সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে স্যান্ডস-এর নীচে সারি সারি অনেকগুলো দোকান আছে - এক্সক্লুসিভ ডিজাইনের গহনা, ঘড়ি থেকে শুরু করে এনটিক শোপিস পর্যন্ত হাজারো রকম সৌখিন জিনিস সাজিয়ে রাখা থাকে কাঁচের বাক্সে। দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই চোখে পড়ে। কিছু কিছু গহনা এতো সুন্দর যে এটার কাছাকাছি গেলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কিনতে পারি বা না পারি দাম জিজ্ঞেস করা আমার পুরনো স্বভাব। এক দোকানে বড়-সড় হীরের গহনা দেখে গম্ভীর মুখে দাম জিজ্ঞেস করে পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। দামটা ডলার থেকে টাকায় হিসেব করে আমার দম বন্ধ হবার জোগাড়। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় দু'শ কোটি টাকার কাছাকাছি! আমি মুগ্ধ হয়ে হীরের নেকলেসের দিকে তাকিয়ে আছি। এইরকম ভয়াবহ দামী একটা জিনিসের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আলাদা কোন সারচার্জ দেয়া লাগবে কিনা ভেবে কিঞ্চিৎ আতংক বোধ করছি। সেলসম্যান আমার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আশার কথা এই বস্তু কেনার কোন প্রকার ইহলৌকিক বা পরলৌকিক সম্ভাবনা যে আমার নেই, দোকানী সাহেব সেটা বুঝতে পারছেন না। তবে আমার পরবর্তী প্রশ্নে সেটা ধরা পড়ে গেল - আমি জিজ্ঞেস করলাম - "এই জিনিস কেউ কেনে?" প্রশ্ন শুনে দোকানী উদাস মুখে বললেন - "কেউ না কিনলে তো এখানে রাখা হতো না।" আমি কথা না বাড়িয়ে বাইরের পথ ধরি।
এশিয়ায় শপিং-এর স্বর্গরাজ্য বলা যায় সিঙ্গাপুরকে। চোখ ধাঁধানো সব শপিং-মলে বিলাসবহুল কারুকাজের দোকানগুলোতে সাজানো থাকে মানুষের সাধ-স্বপ্নের নানান পসার। কি হীরের গহনা, কি এক্সক্লুসিভ ডিজাইনার জামা, দামী ব্রান্ডের কসমেটিক্স, এনটিক শোপিস, লেটেস্ট আইফোন - সবই হাতের নাগালে।
এখানে যারা বেড়াতে আসেন তারা প্রায় সবাই সিঙ্গাপুরের কয়েক শত বিলাসবহুল দোকানগুলোর কোন না কোনটি ঢুঁ মেরে যাবেনই। তবে নতুন যারা আসছেন তাদের একটা জিনিস জেনে রাখা ভালো - সিঙ্গাপুরে একই জিনিসের দাম একেক জায়গায় একেক রকম। এবং প্রায় কোনখানেই দর-কষাকষির সুযোগ নেই বললেই চলে। কিনলে কেনো, নাইলে ভাগো টাইপ ব্যপার।
সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় শপিং মলের নাম ভিভোসিটি - এক্সক্লুসিভ সব আইটেমই পাওয়া যায় এখানে, তবে সবকিছুর দাম তুলনামূলক কিছুটা বেশি এখানে, আর বেশির ভাগই জিনিসই পাশ্চাত্য স্টাইলের। তবে শপিং এর পাশাপাশি বাচ্চাদের খেলার, পানিতে ভেজার দারুণ জায়গা আছে এখানে, আরও আছে হরেক রকম সুস্বাদু খাবারের রেস্টুরেন্ট।
আমাদের বাঙ্গালী/উপমহাদেশীয় ঘরানার জিনিস-পত্র কিনতে হলে যেতে হবে মুস্তাফা সেন্টার। সিঙ্গাপুরের প্রায় সব মার্কেট খুব গুছানো - পার্কিং লট, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, খাবারের দোকান, বাচ্চাদের খেলার জায়গা সবকিছু সুশৃংখলভাবে থাকে, কেবল মুস্তাফা সেন্টারেই সব কিছু কেমন আউলা ভাবে ছড়ানো-ছিটানো। তবে এই আউলা-অংশটুকু বাদ দিলে সুঁই থেকে রেফ্রিজারেটর, গহনা থেকে কাঁচাবাজার সবই মিলবে এখানে। মুস্তাফা সেন্টারের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, বিশাল এই শপিং সেন্টারটি দিন-রাত ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে, সরগরম থাকে হাজার হাজার মানুষে।
চোখ ধাঁধানো এই শপিং রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোটা বেশ মজার, অবশ্য যদি পকেট ভরা থাকে। পকেট না ভরা থাকলেও সমস্যা নেই, যদি নিজের লোভকে দমিয়ে রাখা যায়, সেটা অনেকের জন্যেই কষ্টকর হয়ে যায়। আর তখনই অনেকে পা দেয় চুরির পথে। সিঙ্গাপুরে মার্কেটে চুরির বিষয়টা খুবই সিরিয়াস হিসেবে দেখা হয়। যতো বড় মার্কেট বা দোকান হোক না কেন, এধরণের চেষ্টা করলে চোখের পলকেই ধরা পড়ে যেতে হবে। তারপর সোজা কয়েক মাস জেল।
কিছুদিন আগে মুস্তাফা সেন্টারে কসমেটিক্স চুরি করতে গিয়ে হাতে-নাতে ধরা পড়লেন বাংলাদেশ থেকে আসা একজন। পরে জানা গেল, ইনি বাংলাদেশের একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির কন্যা। পরে তার মানসিক অসুস্থতার নানা প্রমাণ দেখিয়ে কয়েক সপ্তাহ পরে তাকে ছাড়ানো হয়।
আজ পত্রিকায় দেখলাম ভারতের এক নামকরা অভিনেত্রী সিঙ্গাপুরে এসে গহনা চুরির জন্যে অভিযুক্ত হয়েছেন। ইনিও মানসিক সমস্যার কথা বলে পার পাবার চেষ্টা করবেন কিনা জানি না, তবে বাহ্যিক জৌলুসে নিজেকে সংযত করতে না পারাটা যদি হয় মানসিক রোগ, তবে সেই রোগীদের এই দিকে পা না বাড়ানোই ভালো।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:৩৮