বিদেশ-বিভুঁইয়ে আসার পরেও প্রায়ই অদ্ভুত কিছু অনুরোধ পাই। বেশীরভাগই আসে দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে উঁচু পদে কাজ করছেন এমন বন্ধু-বান্ধব-পরিচিতদের কাছ থেকে - তাঁদের প্রতিষ্ঠানের জন্যে প্রকৌশলী খুঁজে দেবার জন্যে। সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান তাদের দরকারে প্রকৌশলী খুঁজবে এটা অদ্ভুত কোন বিষয় না। কিন্তু সমস্যা হলো রিক্রুটমেন্ট আমার পেশা নয়। আমার কাজ সফটওয়্যার বানানো। দেশে থাকতে টেকনিক্যাল কম্যুনিটির সাথে যোগাযোগের কারণে অনেক ভালো প্রকৌশলীর সাথে পরিচয় হয়েছিল, সেই সুবাদে তাদের কাউকে কাউকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠানকে সাহায্যও করেছিলাম। আগের মতো এখন সবার সাথে যোগাযোগ সম্ভব না হলেও প্রকৌশলী খুঁজে দেবার অনুরোধটা প্রায়ই আসে।
ভেবে দেখলাম সরাসরি সফটওয়্যার প্রকৌশলী খুঁজতে তেমন সাহায্য না করতে পারলেও দেশীয় সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্যভাবে সাহায্য করা যায়। এ পর্যন্ত দেশে ও বিদেশে বেশ কিছু অসাধারণ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ও মেধাবী প্রকৌশলীদের সাথে কাজ করেছি, সে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ শেয়ার করতে পারি।
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের সামগ্রিক সফলতার জন্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সফটওয়্যার ডেভেলপারদের নিজেদেরও অনেক কিছু করার আছে। আজকের লেখাটিতে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে করণীয় বিষয়গুলোই তুলে ধরা হলো।
সফটওয়্যার ব্যবহারে দক্ষতা
সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা অন্যদের জন্যে সফটওয়্যার তৈরি করে, যার মূল লক্ষ্য হলো কাজের দক্ষতা বাড়ানো। যে কাজটি করতে সাধারণভাবে ৪-৫ ঘন্টা লেগে যেতে পারে, সে কাজটিই উপযুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করে কয়েকটা ক্লিকে করে ফেলা যায় কয়েক সেকেন্ডে!
কিন্তু খুবই অদ্ভুত ব্যাপার হলো, অনেক সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানকে দেখেছি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তারা নিজেরা খুব এফিশিয়েন্ট টুল বা সফটওয়্যার ব্যবহার করে না। যার কারণে প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, আর্কিটেকচার, এডভান্সড ডিবাগিং থেকে শুরু করে টেস্টিং, ডেপ্লয়মেন্ট, সাপোর্ট - সব ধরণের কাজে ডেভেলপারদের অসংখ্য ম্যানুয়াল কাজ করা লাগে, যেটা করা একদিকে যেমন খুবই বিরক্তিকর ও ক্লান্তিকর, তেমনি অনেক ব্যয়বহুল। গতানুগতিক টুলিং ব্যবহার না করে, প্রোজেক্ট ও কাজ ভেদে টুলিং এফিশিয়েন্সি একটা প্রতিষ্ঠানের কাজের গতি ১০ থেকে ১০০০ গুন (হ্যাঁ, যা পড়ছেন তা মুদ্রণপ্রমাদ নয়!) বাড়িয়ে দিতে পারে। সেজন্যে সফটওয়্যার কিনতে (বা নিজেরা বানাতে) হলে অতিরিক্ত যে খরচ হয়, তা খুবই সামান্য, বরং এটিকে বুদ্ধিদীপ্ত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
নিজেদের কাজের দক্ষতা ও উৎপাদনের জন্যে উপযুক্ত সফটওয়্যার ব্যবহার করার আরেকটি সুবিধা হলো, ভালো সফটওয়্যার কিভাবে কাস্টমারকে হ্যাপী করে সেটা শেখা যায় (ভালো লিখতে গেলে যেমন ভালো বই পড়তে হয়, তেমন আর কি)।
সফটওয়্যার প্রযুক্তিতে দক্ষতা
শুধু ভালো সফটওয়্যার ব্যাবহারই নয়, নিত্য নতুন ডেভেলপমন্ট ফ্রেমওয়ার্ক ও প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে নিজেদের কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর বিষয়টিও সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক প্রযুক্তিগুলো খুবই পরিবর্তনশীল। একই ফিচারের জন্যে কোন ফ্রেমওয়ার্ক বা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের দু'বছর আগের ভার্সন এবং নতুন ভার্সন দিয়ে লেখা কোডের পরিমাণের ১০-১৫ গুন তফাৎটা দেখলেই বোঝা যায়, নিজেদের আপ-টু-ডেট থাকাটা সফটওয়্যার ডেভেলপারদের জন্যে কতটা জরুরী।
