ইদানীং তরুণ বয়সের ভোক্তাদের মধ্যে কোমল পানীয় এবং এনার্জি ড্রিংক বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
শহুরে খাবারের দোকান থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন খুব সহজেই মেলে কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংক । চতুর বিপণন ও বিজ্ঞাপন এসবের মূলে। পানীয়
শিল্পের একটি দ্রুত প্রসারমাণ অংশের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াচ্ছে এনার্জি ড্রিংক ও কোমল পানীয়।
১৪০টি দেশে ২০০ ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংক তৈরি হচ্ছে এবং বিশ্বের ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী তরুণের ৩১ শতাংশ নিয়মিত এনার্জি ড্রিংক গ্রহণ করে বলে জানা যায় ।
অপরদিকে নানা বর্ণ-গন্ধের কোমল পানীয় সারা পৃথিবীতেই ব্যাপক জনপ্রিয়। ছেলে-বুড়োর পছন্দের খাদ্যতালিকায় কোমল পানীয়র স্থান ওপরের দিকেই।
এই কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংক আসলেই স্বাস্থ্যসম্মত কি না, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। সেটারই ধারাবাহিকতায় নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক লোক যদি দিনে ৭৪ গ্রামের বেশি ফ্রুক্টোজ খায়, তাদের রক্তচাপ বেড়ে যায় ৩৬ শতাংশ।
আর এই ৭৪ গ্রাম ফ্রুক্টোজ মেলে মাত্র আড়াই ক্যান কোমল পানীয়তে। এ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুটিয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস রোগেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই কোমল পানীয়। কখনো কখনো দেখা যায়, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই দাঁত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।
কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, দাঁত ক্ষয়ের পেছনেও কোমল পানীয় ভূমিকা রাখে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, যেসব নারী দিনে দুটি বা তার থেকে বেশি মিষ্টি কোমল পানীয়তে অভ্যস্ত, তাদের কিডনির সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় ব্যাপক হারে।
কখনো কিডনি বিকলও হয়ে যেতে পারে। কোমল পানীয় থেকে এনার্জি ড্রিংক আরও বিপদজনক।অন্যান্য কোমল পানীয় ও স্পোর্টস ড্রিংকস থেকে এনার্জি ড্রিংকসের তফাত হলো, এতে আছে উঁচু মাত্রায় ক্যাফেইন। ক্লান্তি দূর করার জন্য ও পারফরম্যান্স বাড়ানোর জন্য এর প্রচার করা হয়।
বেশির ভাগ এনার্জি ড্রিংকে প্রতি ২৫০ মিলিলিটার ক্যানে আছে ৮০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন, কোনো কোনো ড্রিংকে আছে ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। ক্যাফেইন একটি আসক্তি তৈরি করার মতো ওষুধ, যা সাধারণত নিরাপদ মনে করা হয়। এটি কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে।
মাঝারি মাত্রায় পারফরম্যান্স, ধৈর্য ও মনোযোগ বাড়াতে পারলেও বেশি মাত্রায় গ্রহণে ক্যাফেইন ঘটাতে পারে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, পেটের অসুখ ও হার্টের ছন্দে অনিয়ম। ক্যাফেইন কাজ করে মগজের এমন এক অংশের ওপর, যা আসক্তির কেন্দ্র বলে বিবেচিত। তাই ক্রমে ক্রমে ভবিষ্যতে ক্যাফেইন পানীয়র ওপর অনুরাগ ঘটে, যেমন চিনিবহুল কোমল
পানীয় যা পরে দেহের স্থূলতাও টাইপ২ ডায়াবেটিসের পথে নিয়ে যেতে পারে। শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত বয়স হলো দ্রুত বাড়ন ও মগজের বিকাশের অন্তিম স্তরের কাল। এ বয়সে পর্যাপ্ত নিদ্রা ও সুষম পুষ্টি বড় প্রয়োজন। এনার্জি ড্রিংকের ক্যাফেইন ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় এবং পানীয়ের চিনি (প্রতি ক্যানে ৮-৯ চামচ চিনি) অনেক পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প হয়ে ওঠে। (সূত্র: নাওরাট পি ও অন্যান্য: ফুড এডিট কনটাম ২০০৩)।
বেশি ক্যাফেইন গ্রহণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে উৎকণ্ঠার জন্যই ডেনমার্ক ও ফ্রান্সে এনার্জি ড্রিংক সরাসরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশুদের কাছে এ রকম পানীয় বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নরওয়ে ও আর্জেন্টিনায় এর বিক্রি
সীমিত করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে স্টিমুল্যান্ট ড্রিংকস কমিটি প্রস্তাব করেছে, এনার্জি ড্রিংকের লেবেলে এই পানীয়টি যে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশু, গর্ভবতী ও দুগ্ধবতী নারীদের জন্য বিপজ্জনক, তা লেখা থাকা উচিত।
গবেষকেরা দেখছেন, যেসব শিশু ও তরুণ নিয়মিত এনার্জি ড্রিংক পান করে, তারা এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। ক্রমে ক্রমে বেশি মাত্রায় পানীয় গ্রহণ অভ্যাসে পরিণত হয় এবং তখন তা স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি মাঝারি মাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণও কোনো কোনো বয়সে বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এনার্জি ড্রিংক অনেক শিশুর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও অতি চঞ্চলতা সৃষ্টি করে।ক্যাফেইনের কোনো পুষ্টিগুণ নেই, তাই একে উৎসাহিত করারও তেমন কোনো কারণ নেই। বিভিন্ন দেশের অনেক বিদ্যালয়ে স্থানীয়ভাবে এনার্জি ড্রিংক সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে স্টোরে, আউটলেটে এর বিক্রি বন্ধ করা বেশ কঠিন।
অন্যান্য ক্যাফিনেটেড ড্রিংক, কফি ফ্লেভারড মিল্ক ড্রিংক ও কোলাও থাকে এর সঙ্গে। তবে দোকান বা বাজারের ওপর কেবল দোষ দেওয়া কেন? অনেক মা-বাবা বাচ্চাকে নিজেরাই কিনে দেন এনার্জি ড্রিংক। হয়তো তাঁরা জানেন না ক্যাফেইনের কুফলগুলো। তাই তাদেরকে সচেতন করতে হবে এর ক্ষাতিকর দিকগুলোর দিকে এবং স্কুল-কলেজে এনার্জি ড্রিংক নিষিদ্ধ করা সমীচীন । বাচ্চাদের আওতার মধ্যে এসব ড্রিংক যাতে না আসে মা-বাবা সেদিকে খেয়াল রাখব্নে।
ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকেরা সবার জন্য পানীয় হিসেবে ‘কেবল বিশুদ্ধ পানি’কে প্রণোদিত ও উৎসাহিত করলে সবার মঙ্গল হবে।
এত কিছুর পর প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কি কোমল পানীয় এবং এনার্জি ডিংক কি আমাদের খাদ্যতালিকা থেকে একেবারেই বাদ হয়ে যাবে?
না, কোমল পানীয় এবং এনার্জি ডিংক অবশ্যই খাওয়া যাবে, তবে তাতে অভ্যস্ত হলেই বিপদ!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:৪২