল না ক্রিম না চুলে জট পাকায় না?
তিন্নির ইচ্ছে হয় নি সে প্রসঙ্গে কথা বলতে। রিকশা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিল নিউ মার্কেটের দোর গোঁড়ায়। মনে মনে তাড়া ছিল সেদিন, জিনিস-পত্রগুলো কেনা হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে চটজলদি তৈরি হতে হবে জুন আপুর মেয়ে মুনের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যাবার জন্যে।
হঠাৎ একটু দমকা হাওয়া পথ ভুলে যাবার সময় কিছু শুকনো পাতা উড়িয়ে এনে তার পায়ের কাছে রেখে যায়। সে সঙ্গে তখনই তার মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে যায় বলে ওড়নার প্রান্তটা উড়ে এসে ঢেকে দেয় তার চোখমুখ। আর তখনই চকিতে তার দৃষ্টি যায় দূরের পাহাড়ি বাঁকে অপস্রিয়মাণ ইউনিভার্সিটির শাটল ট্রেনটার দিকে। যে ট্রেনের জানালার পাশে বসে আছে নেহাল। যে আরো আগেই চলে গেছে দৃষ্টির আড়ালে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:১২