somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হতাশার কৃষ্ণগহ্বর থেকে...

২৪ শে জুন, ২০১৩ রাত ২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবনে সবকিছু পেয়ে যাওয়া একজন মানুষ আর সবকিছু হারানো একজন মানুষের মধ্যে সম্ভবত একটা বিষয়ে মিলে যায়। দুই ধরণের মানুষের জীবনেই বড় ধরণের উত্তেজনা কিংবা রোমাঞ্চ বলে তেমন কিছু থাকেনা। তাদের সব আগ্রহ তখন চলে যায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ ছোটখাটো জিনিসের প্রতি, যেগুলো আর দশটা মানুষের বিন্দুমাত্র মনোযোগ আকর্ষণ করবে না।

এই মুহুর্তে আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের দলে আছি। বেশ কিছুদিন ধরেই খারাপ সময় কাটাচ্ছি। কিন্তু খারাপ সময় কিংবা পরিস্থিতি যে আমাকে সব হারানো মানুষদের দলে নিয়ে গেছে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি আজ সকাল সাড়ে ১১টার দিকে, বাসার সামনের দোকানে চা খাওয়ার সময়। মামার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দেওয়ামাত্র গত ৫দিনে প্রথমবারের মত একটা অনুভুতি পেলাম। এক চুমুকেই মনে হল এত ভাল চা অনেকদিন খাই না- আর এটুকুতেই সাথে সাথে কেন জানি মনটা অনেক ভাল হয়ে গেল। গত ৫দিনে অনেক ভাল-খারাপ সময় পার হয়েছে, কোনটাই আমার অনুভুতিকে বিন্দুমাত্র নাড়া দিতে পারেনি। এক কাপ চা বেশ কিছু সময় পর আমার মধ্যে “মানবিক অনুভুতি” ফিরিয়ে আনলো। ভালভাবে মনে করার চেষ্টা করে দেখলাম, মাঝের সময়টাতে যত টেনশনে ছিলাম কিংবা বন্ধুদের সাথে আড্ডাতে হাসি-ঠাট্টা করেছি- তার কোনটাই নিজ থেকে আসেনি কিংবা গায়ে লাগেনি অবচেতনভাবে যতটা মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে দোকানে চায়ের অর্ডার দেওয়ার পর প্রথম চুমুক দেওয়ার আগে পর্যন্ত চায়ের কোয়ালিটি-বিষয়ক উৎকন্ঠাটুকু! এতকিছুর মধ্যেও সবকিছু বাদ দিয়ে চায়ের প্রতি এই অস্বাভাবিক মনোযোগ বৃদ্ধির একটা নিজস্ব থিওরি দাঁড় করেছি।

