ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে যাবো। ডলার ভাঙ্গিয়ে কয়েক মিলিয়ন ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়া নিলাম। পাশের একজন চোখ বড় বড় করে মিলেনিয়ার দেখতে থাকলো, আমি একটা রহস্যময় হাসি দিলাম।
তবে সেই রহস্যময় হাসি বালি দ্বীপে এসে মিলিয়ে যেতে সময় লাগলো না। জলের মতো না, সমুদ্রের বালির মতো রুপিয়া শেষ হতে থাকলো।
বালি দ্বীপের সাগর দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। একজন বিনীত গলায় এসে বললো, আমি বসতে চাই কিনা। অত্যন্ত সুলভ মূল্যে আমাকে বসতে দেয়ার একটা চেয়ার দিতে আগ্রহী। মাত্র পঞ্চাশ হাজার রুপিয়া।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে ছাতার নীচে আরাম কেদারায় বসে সমুদ্রের ফেনিল রাশি দেখছি। চারিদিকে সুন্দর দৃশ্য। সিনেমার ড্রিম ভ্যাকেশন টাইপ ফিলিংস। এই মুহূর্তে হাতে স্ট্র সহ ডাব না থাকলে কেমন দেখায়।
চেয়ারওয়ালা দ্বিগুন আগ্রহের সাথে জানালো, তার কাছে ডাবও আছে। নাম মাত্র মূল্য, মাত্র ত্রিশ হাজার।
আমি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। অর্থভান্ডার শেষ হতে বেশী সময় লাগবে না মনে হয়।
ডাবের অর্ডার দিলাম। সমুদ্রের এতো বিশালতার কাছে এসে টাকা পয়সার মতো এতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবার কোন মানে হয় না।
আমি দ্রুত এই বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিলেও আমার পরিবার সামান্য তালগোল পাকিয়ে ফেলল। দু' বোতল পানি কিনে তিন লাখ রুপিয়া দোকানির হাতে তুলে দিয়ে এসে ট্যাক্সিতে উঠে বললো, এভাবে তো বেশীদিন চালানো কঠিন হয়ে যাবে।
আমি দাম শুনে বললাম, কাভি নেহি। দু'বোতল পানির দাম কোন ভাবেই ত্রিশ হাজারের বেশী হবে না। প্রতিবার এতোগুলো শূন্য গুনতে গিয়ে আমার স্ত্রী তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে।
ট্যাক্সি ততোক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। হোটেলে এসে রিসেপশনে বলতেই তারা সাথে দু'জিন সিকিউরিটি দিয়ে দিল।
দোকানে গিয়ে দেখা গেল, দোকানী দোকান-পাট বন্ধ করে নবাবী কায়দায় খাওয়ার অর্ডার করে দোকানের সামনে টেবিল পেতে বসেছে। হঠাৎ এতোগুলো রুপিয়া কামাই হয়ে যাওয়াতে হয়ত ফুরফুরে মেজাজে ছিল সে।
সিকিউরিটির ঝাড়ি শুনে বেচারা কাঁচুমাচু হয়ে বাকী টাকা বের করে দিল! আহা বেচারা!
ফেরার পথে আমার স্ত্রী দ্বিগুন ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে কাঠে নাম খোদাই করার কারুকাজ কিনলো। হাসতে হাসতে বললো, দেখো কি সস্তা। একেকটা স্যুভেনির মাত্র দেড় ডলার।
কিন্তু দাম দেবার সময় দেখা গেল, এবারো শূন্য নিয়ে গোলযোগ। আসল দাম দশগুন বেশী।
অবস্থা দেখে আমার এক আমেরিকান কলিগের কথা মনে পড়ে গেল। প্রথমবার বাংলাদেশে এসে জিনিসপত্রের দাম দেখে মুগ্ধ। যে দামই শোনে ডলারে কনভার্ট করে সে উৎফল্লিত।
এটা দেখে আরেক বাংলাদেশী কলিগ বললো, আরে করো কি। ডলারে কম হলেও টাকায় অনেক। শুধু শুধু এতো টাকা দেবে কেন।
এরপর সেই মার্কিন কলিগ সবখানেই খুব মেপে মেপে খরচ করতো।
সাদা চামড়া দেখে রিকসা ওয়ালারা দূর থেকে ঝড় বেগে তার সামনে হাজির হতো। চোখে তার কড়কড়ে ডলারের স্বপ্ন। কিন্তু রোদে একঘন্টা ঘুরে যখন বিদেশী সাহেব দশটাকা দেয়া শুরু করলেন, সে খবর পাড়ার বাকী রিকসাওয়ালাদের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগলো না।
এরপরে সেই মার্কিন বাবুকে এলাকায় দেখলে রিকসাওয়ালারা যে যেদিকে পারতো উলটো দিকে খিঁচে রিকসা টান দিতো।
অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে, এই বালি দ্বীপে আমার সেই মার্কিন সহকর্মীর পথ ধরা ছাড়া উপায় নেই!
