মাঝে মাঝেই তরিকে মনে পড়ে, এখনও। কী অদ্ভুত। কতদিন হয়ে গেল, কত বছর পেরিয়ে গেল। তরির কথা এখনও মনে পড়ে। যখন মন খুব খারাপ থাকে, তখন কিভাবে জানি তরির কথা মাথায় এসে ভীড় করে।
স্কুল কলেজে খুব কড়াকড়ির ভেতর পার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমার দু'টি ডানা গজিয়ে গেল। সাহিত্য পত্রিকা, আবৃত্তির অনুষ্টান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা - একমাত্র পড়াশুনা ছাড়া সবকিছুতেই আমার অসীম আগ্রহ।
কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের ওপর দায়িত্ব পড়ল নবীন বরণ অনুষ্ঠানের। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের আয়োজনে এটাই সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান। সুতরাং এটা নিয়ে উত্তেজনা আর টেনশনের শেষ নেই। ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে
রিহার্সেলের জন্যে আমাদের আলাদা একটা রুম দেওয়া হলো। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। ডিপার্ট্মেন্টের অন্যান্যদের সাথে তরিও আসত আমাদের কাজ-কারবার দেখতে। অন্য অনেকের মতো মুগ্ধ হয়ে
দেখতো তাও নয়, ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকতো।
নবীন বরণের দিন ইউনিভার্সিটির হলরুম কানায় কানায় ভরে উঠল। নাচ-গান-নাটক-আবৃত্তি দিয়ে পুরো অনুষ্ঠান জমজমাট। শেষের দিকে আমার আর সীমার একটা ডুয়েট আবৃত্তি ছিল। বিষয়-ভঙ্গি আর নাটকীয় ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিকের
জন্যে রিহারসেলের সময়েই এই পরিবেশনাটি সবার কৌতুহলের কারণ হয়েছিল। কিন্তু আসল অনুষ্ঠানের দিনে সীমা পুরো গুবলেট করে দিল। কিছুদূর বলেই ওর হাত-পা জমে গেল, এতো মানুষ দেখে ভয়ে ওর গলা দিয়ে কোন স্বর বের হচ্ছে
না। ওদিকে ব্যকগ্রাউন্ডে অদ্ভুতুড়ে মিউজিক বাজছে, সীমার গলা দিয়ে চিঁ চিঁ করে শব্দ হচ্ছে, হল ভর্তি হাসা-হাসি। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিল না।
পরদিন মন খারাপ করে ক্যান্টিনে একা একা খাচ্ছি, তরি এসে পাশে বসলো। মুচকি হেসে বলল, সীমা গুবলেট করলেও তোমার অংশটুকু ভালোই হয়েছে। আমি আড়চোখে ওর দিকে দেখে বুঝলাম, কথাটা বিদ্রুপ করে বলেনি ও। আমি একটু
লাজুক হাসলাম, কেন জানি অদ্ভুত একটা ভালো লাগা ছেয়ে গেল।
এর পর থেকে তরির সাথে দেখা হলে মাঝে মাঝেই কথা হতো। তেমন দরকারি কিছু না, কেমন আছ, কী খবর - এরকম কথা বার্তা।
ক্লাশ শেষে একদিন বাসায় ফিরছিল তরি, আমাকে দেখে দাঁড়াল। গলা নীচু করে বলল, সময় থাকলে আমি যেন তার পিছু পিছু আসি, কি একটা দরকারি কথা আছে। ক্যান্টিন ততক্ষ্ণে বন্ধ, আমরা গিয়ে বসলাম মাঠের কোনে বটতলায়। সমস্যা
ওর মামাকে নিয়ে। বয়েস হয়ে গিয়েছে, এখনও বিয়ে থা করছে না। বিদেশ থেকে দেশে এসেছে বেড়াতে, মামাকে বিয়েতে রাজী করানোর কোন বুদ্ধি দিতে পারি কিনা।
তরির কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম, তার মামা বিয়ে করছে না, আমি কী বুদ্ধি দিবো। আমার নিজেরই বুদ্ধির যথেষ্ঠ ঘাটতি আছে, নইলে কি আর পড়াশুনা বাদ দিয়ে সারাদিন এটা-সেটা করে বেড়াই। অবশ্যি তরিকে দেখে মনে হলো
আমার বুদ্ধির উপর তার অনেক ভরসা। কেন জানি সেই ভুল ভাঙ্গানোর চেষ্টা করলাম না।
"হুমম, জটিল সমস্যা।" বলে মাথা দোলাতে লাগলাম। "সমস্যা যেহেতু তোমার মামাকে নিয়ে, সেহেতু তার সাথে কথা বলতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।"
