-পুত্র তোমার বয়সটা কিন্তু খুব জটিল একটা পর্যায়ে আছে। তা কি বুঝতে পার?
বাবার কথা শুনে মাথা নাড়ায় ইশতিয়াক।
আহমদ ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল এক ঠায়। খুব ছোট বেলায় সে হামাগুড়ি দেয়নি। বসতে শেখার পর সে বসে বসেই ছেঁচড়ে চলতে শিখেছিল। তারপর যেদিন হঠাৎ করে হাঁটতে আরম্ভ করলো, সে সময়টা ছিলো আরো অবাক করবার মতো। ছেলেটা হাঁটতে শিখেই বাড়ির বাইরে চলে গিয়েছিল। চলে গিয়েছিল মহল্লার রাস্তা ধরে অনেক দূর পর্যন্ত। বাড়ির পাশের দোকানের ছেলেটা দেখতে পেয়ে তাকে নিয়ে এসেছিল। যদি সেদিন তাকে চেনে এমন কারো চোখে না পড়তো, তাহলে হয়তো আজ সে বড় হতো টোকাই হয়ে। নয়তো সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের হাতে পড়ে ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে উঠতো অথবা হাত-পা ভাঙা পেশাদার ভিক্ষুক হয়ে যেতো।
-আচ্ছা তুমি যে বললে তোমার বয়সটাকে বুঝতে পার। এ বয়সেই কিন্তু ছেলে-মেয়েরা যে নষ্ট হবার নষ্ট হয়ে যায়। যে নিজেকে ভালো বাসে সেই কিন্তু টিকে যায় জীবনে। সাফল্য বা ব্যর্থতা যাই আসুক সে কিন্তু জীবনের দৌড়ে হেরে গেলেও তেমন একটা হতাশ হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে তোমার কিছু বোকামি আমাকে হতাশ করে দেয়। তখন তোমার আরো ছোটবেলার একটি কথা মনে পড়ে। ঘটনাটা কি জানতে চাও? যে ঘটনাটা আসলে তেমন বড় কিছু নয়, তবে তোমার এখনকার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বেশ মিল পাই।
-কোন ঘটনাটা?
-বলেছিলাম না খুব পিচ্চি থাকতে তোমাকে নিচু একটা গাছের ডালে বসিয়েছিলাম। তখন তুমি হাগু করে দিয়েছিলে, যা আমার প্যান্টের পকেট নষ্ট করে দিয়েছিল। তুমি কি বুঝতে পার আমার প্যান্টের পকেট যে আরো নষ্ট করবে ঈশ্বর আমাকে সেদিনই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন? মূর্খ বলে সেদিন ধরতে পারিনি সেই ইঙ্গিতটা।
হাসি মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে যে বিব্রত হচ্ছিল তা ঠিকই বুঝতে পারছিল আহমদ। আর তার বিব্রত অবস্থাকে আরো বাড়িয়ে দিতেই যেন ফের বলে উঠলো, যেমন তুমি বললে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করবে, আমি কিন্তু বাধা দেইনি। যদিও বলেছিলাম গ্রামে চলে যাও। দাদির কাছাকাছি, ফুফুর কাছাকাছি ভালো থাকবে। কিন্তু তোমার তখন মনে হয়েছিল, বাবা আসলে তোমার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। একটা কথা মনে রেখো যে, বাবার কারণে খুব কম ছেলে-মেয়েই নষ্ট হয় যতটা না নষ্ট হয় মায়ের নির্বোধ প্রশ্রয়ে।
-আমি তো ইচ্ছে করলেই নষ্ট হয়ে যেতে পারতাম। ফেন্সি বল, ইয়াবা বল এমন কি গাঁজা-চরস খেতে আমার পকেটের পয়সা খরচ করতে হতো না। কিন্তু আমি সেদিকে যাইনি। মাঝে মাঝে পরীক্ষার চাপ থাকলে একটা দুটো সিগারেট টানতাম, তাও বাদ দিয়ে দিয়েছি।
-গুড। কিন্তু আমার তো মনে হয় না যে, তুমি নিজ থেকেই বাদ দিতে পেরেছ।
তারপরই আহমদ বলল, কে সে?
-আমার একটা বন্ধু। মেয়ে। সে বলেছিল সিগারেট টানলে তার সঙ্গে যেন কথা না বলি।
-ভেরি গুড। মেয়েটা অবশ্যই কোনো ভালো বাবা-মায়ের সন্তান। তুমি কখনোই তোমার ভাল বন্ধুটাকে চিনতে পারলে না। সব সময় ভুল বন্ধু বেছে নিলে। মেয়েটার সঙ্গে কি এখনো বন্ধুত্ব আছে?