দ্বীপের পরে দ্বীপ
বালি এসে নতুন একটা অভিজ্ঞতা হলো।
আধা সাবমেরিনের মতো একটা বিচিত্র বাহন সাবমারসিবল কোরাল ভিউয়ার, প্রায় পুরোটা পানির নীচে থাকে। সেখান থেকে কাঁচের দেয়ালের ওপারে থাকে সমুদ্র। প্রায় নিঃশব্দে এটা যখন চলতে থাকে, নিজেদের মনে হয় সমুদ্রের অংশ।
একোয়ারিয়ামের লাল, নীল, ডোরাকাটা মাছের ঝাঁকের পাশ দিয়ে হঠাৎ চলে যাচ্ছে বিশাল কোন মাছ।
আমাদের উপস্থিতি তাদের সহজাত চঞ্চলতায় ব্যাঘাত করছে না কোন।
উঁচু নীচু এবড়ো খেবড়ো সাগরতলের পথ দিয়ে আমাদের এগোনোর সাথে সাথে হেলে পড়ছে সামুদ্রিক শ্যওলার ঝুরি, চারিদিকের ছোট বড় প্রবাল আর মাছের ঝাঁকের সাথে যেন বিস্ময়কর কম্পোজিশন।
সাগরতল ছেড়ে ওপরে আসার পরেও আরও কিছুক্ষণ তার রেশ লেগে ছিল কল্পনায়।
বালি থেকে ঘন্টাখানেকের ক্রুজশীপ ভ্রমণ শেষে আমাদের একটা ভাসমান রীফ পন্টুনে আনা হয়েছে। সমুদ্রকে কাছে থেকে দেখার নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্যারা সেইলিং, বানানা রাইড (কলা আকৃতির বোটে বসার পর ক্ষীপ্র গতিতে সেটা টেনে নিয়ে যাবে স্পীডবোট), সী ওয়াক (ডুবুরীর মতো পোশাকে সমুদ্রের নীচে হাঁটাহাটি), সাবমার্সিবল কোরাল ভিউয়ার, ওয়াটার স্লাইড (উঁচু থেকে স্লাইড বেয়ে ধপাস করে সমুদ্রে পড়া। শুনতে যতোটা নিরীহ মনে হয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা ততোটাই ভয়াবহ)। এছাড়াও ছোট নৌকায় করে কাছের দ্বীপ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানকার জীবন যাত্রা দেখার জন্য।
প্যারা সেইলিং জিনিসটার কথা আগে শুনেছি। আজ ট্রাই করলাম।
একটা স্পীড বোটে করে আমাদের পন্টুন ছেড়ে সাগরে গভীরে নিয়ে গেল।
তীব্র বাতাসের বিপরীতে খুলে দেয়া হলো প্যারাসুট। নানা রঙের খাঁজে বানানো এই প্যারাসুট সমুদ্রের উপরে যেন বিশাল একটা ফুল। তার ঠিক নীচেই হুকে বসতে পারে একজন বা দু'জন মানুষ।
ঘুড়ির লাটাইর মতো যন্ত্র থেকে আস্তে আস্তে সুতো ছাড়া হয় প্যারাসুটের, ধীরে ধীরে প্যারাসুটের হুকে আটকে থাকা মানুষটি ওপরে উঠতে থাকে।
আমাদের সাথে ভীনদেশী (সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ান) একটা পরিবার এসেছে। টিনএজ বয়েসী দু'বোন, সাথে বাবা মা। বোন দু'জনই খুব উচ্ছ্বল। কিছুক্ষণ পরপর হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ছে।
সবার আগে তারাই গেলো। আকাশের কাছাকাছি গিয়েও তাদের হাসাহাসি থামছে না।
হয়তবা এ কারণেই আমার পালা আসার পরেও তেমন ভয় লাগছিল না।
হুক লাগানোর পর ওপরে ওঠার তালে তালে স্পীডবোট ছোট হতে থাকলো। বোটের গতি বাড়ছে,
একটা সময় ছোট বিন্দুর মতো হয়ে গেল বোটটা, মাঝখানে ঘুড়ির সুতোর মতো একরত্তি দড়ি।
আমি ছোট বেলার দোলনার মতো করে বসে আছি। যতো উপরে উঠছি চোখের দৃষ্টি আরো দূরে যাচ্ছে, ছোট গ্রাম, পাহাড়, আমাদের প্নটুনটাকে এখন খেলনার মতো লাগছে।