"তাহলে আমাদের বাসায় চলো। মামার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।" উৎসাহ নিয়ে বলল তরি।
বুঝলাম গর্তে পড়তে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি বললাম - "আজকে না, বাসায় কাজ আছে।" বলে সেদিনের মতো কেটে পড়লাম।
দু'দিনের মাথায় তরি ঠিকই কিভাবে কিভাবে ম্যানেজ করে আমাকে নিয়ে গেল ওদের বাসায়। তরি সম্ভবত এর আগে কোন ছেলেকে তার বাসায় নিয়ে যায়নি, তার বাসার সবাই কেমন সন্দেহ টাইপ দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছিল। তবে তার সেই
অবিবাহিত মামাই পরিবেশটাকে সহজ করে ফেলেছিল দ্রুত। মামা খুবই হাসি-খুশি মানুষ। সব সময় হৈ-চৈ করছেন, আমেরিকায় তার সিংহ সাইজের একটা কুকুর আছে, সেই কুকুর কতজনকে ভয় দেখিয়ে নাস্তানাবুদ করেছে তার গল্প করে
আকাশ ফাটিয়ে হাসতে থাকলেন। এর মধ্যে তরি নাস্তা দিয়ে গেছে, মামার সাথে আমার খুবই উচ্চ পর্যায়ের দার্শনিক কথা হচ্ছে। বিয়ে-শাদি করা যে জীবনের বড় ভুল এই ব্যাপারে মামা আমাকে কনভিন্সড করে ফেললেন।
তরির কটমট দৃষ্টি দেখে ভয় করতে লাগলো, কখন আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। সেরকম কিছু অবশ্যি হলনা। তরির মা অনেক যত্ন করে রাতে খাইয়ে আমাকে বিদেয় করলেন।
আমি ভেবেছিলাম , এরপরে দেখা হলে তরি আমার ওপর রেগে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সেরকম কিছুই হল না। দেখা হলে সেই আগের মতোই কি খবর, কেমন আছ টাইপ কথা।
এর ভেতর পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম। রিহার্সেলের রুমে মাঝে মাঝেই তরি আসতো, তাকিয়ে থাকতো ভাবলেশহীনভাবে।
একদিন অণু সবার সামনে বোমা ফাটাল।
বন্ধু মহলে "ডেঞ্জারাস মেয়ে" হিসেবে অণুর বদনাম আছে। সে হাসতে হাসতে যে কারো বুকে ছুরি মারতে পারে বলে সবার বিশ্বাস। সেবার বন্ধুরা মিলে সবাই সেন্টমার্টিন যাচ্ছি। আমাদের মধ্যে শরীফ একটু দলপতি গোছের। হোটেল থেকে,
বাসের টিকিট - সব কিছুই সে আযোজন করেছে। টেকনাফ পৌঁছে দলের সবাইকে জড় করে ডিটেইল ইন্সট্রাকশন দিচ্ছিল, ডু এন্ড ডোন্টস। সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। এর মধ্যে অণূ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, হাসতে হাসতেই
শরীফকে বলল, "এই তোর প্যান্টের চেইন লাগা।" এই ঘটনার পর হতভম্ব শরীফ পুরো একদিন কোন কথা বলতে পারেনি।
সেই অণুর সাথে তর্ক করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ না, কিন্তু একদিন সেটাই করে বসলাম। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানের একজন ফিমেল পারফর্মার লাগবে। আর কোন অপশন থাকায় আমি বললাম সীমার কথা। সীমার কথা শুনে অণু তেড়ে
এলো, ডুয়েট আবৃত্তিতে ওর চিঁ চিঁ পারফর্মেন্সের কথা কে না জানে। আমি অণুকে বললাম, ওকে আরেকটা সুযোগ দেয়া উচিৎ।
তখন অণু সবার সামনে হাসতে হাসতে বলল, "তুই বরং তরিকে ধর, তুই বললেই রাজী হয়ে যাবে।"
অণু এইটুকু বলতেই সবাই চুপ হয়ে গেল, কান পেতে রইল এর পর কি হয়। আমি গাধার বললাম, আমি বললেই তরি রাজী হবে কেন।
অণু তার বিখ্যাত অট্টহাসি দিয়ে বলল, কারণ ও তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, তুই যদি ওকে নদীতে ঝাঁপ দিতে বলিস, সাঁতার না পরলেও ও ঝাঁপ দেবে।
সেদিন শরীফের কি হাল হয়েছিল, টের পেলাম। কয়েক সেকেণ্ড কোন কথা বলতে পারলাম না। ভাগ্যিস তরি সেখানে ছিল না। আমি কিছু না বলে রিহারসেল রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।
