গত ফুটবল বিশ্বকাপের কথা সবার মনে আছে কিনা জানিনা, পত্রিকায় জানা গেল ব্রাজিল আর আর্জেনটিনার সমর্থকরা মারামারি করে দু'জন নিহত আর অর্ধ শতাধিক আহত।
কয়েকদিন আগে বিদেশের মাটিতে প্রবাসী বাঙালীরা দু'টি প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থনকে কেন্দ্র করে মারামারি বাঁধিয়ে ফেলেছে। পরে সেই দেশের সরকার সবাইকে বেঁধে দেশে ডিপার্ট করে দিয়েছে।
কোন একটি বিচিত্র কারণে আমাদের দেশের মানুষ অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও কয়েকভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভাগ হবার পর এ পক্ষের সাথে ও পক্ষের শুরু হয় তর্ক। শুধু তর্ক হলেও ভালো ছিলো, একসময় সেটা হয়ে যায় কাদা ছোঁড়াছুড়ি। শুধু কাদা ছোঁড়া ছুড়ি হলেও ভালো ছিল, কিন্তু কিছুক্ষ্ণের মধ্যেই ইট-পাটকেট-ধস্তাধস্তির চুড়ান্ত অবস্থায় গিয়ে ঠেকে। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের লোকজনের স্থান হয় হাসপাতালে। দলাদলির বাইরে যারা কোন দল করে না, তাদের বিপদ সবচেয়ে বেশি, তারা হল সকল দলের চক্ষুশূল!
বেশ কয়েক বছর ধরে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, প্রযুক্তিও এর বাইরে যাচ্ছে না। এক পক্ষ বলে এই প্রযুক্তি ভালো, আরেকপক্ষ বলে ঐ প্রযুক্তি ভালো। শুধু প্রযুক্তি নিয়ে এ তর্ক থাকলে ভালো ছিল, একটা পর্যায়ে সেটা ব্যক্তিগত আক্রমনের পর্যায়ে চলে যাওয়া শুরু করলো। অথচ যে দু'টি প্রযুক্তি নিয়ে এতো ঝগড়া, কয়েকদিন পরে দেখা গেল, সেই প্রযুক্তির রথি-মহারথিরা গলাগলি করে একসাথে কাজ করছে।
প্রথম দিকের যে উদাহরণগুলো দিলাম, সেটা দেখে মনে হতে পারে যে কোন কিছু নিয়ে আমাদের অতি দ্রুত ভাগ হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হয়ত শিক্ষার অভাব। কিন্তু শিক্ষিত লোকেদের দলাদলির তীব্রতা দেখে সে ধারণা ভেঙেগ যায়।
আমার মনে হয় মূল সমস্যা হলো আত্মবিশ্বাসের অভাব।
রাজনৈতিক হোক, ধর্মীয় হোক, দার্শনিক মত হোক, সেটা নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে, কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের পছন্দ করা মত নিয়ে আমাদের মানুষ দ্বিধায় থাকেন, সন্দেহ কাটানোর জন্যে অন্য পক্ষকে আক্রমণ করেন। কিছু দিনের মধ্যে দলে ভেড়েন, শুরু করেন দলীয় আক্রমণ। নিজের দলের যাবতীয় অন্যায়ে চোখ বন্ধ করে রাখেন, অপর পক্ষের সামান্য ভুলেও গুরুদন্ড দিতে পিছ পা হননা।
আশার কথা, অন্যকে আঘাত করে নিজের বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব কাটানোর দিন মনে হয় ফুরিয়ে এসেছে। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশীদের হাজারো সাফল্যের খবর হর-হামেশাই পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই নতুন সাফল্যের খবর ছাপিয়ে যাচ্ছে আগের সবগুলোকে।
এই কয়েকদিন আগেই আমরা শুনলাম বাংলাদেশী বিজ্ঞানী এম জাহিদ হাসানের কথা, পদার্থবিজ্ঞানের জটিল জগতে তাঁর আবিস্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসকে নতুন করে লেখার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন, বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের মাঝে হৈ চৈ বাধিয়ে ফেলেছেন।
আমি নিজে তেমন একটা ক্রিকেট খেলা দেখিনা। কিন্তু বেশ কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ নিয়ে আমার ভিনদেশি ক্রিকেটভক্ত সহকর্মী আর বন্ধুদের বিস্ময় আর কৌতুহল দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়না, ঘটনাচক্রে নয়, নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে ভালো মতোই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের ছেলেরা।
সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া বংলাদেশের এই ছেলেরা কিন্তু উন্নত দেশের মাখন-রুটি খেয়ে, পৃথিবির সেরা শিক্ষা ও জীবন ব্যবস্থার মাঝে বড় হয়নি। লোডশেডিং, যানজট, হরতাল আর ভেজালের মধ্যেও খাঁটি হয়ে বেড়ে উঠেছে।
আমি বহু জায়গায়, বহুবার বলেছি, মেধার দিক থেকে পৃথিবির কোন দেশের চাইতেও আমরা পিছিয়ে নেই। একথাটি কোন আবেগের কথা নয়, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি নিজের দেশের মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আমাদের মূল সমস্যা, আত্মবিশ্বাসের অভাব। নানা অনিয়মের ভেতর বড় হতে হতে নিজেদের ভেতর বড় কিছু দেখার স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে ফেলেছি। সেই হীনমন্যতা দূর করার চেষ্টা করি, অন্যদের ছোট করার মধ্য দিয়ে। অবধারিতভাবে নিজেদের বিভাজনের এ সু্যোগ নেয় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ।
পৃথিবির ইতিহাস বলে, অন্যকে ছোট করে কেউ কখনো বড় হতে পারেনি। নিজের ওপর বিশ্বাস থাকলে প্রতিটা মানুষ শুধু নিজেকেই এগিয়ে নিয়ে যায়না, এগিয়ে নিয়ে যায় তার চারপাশের সবাইকে।
লেখক আনিসুল হক কিছুদিন আগে একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন, যার মর্মার্থটা এরকম - উন্নত দেশের একটা সমস্যা হলো সেখানে সবকিছুই মোটামুটি পারফেক্ট। মাতৃভূমিকে নিজেদের স্বপ্নের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ সেইসব দেশের তরুণ প্রজন্মের নেই, যে সুযোগটা আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের হাতে আছে।
কথাটা আমিও বিশ্বাস করি। কারণ, ধীরে ধীরে হলেও বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ হোক, কাল হোক বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবেই। সবাই মিলে আমরা কত দ্রুত নিজেদের সেই স্বপ্নের কাছাকাছি যেতে পারি, এখন সেটাই জানতে ইচ্ছে করছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৫