সামুদ্রিক বাতাস আসছে। স্পীডবোটের ক্ষীণ আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কেমন একটা শান্ত পরিবেশ।
এই উঁচুতে শূণ্যে ঝুলে থেকে চা খেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ট্যুর অপারেটরদের এই আইডিয়া দিতে হবে। অভিযানের নাম হবে প্যারা টি।
নীচে নামানোর জন্য সুতো টানা হচ্ছে।
একটু কটমট আওয়াজ হচ্ছে।
একটু চমকালাম। এটা ঘর্ষণের শব্দ। তাছাড়া একটু আধটু রোমাঞ্চ না থাকলে প্যারা সেইলিং পূর্ণ হবে নাকি।
অগ্নিগিরি!
শেষ বিকেলের আলোয় দেখা অগ্নিগিরি বাতুরের রাজসিক সৌন্দর্য মুগ্ধ করার মতো। বাদামী রঙের মাথার কাছে এলোমেলো সাদা মেঘের পায়চারী, বিস্তৃত জায়গা জুড়ে হেলান দিয়ে থাকা পর্বতের গায়ে লেপ্টে থাকা কালো লাভা যেন তার পরণের চাদর। ঘুম ঘুম চোখে যেন রাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাতুর জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ওপরে শান্তশিষ্ট দেখালেও এর ভেতরে দিনরাত ফুটছে গনগনে লাভা। স্থানীয় একজন জানালো চাইলে ট্রেকিংও করা যায়। আড়াই ঘন্টার মতো লাগে। ওপরে গেলে ভেতরের উত্তাপ টের পাওয়া যায়। সেই তাপে ডিম ভাজি কিংবা, চা গরম করা যায়।
কাছাকাছি না গেলে সে উত্তাপ বোঝার উপায় নেই। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কনকনে ঠান্ডা বাতাসে আমাদের জমে যাবার অবস্থা হচ্ছিল।
আছেই একটা খোলা ঝুলন্ত রেস্টুরেন্টে বসলাম আমরা। সেখান থেকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগছিল বাতুরকে।
অগ্নিগিরির পায়ের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্থানীয়দের আবাস। কৃষিকাজই প্রধান পেশা। তবে ইদানীং ট্যুরিজমও যোগ হয়েছে। আগ্নেয়গিরির পরিত্যক্ত লাভা দিয়ে ছবি এঁকে বিক্রি করে পর্যটকদের কাছে।
বাতুর শেষবার জেগেছিল দু'দশক আগে। তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হ্রদ। খানিক দূরেই আছে মাউন্ড আগুং।
বাতুরের তুলনায় আগুং অনেক বেশী ভয়ংকর। মাত্র কয়েকমাস আগেও অগ্নুৎপাত হয়েছে। অনেকটা দিন শান্ত থাকার পর গত বছরেই আবার জেগে হুলুস্থূল বাঁধিয়ে ফেলেছে। কয়েকশ' আগ্নেয় ভূমিকম্পের তোড়ে এর আশপাশের কয়েক লাখ মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল এয়ারপোর্টও। এবার সাবধান থাকায় তেমন ক্ষতি করতে না পারলেও কয়েকদশক আগে তার উত্তপ্ত লাভার হত্যা করেছে করেছে কয়েক হাজার মানুষ।
টানা কয়েকমাস জেগে থেকে এখন আবার কিছুটা শান্ত। আশেপাশে থাকা মানুষজন ঘরে ফিরেছে।
প্রকৃতির অন্যতম ভয়াবহ এই দানবের খুব কাছে থেকেই প্রতিদিন ঘুমুতে যায় রাতে। অনিশ্চয়তাকে উপেক্ষা করার এই সাহসের মাঝেই যেন লুকিয়ে আছে মানব জাতির টিকে থাকার রহস্য।
কফি লুয়াক!
