ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাইরে এসেই তীব্র গরমে একটা ধাক্কা খেলো রাজীব। ডাক্তারের চেম্বারের ভেতরটা এয়ারকন্ডিশনড হওয়ায় বেশ আরাম আরাম লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো, ডাক্তারের চেম্বারটা বাংলাদেশে না, সুইজারল্যান্ডে, আর কিছুক্ষণ বসলেই চারপাশে তুষারের গুঁড়ো দেখা যাবে। গুঁড়ো আর দেখা যায়নি বরং ডাক্তারের বেরসিক এসিস্ট্যান্ট এসে ব্লাড টেস্টের একতাড়া কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়েছে।
থমথমে মুখে ডাক্তার জানায়, রাজীবের ক্যান্সার হয়েছে, ব্ল্যাড ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ। শুনে অবশ্য রাজীবের কোনো বিকার হয়নি। স্বাভাবিক স্বরেই সে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছে, "মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে কবে, ডাক্তারসাহেব?"
ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছেন, "সর্বোচ্চ দুই মাস। " এরপর ডাক্তার কিছুক্ষণ সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছে। রাজীব কিছু না বলে হা হু করে শুধু মাথা ঝুলিয়েছে, ওর তখন চিন্তা, আর কতক্ষণ এই এ.সি'র আওতায় থাকা যায়। ডাক্তার যতক্ষণ বকবক করবেন, ততক্ষণই লাভ। ডাক্তারের সান্ত্বনাবাণীও একসময় ফুরিয়ে যায়, রিপোর্টের প্যাকেট নিয়ে রাজীব রাস্তায় নামে। চেম্বারের বিপরীতে ছোট একটা দোকান, সেখানে গরম গরম শিঙাড়া ভাজা হচ্ছিলো। গরম গরম শিঙাড়া খাওয়ার লোভ সামলানো কষ্টকর হয়ে যায়। রাজীব পা বাড়ায় দোকানের দিকে।
দোকানের ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে সে। দোকানের তিনপাশের দেয়াল জুড়েই বাংলা সিনেমার বিচিত্র সব পোস্টার, সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এক ছোকরা এসে প্লাস্টিকের হাফ প্লেটে ৩টা বড় আকারের বাদামী রংয়ের শিঙাড়া রেখে যায়। প্লেটের কোণে গোল করে কাটা পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ।
একটা শিঙাড়ার এককোণ একটু ভাঙ্গতেই ভেতর থেকে ফুস করে হালকা ধোঁয়া বের হয়ে যায়। তপ্ত শিঙাড়া জিভে নিয়ে আস্তে আস্তে খেতে থাকে রাজীব।
শিঙাড়াপর্ব শেষে এককাপ মালাই চা খেতে খেতে হঠাৎ করে তার মনে পড়ে, তার ক্যান্সার। তার আয়ু মাত্র ২ মাস। হঠাৎ করেই রাজীবের হাসি পায়, মনে পড়ে যায় বলিউডের জনপ্রিয় একটা গানের প্যারোডি ভার্সন "আই এ্যাম এ ডিস্কো ড্যান্সার, বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার।" গোটাজীবনে একটা বিড়ি বা সিগারেটও সে খায়নি, আজ খাবে। শিঙাড়ার দোকান থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে রাজীব সিগারেটের দোকানের উদ্দেশ্যে।
আজ প্রচন্ড গরম, কাঠফাটা রোদ্দুর যাকে বলে সেটাই পড়েছে। একটা পানের দোকানও দেখা যাচ্ছেনা, পানের দোকানে সিগারেট পাওয়া যাবে। একা একা রাস্তায় হাঁটতে থাকে সে। কিছুদূর গিয়ে সে পানের দোকানের খোঁজ পায়। একটা গোল্ডলিফ সিগারেট ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে কায়দা করে টান দেয়। প্রথমবার হওয়ায় পুরো ধোঁয়াটাই ভেতরে ঢুকে যায়, বিষম খায় রাজীব। খকখক করে কাশে, হাতের সিগারেট ছুঁড়ে মারে রাস্তার উল্টোপাশের ড্রেনে আর গুনগুন করে গাইতে থাকে, "আই এ্যাম এ ডিস্কো ড্যান্সার, বিড়ি না খাইলেও হয় ক্যান্সার।"
২.