যে প্রতিষ্ঠানগুলো পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফটওয়্যার বানায়, তাদের ডেভেলপরাররা খুব দ্রুত হতাশ হয়ে যায়। ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে তখন খুঁজতে থাকে ভালো প্রতিষ্ঠানের। সফটওয়্যার কাস্টমারের চাহিদার কারণে অনেক সময় নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব না হলেও, সংশ্লিস্ট সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানটি তাদের ডেভেলপারদের জন্যে নানা ইন-হাউস ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করতে পারে, অথবা নিজেদের কাজের গতি বাড়াতে পারে এমন সফটওয়্যার বানাতে পারে নতুন প্রযুক্তি ব্যাবহার করে।
নিজেদের বর্তমান কর্মীদের ঠিকঠাক দক্ষ ও মোটিভেটেড রাখতে পারলে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ সফটওয়্যার ডেভেলপার ঘাটতি অনেকখানি কমে আসবে।
চাহিদা ও বাস্তবতার সমন্বয়
নতুন ডেভেলপার খোঁজার আগে প্রথমেই একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চিত করতে হবে তার প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ডেভেলপাররা সেখানে কাজ করে সন্তুষ্ট। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের দেশের বেশিরভাগ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ নেই। যার কারণে অল্প সময়ের ব্যবধানে এখানে ডেভেলপাররা এক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আরেকটিতে চলে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নতুন প্রতিষ্ঠানেও পুরানো বা অন্য আরেক সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষতিটা হয় প্রতিষ্ঠানের। নতুন কর্মী খোজার ঝক্কি-ঝামেলার পাশাপাশি চলে যাওয়া কর্মীদের ওপর নিজেদের প্রতিষ্ঠানের কাজের উপযোগী করার জন্যে ব্যয়িত সময় ও অর্থ চলে যায় শূন্যের খাতায়।
প্রাতিষ্ঠানিক আর দশটা পেশার চাইতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট অনেকখানিই ভিন্ন ধরণের। সৃষ্টিশীলতার উপযোগী কাজের পরিবেশ দেবার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে খেয়াল রাখতে হবে সফটোওয়্যার ডেভেলপমেন্ট পেশার নিজস্ব কিছু তরিকা।
চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের সবচাইতে বেশী অভিযোগ কজের চাপ নিয়ে। সাধারণ ৯-৫ টা অফিসতো দূরে থাকুক, কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যার পাশাপাশি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মধ্যরাতে বাসায় ফেরা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে বিচিত্র হচ্ছে, আমাদের কালচারে দীর্ঘসময় কাজ করাটাকে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে "ডেডিকেশন" হিশেবে দেখা হয়, এমনকি হাতে দরকারী কাজ না থাকলেও! হয়ত এ কারণেই অনেক ডেভেলপার বিশ্বাস করতে শুরু করেন "I am Programmer, I have no life"।
অন্যদের কাজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে নিজেরা সফটওয়্যার বানালেও নিজেদের কর্মীদের কাজের চাপ স্বাভাবিকের চাইতে বেশী হলে ধরে নিতে হবে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানটিতে মৌলিক সমস্যা রয়েছে। অন্য কথায়, তারা নিজেরা এই ব্যবসাটির উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি এখনও।