-আছে। তোমার গল্প পড়ে বলেছিল তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
-ফোন নাম্বার দিতে পারতে।
-তুমি কী মনে কর তাই দিতে সাহস পাইনি।
-আচ্ছা আবার চাইলে দিয়ে দিও।
-বাবা।
কিছু একটা বলতে গিয়েও ফের থেমে যায় ইশতিয়াক। কিছু নিয়ে ভাবে যেন। তখনই আহমদ বলে উঠল, কী বলছিলে বল। যা বলতে চাও বলে ফেল। বাবা কী মনে করবে সেটা পরের ব্যাপার। আগে নিজের কাছে ক্লিয়ার হও।
-আমি হোস্টেলের বাইরে গিয়ে কোচিং করতে চাই।
-হোস্টেলে কী অসুবিধা?
-স্কুলে যাওয়ার আগে তিনটা সাবজেক্টে কোচিং করি। যখন স্কুল থেকে ফিরে আসি তার আধঘণ্টা পরই আজান হয়ে যায়। কেমিস্ট্রির ম্যাডাম চলে আসে। বিশ্রামের চান্স পাই না। মাথা জ্যাম হয়ে থাকে। বুঝতে পারি না কিছু।
-এই যে দেখেছ আবার কতগুলো টাকা নষ্টের রাস্তা বের করে ফেললে। সেই যে ছোটবেলা থেকে আমার পকেটের বারোটা বাজিয়ে চলেছ আজ পর্যন্ত তা বন্ধ করতে পারলে না।
-বাবা, আমার জীবনটা কি জীবন না? আমার অসুবিধাটা কি বুঝতে চাইবে না?
-কেন চাইবো না? বুঝি বলেই তো বলছি বাইরে গিয়ে তোমার পড়ার দরকার নেই। আচ্ছা তোমার মায়ের সঙ্গে কয়বার কথা হয় দিনে? সে দেখা করে কখন তোমার সঙ্গে?
-কথাও হয় না, দেখাও হয় না।
কিন্তু কথাগুলো বলবার সময় সে তার বাবার চোখের দিকে তাকাতে পারে না। কোনো একটা অস্বস্তির ভার যেন তার মাথাটাকে নিচু করে রাখে।
আহমদ আবার বলল, দেখ, জীবনটা তোমার। এই যে ষোলোটা বছর প্রায় পার করে দিলে, এতটা পথ আসতে তোমার এতটা বছর লেগেছে। এখন যদি তুমি ট্রেনের নিচে ঝাপ দাও বা কোনো উঁচু বিল্ডিঙের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড় তাহলে এক মিনিটে ফুরিয়ে যাবে তোমার জীবনটা। ষোলো-সতের বছর বয়সটা কিন্তু এমনই। যা পেতে চায় তা না পেলেই মনে হয় বৃথা এ জীবন। তোমাকে কি আমি দেইনি তোমার চাওয়া মতো? কিন্তু কোনো অন্যায় আবদার যদি কর তাহলে তো তা আমি মানতে পারি না। তুমি তোমার আশপাশে তাকাও। তোমার বন্ধু ক্লাসমেটদের বাবাদের দেখ, তাদের ব্যাপারে জানতে চেষ্টা করে দেখ যে, তোমার বাবাটা তাদের বাবাদের চেয়ে খারাপ না ভাল! আমার তো মনে হয় তুমি যতটা খোলাখুলি আমার সঙ্গে বলতে পারছ তোমার সেই বন্ধু বা ক্লাসমেটরা কল্পনাও করতে পারে না। বলা তো দূরের কথা, মুখ খোলার আগেই দু গালে দুটো বসে যাবে হয়তো।
-আমি তো বলি বাবা। আমার বন্ধুদের অনেকেই বিশ্বাস করে না। বলে এমন বাবা হয় নাকি আজকাল?
-কাজেই ভেবে দেখ, জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে সত্যিই টের পাবে তোমার বাবা আর দশটা বাবার মতো ছিলো না।
ইশতিয়াক ফের মাথা দোলায়। চেহারা দেখে মনে হয় আরো কিছু কথা তার মনের ভেতরে পাক খাচ্ছে। বলবে কি বলবে না তা নিয়েই যেন দ্বিধাগ্রস্ত কিছুটা। আর তা বুঝতে পেরেই আহমদ বলল, তোমার কি মনে আছে ছোটবেলা একবার চুল কাটাতে চাইছিলে না। কান্না আরম্ভ করেছিলে। শাস্তি হিসেবে তোমার মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছিলাম। একটা কথা মনে রেখো, বাবা তার সন্তানদের ব্যাপারে কখনোই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অন্যদের চোখে যদিও তা ভুল বলে মনে হয় তবু তা ভুল নয়। কাজেই আমার কথার অবাধ্য হবে তো এমন ন্যাড়া করে দেবো যে, বাকি জীবন আর আয়নার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করবে না। কাজেই যা বলি তা শোনো।
-আমি তোমার কোন কথাটা শুনি না?