রিক্সায় উঠেছে সে। হুড টেনে দিয়েছে, গরমের আঁচ থেকে দূরত্ব বাড়াবার চেষ্টা। রিক্সা যাচ্ছে নিউমার্কেটের দিকে। দুপুরের প্রচন্ড গরমে গলে যাচ্ছে যেন চারপাশ। নিউমার্কেটে এসে সে নেমে যায় রিক্সা থেকে। রাস্তার উল্টোপাশের ফুটপাত থেকে আখের শরবত খায়, আখের শরবতও বিস্বাদ লাগে, ক্যান্সারের সাইডএফেক্ট কী না, ধরতে পারেনা।
চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, ফুটওভার ব্রীজের নীচে, গাড়ি, রিক্সা দেখতে থাকে। ঝাঁঝালো গরমে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়না।
গুলিস্তান থেকে কেনা সস্তার হাতঘড়ির কাঁটাগুলো চলাফেরা বন্ধ করে দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। স্থির, নির্বাক, হতবাক হয়ে মিনিট, সেকেন্ড, ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছে। সময় দেখা সম্ভব হচ্ছেনা। উদ্দেশ্যহীন কিছুক্ষণ পায়চারী করে সায়েন্সল্যাবের সামনে এসে "রাজা সিটি পরিবহণ" এ উঠে পড়ে রাজীব, নামবে সীমান্ত স্কয়ারে। সীমান্ত স্কয়ারের ভেতরটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, ভেতরে আরামে বসে থাকা যাবে কিছুক্ষন।
৩.
সীমান্ত স্কোয়ারের ৩য় তলায় মোবাইলের দোকানগুলোর সামনের ধাতব বেঞ্চে পা উঠিয়ে বসে আছে রাজীব, তীব্র আরামে ঘুম পাচ্ছে তার। অনেককষ্টে নিজেকে জাগিয়ে রেখেছে সে। ভাবছে, নিজের কথা, পরিবারের কথা। কলেজে ভর্তি হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে বাবা মারা গেলো, মা চলে গেলো তারও একমাস পরে। মা-বাবা'কে হারিয়ে রাজীব শুরু করলো উচ্চমাধ্যমিকের লেখাপড়া। লেখাপড়ায় কোনোকালেই খারাপ ছিলোনা সে, বরং ভালোই ছিলো। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় একখন্ড A+ অর্জন করে ভর্তি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া করতে করতে শেষ হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। বন্ধুবান্ধব খুব বেশি কোনোকালেই ছিলোনা, নেশা একটাই, বই পড়ার। সারাদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতো। সন্ধ্যায় লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে টিএসসির মোড়ে ২০ টাকার ডিম-খিচুড়ি খেয়ে এফ রহমান হলের ৭০৫ নম্বর রুমের আবাসে কেটে যেতো সারারাত।
৭০৫ নম্বর রুমের স্থায়ী আবাসও একদিন শেষ হয়ে গেলো, ৫ বছরের পরিচিত রুমে উঠলো নতুন মুখ। রাজীব বিদায় নিলো, মেসে উঠলো ফুলার রোডের দিকে। বিসিএস, চাকরীর চেষ্টা করতে করতে কবে যে শরীরে "ক্যান্সার" বাসা বেঁধেছে, খেয়াল করারই সময় পায়নি সে। যখন খেয়াল করলো, তখন বড্ড দেরী। মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে আর মাত্র দুই মাস বাকি...
৪.
-এই যে ভাই, ওঠেন...