উপরে উপরে রাগ দেখালেও আমার কিন্তু পরে ভালোই লাগছিল। আমারও মাঝে মাঝে এমনটা মনে হয়েছে। পরে বেশিরভাগ সময় বোঝার ভুল মনে হয়েছে। এখন অণুর মুখে শুনে বুকের ভেতর কী এক অজানা পুলক জাগতে থাকে।
এর পর থেকে যখনই তরির কথা ভাবতাম, মন ভাল হয়ে যেত। ও আমার সামনে আসলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হত। আমি অবশ্যি তরিকে সেটা বুঝতে দিতাম না।
দেখতে দেখতে ইউনিভার্সিটি জীবন শেষ হয়ে এল। ফাইনাল পরীক্ষার আগে কয়েক সপ্তাহের বন্ধ। শেষ ক্লাসের দিন সবাই মিলে খুব হৈ-হল্লা করে র্যাগ ডে করল। সন্ধ্যে যতোই ঘনিয়ে আসছে, মনটা বিমর্ষ হয়ে উঠছে, তরির সাথে আজই
হয়তো শেষ দেখা। এরপর জীবনের প্রয়োজনে কে কোথায় ছড়িয়ে যাবো কিছুই জানিনা। উদাস ক্ষ্ণের ভাললাগা একটু একটু করে বেড়ে চলেছে তখন, কিন্তু এতোটা সাহসী হয়ে ওঠেনি যে পৃথিবির যেকোন কিছুর বিনিময়ে আমি ওর সামনে
দাঁড়াবো।
সেদিন তরিকে ওর বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলাম। রিকসায় না গিয়ে হেঁটে হেঁটেই গিয়েছিলাম দু'জন। কেন জানি তেমন কিছুই বলা হয়নি। শুধু বিদায় নেবার আগে ওর বাসার ফোন নাম্বার দিয়েছিল, বলেছিল দরকার হলে ফোন দিতে।
তারপর কি ভেবে হেসে বলেছিল, দরকার না হলেও আমি ফোন দিতে পারি।
সাহিত্য-সংস্কৃতি করতে গিয়ে লেখা-পড়ার বারোটা বাজিয়ে ফেলেছি। ফাইনাল পরীক্ষার আগে নাকে-জলে পড়া-শুনা শুরু করলাম। যতোটুকু উদ্ধার পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে তরির কথা ভাবি, এই পৃথিবিতে কোন একজন গল্প-উপন্যাসের
প্রেমের মতো আমাকে ভালোবাসে - কোন এক বিকেলে তার হাত ধরে মাতাল হাওয়ার সমুদ্রের পারে হাঁটবো, এই কল্পনায় নতুন উদ্যমে পড়া শুরু করতাম।
পরীক্ষার পর এক বিকেলে তরিদের বাসায় হাজির হলাম। তরির মা অনেক যত্ন করে বসালেন। চা-নাস্তা খেতে দিলেন। হুট করে তরির বিয়ে হয়ে যাওয়াতে দুঃখ করলেন। একমাত্র কন্যার বিয়ে অনেক ধুম-ধাম করে দেবেন ভেবেছিলেন, তরির
বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সেটা আর হলো না। আমাকে বিদায় দেবার সময় বললেন আবার আসতে। তরি বিদেশে চলে যাওয়ায় মেয়ের বন্ধুদের দেখলেও মায়ের মন খুশি হয়ে ওঠে।
তরিকে নিয়ে আমার সাত-পাঁচ ভাবা-ভাবির সেখানেই ইতি। তরি আমাকে নিয়ে সেরকম কিছু কখনোই ভাবেনি, সবই রোমান্টিক কল্পনা ভেবে মন খানিকটা শান্ত হলো।
এর পরে অনেকটা বছর পার হয়ে গিয়েছে। একবার একটা কনফারেন্সে যাচ্ছি আমেরিকা, পথে হল্যান্ড এয়ারপোর্টে ট্রাঞ্জিটে সীমার সাথে দেখা। আমাকে দেখে খুশীতে জড়িয়ে ধরে এমন অবস্থা। ওর খুব সুন্দর দু'টা বাবু হয়েছে। পরিচয় করিয়ে
দিল ওর বরের সাথে।
সবার কথা জিজ্ঞেস করল, কে কোথায় আছে, কি করছে এই সব। যা ভাবছিলাম, বিদায়ের আগের তরির প্রসঙ্গ নিয়ে এলো সীমা। উদাস গলায় বলল, বিয়ের দিন বেচারি অনেক কান্না করছিল।
সীমার বরের সামনে আমি খানিকটা বিব্রত হয়ে বললাম, বিয়ের দিন সব মেয়েই কাঁদে, সেটা আমাকে বলছিস কেন।
সীমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি সেই কান্নার কথা বলি নাই গাধা। ভালো থাকিস।
সীমার উপর আমার এতো রাগ হলো যে, বলার নয়। ওর সাথে দেখা ন হলেই ভালো হতো।
কী সুন্দর করে আমার মাথার ভিতর তরির চিরস্থায়ি বসবাসের ব্যবস্থা করে দিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৩:২২