-কোনটা শুনলে? আমি বললাম গ্রামে চলে যাও। গিয়েছিলে? একটা বছর লস হলে এমন কিছু হতো না। আরো ভাল করে সামনে আগাতে পারতে। অথচ আমার কথা না শুনে শুনলে তোমার মায়ের কথা। যার কাছে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার চাইতে বোন আর বোনের জামাইদের কথাই শতভাগ সত্য। তোমার খালু বলেছিল, না যাবে না। বাপের চেয়ে ওই ব্যাটা বেশি বুঝে ফেলল। অথচ কজন মানুষের জানা আছে যে, সন্তান সম্পর্কে নেয়া কোনো বাবার সিদ্ধান্তে ভুল বের করে মূর্খরা? আচ্ছা মেনে নিলাম সে ভালো আর সঠিক বলেছিল। কিন্তু সে কি তোমার সব খরচ চালাবে বলেছিল? বলে নি। রেজাল্ট কী? সেই আমাকেই সব কিছু করতে হচ্ছে। কিন্তু যা করছি তা খুশি হয়ে নয়, তা তুমিও বুঝতে পার।
কিছুক্ষণ থেমে যেন দম নেয় আহমদ। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করে, আমাদের দেশে একজন শিল্পী ছিলেন শেখ ইশতিয়াক। আরেকজন আছেন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক। কখনো ভেবেছি তোমাকে গান শেখাই। কখনো বা ভেবেছি বড় হলে আইন পড়াব। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছের কোনোটাই পূরণ হবার রাস্তা রাখবে না মনে হচ্ছে। আমি কী নিয়ে তোমার ওপর ভরসা করবো বলতে পার? তোমার কাছে যদি মনে হয় হোস্টেলের বাইরে যেতে না পারলে, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে না পারলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে, নাও। আমি তো আর জানতে আসবো না যে, কোনটা মিথ্যে আর কোনটা সত্য বললে। তা যাচাইও করবো না। এত সুযোগ আর আমার এত আন্তরিকতার পরও যদি পড়ালেখা তোমার না হয়, তাহলে ধরে নেবো সেটা তোমার নিজেরই দুর্ভাগ্য। গ্রাম-দেশে একটি বাঁশঝাড়ের সব বাঁশ কিন্তু ঘরেই লাগে না। কোনোটা কবরে বা কাঁচা পায়খানা বানানোর কাজেও ব্যবহার হয়। ধরে নেবো না হয় যে, তোমার অদৃষ্ট পায়খানার বাঁশের মতোই। এ নিয়ে একটুও দুঃখ পাবো না।
কথা শুনে ইশতিয়াকের ইচ্ছে হয় পালিয়ে যেতে। বাবার সামনে থেকে উঠে এক ছুটে বের হয়ে যেতে। কিন্তু সে উঠে চলে যেতে পারে না। যেন কোনো একটি অদৃশ্য দেয়ালের ভেতর আটকা পড়ে গেছে।
ছেলের নীরবতা দেখে বাবা আহমদ আবার বলে, প্রতিটা মা কিন্তু আদর্শ মা হতে পারে না। কারণ মায়ের বড় পুঁজি আবেগ। কখনো বা স্বার্থ। কিন্তু বাবা? সব বাবাই চান তার ছেলেরা তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করুক। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, ডাকাত বাপও চাইবে তার ছেলে ডাকাত হোক। কোনো বাবাই এমনটা ভাবে না। সুতরাং তোমার ব্যাপারে আমার নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না সঠিক ছিল, তা বাকি জীবন অনুভব করবে তুমি। মাশুল দিলেও দেবে তুমি। তোমার মা, মামা বা খালা-খালুদের পাশে পাবে না। বাস্তবতার প্রতিটা ধাক্কাতেই মনে পড়বে বাবা সঠিক ছিল না ভুল!
হঠাৎ করেই যেন ফুরিয়ে যায় তাদের আলোচনা। ঘরের ভেতর নেমে আসে এক ধরনের শূন্যতা অথবা অস্বস্তি। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। হয়তো নেই মনের ভেতরও কোনো বিবক্ষার বুদবুদ। যেন অনন্তকাল ধরে তারা মুখোমুখি বসে আছে কোনো এক দূরাগত ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে।
বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ইশতিয়াক বলে উঠল, বাবা, আমার পরীক্ষা নিয়ে ভেবো না। রেজাল্ট খারাপ হবে না। আমার ওপর বিশ্বাস রেখো।
কিন্তু ছেলের কথাগুলো আহমদের কানে গেল কি গেল না তা চেহারা দেখে বোঝা যায় না। ছেলের কথা শুনে এমন কি ছেলে উঠে গেলেও তার মাঝে কোনো পরিবর্তন ফুটে উঠতে দেখা যায় না।