সিকিউরিটির ডাকে ঘুম ভাঙ্গে রাজীবের। এ.সি'র ঠান্ডা বাতাসে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। সীমান্ত স্কয়ার এখন বন্ধ হবে। আড়মোড়া ভেঙ্গে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায় সে, চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে নামে নীচে। রাত ৮.৩০ এর মত বাজে। সারাদিনে ভাত খাওয়া হয়নি, সামনে কিছুদূর হাঁটলেই হোটেল সুনামি। সুনামির কাচ্চিবিরিয়ানির ভীষণ ভক্ত রাজীব। কাচ্চিবিরিয়ানি খেতে সুনামি'তে ঢোকে সে। অর্ডার দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ধোঁয়াওঠা বিরিয়ানি চলে আসে, সালাদ, বোরহানি সহ। কালক্ষেপণ না করে চিনামাটির প্লেটের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয় রাজীব, বিরিয়ানি ঠান্ডা হয়ে গেলে স্বাদ পাওয়া যাবেনা।
খাওয়া শেষে পানের দোকান থেকে একটা মিষ্টি জর্দা দেয়া পান খেয়ে ধানমন্ডি লেকের দিকে পা বাড়ায় রাজীব। আগে খেয়াল করেনি, এখন ভরপেটে খেয়াল করলো, আকাশে জ্যামিতির চাঁদার মত একটা চাঁদ উঠেছে। খালিপেটে প্রকৃতির রূপ বোঝা যায়না, সাধে কী সুকান্ত রুটি আর চাঁদকে এক কাতারে টেনে এনেছেন?
৫.
ধানমন্ডি লেকে ঢুকেই হাতের টেস্ট রিপোর্টটা ছিঁড়ে পানিতে ভাসিয়ে দেয় রাজীব। এটার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বহু আগেই। ধানমন্ডি লেকের রাস্তায় গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে হাঁটতে থাকে রাজীব। হঠাৎ বেরসিক মোবাইল বিকট জোরে চেঁচিয়ে উঠলো, পকেট থেকে সে বের করলো নোকিয়া ১১০০। এন্টিক পিস, বাংলাদেশের খুব কম মানুষেরই এই মোবাইলটা আছে, কয়েকবছর আগে খুব কম মানুষই ছিলো যার এই মোবাইল ছিলোনা। সময়, রুচি সবই আপেক্ষিক... নিজের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেই মুচকি হাসে রাজীব।
সারা পৃথিবীতে কল দেয়ার মত তার একজনই মানুষ আছে, কবির ভাই। মেসে একই রুমে থাকে দুইজন। কবির ভাই ব্যাংকার মানুষ, সারাদিন ব্যাংকে কোটি টাকার হিসেব মিলায়। রাতে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে বাসায় ফিরে রান্না বসায়। যতক্ষণ রান্না শেষ না হয়, দেশ, বিদেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, শিল্প, সাহিত্য নিয়ে দুইজনের মধ্যে তর্ক চলে। রান্না হলে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কবির ভাই, সকালে উঠে তাকে ব্যাংকে যেতে হবে, বেশি রাত জাগলে পরদিন সমস্যা হয়। রাজীব অবশ্য এত তাড়াতাড়ি ঘুমায় না, খাটে শুয়ে প্রতিদিনই কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় কড়িকাঠ ঝাপসা হয়, রাজীব ঘুমিয়ে যায়।
৬.
-হ্যাঁ, কবির ভাই, বলেন।
-কী মিয়া, কই তুমি?
-ভাই, আমি ধানমন্ডি লেকে ঘুরতেছি।
-এত রাতে ধানমন্ডি লেকে কী কাজ? বাসায় আসো তাড়াতাড়ি। ভাত খাবো।
-আমি খেয়েছি, আপনি খান।
-তোমার না আজকে ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়ার কথা। গেছিলা ডাক্তারের কাছে?