সফটওয়্যার ডেভেলপমেণ্ট এমন এক অদ্ভুত কাজ যেখানে বড় একটা সিস্টেম মাত্র কয়েক মিনিটে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়, আবার ছোট একটি ফিচারের জন্যে লেগে যেতে পারে কয়েক সপ্তাহ। কাস্টমারের চাহিদা ও টেকনিক্যাল জটিলতার প্রেক্ষিতে ডেভেলপারদের সাথে সঠিক সমন্বয় করা গেলে দু'পক্ষকেই খুশী রাখা সম্ভব।
কার্যকরী নিয়োগ পদ্ধতি
নতুন ডেভেলপার নিয়োগ দেবার সময়ে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেয়াটাও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে তাড়াহুড়ো করে ডেভেলপার নিয়োগ করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তার চওড়া মাশুল গুনতে থেকে দিনের পর দিন তাদের।
একটি খারাপ নিয়োগ শুধু প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বোঝাই নয়, অদক্ষ, খামখেয়ালী কাজের জন্যে সে প্রতিষ্ঠানের বাকী দক্ষ কর্মীদের মূল্যবান সময় নস্টের কারণ হয়। বিষয়টাকে হালকা ভাবে নেয়ারও উপায় নেই। কারণ ভালো বেতন পাওয়া যায় বলে, অনেকেই এখানে ঝাঁপিয়ে পড়িছে, যাদের এই কাজটির প্রতি যথেষ্ট মমতা নেই।
নতুন ডেভেলপার নিয়োগ দেবার সময়ে টেকনিক্যাল অভিজ্ঞতার সাথে সাথে প্রোগ্রামিং সমস্যাগুলো প্রার্থী কত দক্ষতার সাথে কম্পিউটার ছাড়াই সমাধান করছে তার ওপর লক্ষ্য রাখা দরকার। মাইক্রোসফট, গুগলের মতো প্রযুক্তি বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই তাদের কর্মীদের নিয়োগ করে থাকে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সফটওয়্যার ডেভেলপমেণ্ট পেশাটিতে সংশ্লিস্ট ব্যক্তিটির যথেষ্ট মমতা ও আগ্রহ আছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ করা। সেটি করা যেতে পারে তার আগের কোন কাজ নিয়ে ক্যাজুয়াল স্টাইলে কথপোকথনের মাধ্যমে। তার সে কাজটি হতে পারে পেশাগত, কিংবা হতে পারে কোন ওপেন সোর্স প্রোজেক্ট উন্নয়নে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ।
কমিউনিটি, কমিউনিটি, কমিউনিটি
এটা সত্যি কথা চাহিদার অনুপাতে বাংলাদেশে দক্ষ সফটওয়্যার ডেভেলপার অনেক কম। সেক্ষেত্রে সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটির সাথে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে, বিশেষত যেসব প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানো হয়, একেকটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান মাসে একটি বা দু'টি ওয়ার্কশপ করতে পারে বিনা মূল্যে। এছাড়াও তারা আয়োজন করতে পারে বিভিন্ন কমিউনিটি ইভেন্ট যেখানে প্রতিষ্ঠানটির ডেভেলপাররা তাদের নানা অভিজ্ঞতা ও দিকনির্দেশনা শেয়ার করতে পারে সবার সাথে।
টেকনিক্যাল কমিউনিটি ইভেন্ট আয়োজন করার লাভ বহুমাত্রিক। এটা শুধু ভবিষ্যতের জন্যে দক্ষ কর্মী পেতে সাহায্য করে তা নয়, সাথে সাথে নিজেদের বর্তমান কর্মীদের উদ্দীপনা ও দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।
সমাপ্তি কথন
দু'চার মাসের প্রেক্ষাপটে নয়, দেশী সফটওয়্যার ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো নিকট ও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে যে সুফল পাওয়া যাবে, সেটির অংশীদার হবে অনেক মানুষ। এভাবেই দেশকে এগিয়ে নেয়ার সাথে সাথে একেকটি প্রতিষ্ঠান নিজেদেরকেও নিয়ে যেতে পারে বহুদূর। পৃথিবির সেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই গগণচুম্বী সফলতা পেয়েছে। মেধাভিত্তিক এই শিল্পে তারা পারলে আমরাও পারবো, কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের কম-বেশী থাকলেও মেধার দিক থেকে আমরা কখনোই পিছিয়ে নেই, সে প্রমাণ বহুবারই আমরা দিয়েছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৮