কোন একটা জন্তুর 'ইয়ে' দিয়ে কফি বানানো হয় এমন একটা উদ্ভট তথ্য গত কয়েকদিন ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছিল।
ইন্টারনেটে কোন জিনিস দেখলে বিশ্বাস করতে নেই। কাজেই তেমন পাত্তা দিলাম না।
আজ বালিতে ট্যুর গাইড সেই একই গল্প বলে আমাদের নিয়ে যখন কফি বানানোর বাগানে নিয়ে গেল, তখন কৌতুহল আর সন্দেহের মিশ্রণে এক বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে প্রবেশ করলাম।
দু'প্যাঁচের রুমালের টুপি, সাদা ফতুয়া আর লুঙ্গি পড়া খাঁটি ইন্দোনেশিয়ান পোশাকের এক অল্প বয়ষ্ক ছেলে খুব বিনয়ের সাথে আমাদের বাগানের ভেতরে নিয়ে গেল।
কফি সীমের গাছগাছালির মাঝ দিয়ে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ে খাঁচায় বেজীর মতো কয়েকটা প্রাণী শুয়ে বসে আছে।
ছেলেটি বলল, এই প্রাণীর নাম লুয়াক। প্রচন্ড অলস। সারাদিন খালি ঘুমায়। তাদেরকে নিয়মিত কফি বিন খাওয়ানো হয়। সেই জিনিস তারা খেয়ে 'ইয়ে' করলে সযতনে সেই জিনিস সংরক্ষণ করা হয়।
ইয়ের ভেতর কফির বিনের দানা ঠিকই থাকে। প্রাণীটির জারক রসে ভেতরের সেই দানায় বাড়তি স্বাদ যুক্ত করে। দিনকয়েক রোদে শুকিয়ে পরিষ্কার করে তারপর বালিতে সেই কফি রোস্ট করা হয়।
সবশেষে পাউডার বানিয়ে প্যাকেট করে জায়গা হয় দোকানে।
লুয়াক প্রাণীর পুরীষ থেকে জারিত এই কফি খুবই দামী। মাত্র দু'শো গ্রামের একটা প্যাকেটের দাম বাংলাদেশী টাকায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি।
পাশেই একটা টংঘরে গরম গরম কফি সার্ভ করা হচ্ছে।
কৌতুহল হলেও লুয়াকের কফি চাখার সাহস হলো না।
সাথে অন্যান্য স্বাদের কফিও আছে। সুন্দর করে অনেকগুলো কফি সাজিয়ে আমাদের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিয়ে গেল চারিদিকে গাছগাছালি ঘেরা বসার জায়গায়।
চকলেট, ভ্যানিলা, নারিকেল, আদা অনেক স্বাদের কফির সাথে আছে নানারকম চা। এলাহী কারবার।
নীচে দোকানে প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে চা, কফি।
সবকিছু দেখে টেখে বের হবার সময় কৌতুহল চেপে ধরলো।
হাজার মাইল পেরিয়ে এসে এই ঐতিহাসিক বস্তু না টেষ্ট করে যাবো? স্বাদ নিয়ে সন্দেহ নেই, হাজার হাজার মানুষ খাচ্ছে। খাওয়ার সময় খুব বেশী কল্পনাপ্রবণ না হলেই চলে।
বেরোনোর গেটের কাছাকাছি ইউ টার্ণ নিলাম।
বাগানের গাইড বালক উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল।
খাঁচার পাশ দিয়ে যেতে বালক বললো, দেখো দেখো একটা ঘুম থেকে উঠেছে।
আমি না দেখার চেষ্টা করলাম।
Ignorance is bliss.
লুয়াকের কফি সার্ভ করা হলো।
শেষ পর্যন্ত সেই কফি কি খাওয়া হয়েছিল?
সেটা নাহয় রহস্য হিসেবেই থাক।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১২:২৭