- হ্যাঁ, ভাই। রিপোর্ট ভালো, ক্যান্সার হয়নাই।
-আরে এইটা তো খুশির খবর। দাঁড়াও, আমি আসতেছি ধানমন্ডি লেকে। মিষ্টি খাবো একসাথে। কী চিন্তায় ছিলাম আমি, তুমি জানো? আজকে টেনশনে তিনবার হিসেব ভুল করছি। একবার ভাবলাম, কল দিই তোমাকে। পরে ভাবলাম, থাক। যদি খারাপ খবর শুনি, ভয়েই কল দেইনাই। আমি আধাঘণ্টার মধ্যে আসতেছি।
-আসেন, ভাই।
কল কেটে যায়। নোকিয়া ১১০০ এর ছোটখাটো স্ক্রিণের দিকে তাকিয়ে থাকে রাজীব, মিথ্যে কথাটা না বললেও পারতো। কিন্তু, সত্যি বলেও বা লাভ কী? কবির ভাইকে টেনশনে ফেলে কী লাভ?
মূলত, কবির ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে, কবির ভাইয়ের টাকাতেই টেস্ট করাতে গিয়েছিলো রাজীব। নিজের শরীর নিয়ে বরাবরই উদাসীন রাজীব, কবির ভাই জোরাজুরি না করলে সে ডাক্তারের চেম্বারমুখী কখনোই হতোনা।
কবির ভাইকে সত্যি কথা সে কীভাবে বলবে?
৭.
কবীর ভাই হেঁটে আসছেন। গ্রীক রাজপুত্রের মত চেহারা ভাইয়ের, নীল রংয়ের একটা পাঞ্জাবি পড়েছেন, মুখে রাজ্যজয়ের হাসি। হাতে "প্রিমিয়াম সুইটস" এর প্যাকেট। রাজীবের কাছে এসে তার হাতে প্যাকেটটা তুলে দিলেন কবির ভাই।
-খাও, মিষ্টি খাও। বাজারের সেরা মিষ্টি আনছি। প্রিমিয়ামের মিষ্টি।
- ভাই, এতগুলা টাকা ফাও কেন খরচ করলেন?
- ইয়ার্কি করো? আমার টাকা আমি খরচ করবো, তোমার কী? আগামীকাল ছুটি নিলাম অফিস থেকে,বুঝছো। আজ সারারাত তোমারে নিয়া ঢাকাশহর ঘুরবো। বিশাল একটা চাপ কমলো। কী টেনশনে ছিলাম কয়েকটা দিন, বুঝবানা।
মাথানিচু করে মিষ্টি খাচ্ছে রাজীব। চোখ থেকে কিছু উত্তপ্ত তরল বেরিয়ে গাল বেয়ে নামছে। কবির ভাইকে এ অবস্থা না দেখানোর জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে রাজীব।
প্রিমিয়ামের দামী মিষ্টি আজ বড্ড তেতো লাগছে রাজীবের কাছে।
কবির ভাই তখন মনেমনে ভাবছিলেন, "বেঁচে গেলি, ভাই। অন্তত তোর শরীরে এ মরনফাঁদ ঢুকতে পারেনি। গত সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম আমি, ডাক্তার জানালেন আমার ক্যান্সার। মেয়াদ মাত্র এক মাসের। তোকে কীভাবে জানাই এ খবর? গত কিছুদিন তোর অবস্থা দেখেও মনে হয়েছিলো, তোর শরীরেও বোধহয় বিষাক্ত বীজটা ঢুকেছে। আজকে বড্ড হালকা লাগছে রে, বড্ড হালকা।"
প্রিমিয়ামের মিষ্টি আজ কেন জানি বেশি ভালো লাগছে কবীর হোসেন অথবা রাজীবের কবির ভাইয়ের কাছে।
প্রিমিয়ামের মিষ্টির স্বাদও আপেক্ষিক হয়ে যায় সময়ে অসময়ে...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:৩৯