জীবন দেখার জন্য একটা মানুষের জীবনে সাড়ে ২৪বছর কোন সময়ই না। কিছু কিছু মানুষ ৭০বছর বয়সেও জীবনের সবগুলো বাঁক দেখতে না পারার আফসোস করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার জীবনের সাড়ে ২৪বছরেই সম্ভাব্য মোটামুটি সবধরণের চড়াই-উৎরাই আমাকে পার করে আসতে হয়েছে। আরো দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই চড়াই কিংবা উৎরাইয়ের কোনটাই স্বাভাবিক লেভেলের ছিল না, প্রত্যেকটাই মাত্রা ছাড়ানো রকমের এক্সট্রিম পর্যায়ের ছিল। সাফল্য যেমন ছিল অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য এবং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত; ব্যার্থতাগুলো (সাধারণ দৃষ্টিতে সবাই যেগুলোকে ব্যার্থতা মনে করে ওই হিসেবে বললাম। আমি যেভাবে জীবনকে সংজ্ঞায়িত করি, সে হিসেবে সবগুলো ব্যার্থতা না, কিছু কিছু জীবনের “শিক্ষা”) ছিল নির্মম, অমার্জনীয় এবং অসহনীয়। আগের বাক্যে ব্র্যাকেটের ভিতরের লেখাগুলো পড়ে ভুলেও ভাববেন না আমি নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে দেখাতে চাচ্ছি, নিজেকে অনেক বড় ‘মাল’ হিসাবে দাবী করছি। আমি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই। সব মানুষেরই নিজেদের কিছু ধ্যান-ধারণা-দর্শন থাকে জীবন নিয়ে, জীবনে সাফল্য-ব্যার্থতা পরিমাপের কিছু মাপকাঠি থাকে। আস্তে আস্তে সবাই দৈনন্দিন জীবন কিংবা বাস্তবতার তাগিদে সেই নিজস্ব মানদন্ডটার কথা ভুলে যায়, আশেপাশের সবাই যে মানদন্ডটাকে ‘আদর্শ’ ধরে নেয়- সেটারই দাস হয়ে যায় নিজের অজান্তে। আমার আশেপাশের মানুষগুলোর সাথে আমার পার্থক্য হচ্ছে আমি পারিপার্শ্বিক চাপে নিজের জীবনদর্শন থেকে সরে আসিনি, নিজের মর্জিতেই নিজের জীবন চালানোর চেষ্টা করছি পরিবেশের চাপকে অগ্রাহ্য করে, জীবনের সাফল্য-ব্যার্থতার মানদন্ড আর দশজনের সাথে না মিলিয়ে নিজের মানদন্ডেই অটল আছি (যদিও কতদিন থাকতে পারবো জানি না, গত ক’দিনে বিশ্বাসে বেশ বড় ধরণের চিড় ধরেছে)। ঘোলাটে কথা না বলে পরিষ্কার উদাহরণ দিলে মনেহয় ভাল হবে। আমার বয়সী আর ছেলেপুলেরা যখন গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এক-দেড় বছর চাকুরি করে বেশ ভাল একটা ভবিষ্যতের দিকে গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমি এখনো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করিনি। আগামী এক বছরেও শেষ করবো কিনা বলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস কিংবা উদ্বেগও নেই। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে অপ্রত্যাশিত রকমের ভাল ফল করেছিলাম, ওগুলো নিয়েও কোন আত্মতুষ্টি ছিলনা কখনো। এখন পর্যন্ত কোন আয়-রোজগার নেই। বাসায় অকল্পনীয় পরিমাণে অর্থসংকটের মধ্যেও বাসার সাপোর্ট নিয়ে চলছি এখনো। টাকা-পয়সা কিংবা স্বচ্ছলতা কখনোই আমাকে আকর্ষণ করেনি যদিও টাকা-পয়সা কিংবা আর্থিক স্বচ্ছলতা জীবনে কতটা প্রয়োজন সেটা শৈশবেই বেশ ভালভাবে জেনেছি এবং এখনো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বৈষয়িক দিক দিয়ে আমি কতটা ‘ক্রিমিনাল লেভেলের’ উদাসীন তা উপরের ২-৩লাইনেই বুঝাতে পেরেছি আশা করি। জীবনে টাকা-পয়সাকে কারেন্সী না ধরে যে জিনিসটাকে পরম আরাধ্য মনে করেছি তা হচ্ছে বিশ্বাস। মূলধন হিসাবে অকাতরে ‘বিশ্বাস’ বিনিয়োগ করেছি আশেপাশে এবং এই কয়টা দিন আগেও বেশ ভালরকমের ‘লাভ’-ই তুলে এনেছি। কয়দিন আগেও আমার ‘বিশ্বাস’ মার খায়নি। কারো অমঙ্গল করিনি, কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি, কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না আমি তার অনিষ্ট করেছি। এমনকি কারো সাথে বাজে ব্যাবহারের নজিরও বিরল, কখনো করে থাকলেও পরে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি দোষ যে পক্ষেরই হোক না কেন। বিনিময়ে পেয়েছি আশেপাশের মানুষদের অঢেল ভালবাসা যার এক-চতুর্থাংশেরও যোগ্য বলে আমি নিজেকে মনে করিনা। বৈষয়িক দিকে মানবেতর অবস্থায় থাকলেও প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি ভালবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে বেশ ভালই কাটছিল সবকিছু। তাহলে হঠাৎ এভাবে একইসাথে সব কেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। মানুষ হিসেবে পারফেক্ট না হলেও জঘণ্য রকমের খারাপ তো আমি না! তাহলে যাদের জন্য আমি সব করতে রাজি ছিলাম, যারা আমার প্রয়োজনে বন্দুকের সামনে দাঁড়াতেও ভয় পাবে না বলে জানতাম তারা কেন আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? আমি-ই বা কেন সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না? সবকিছু একসাথে ভেঙ্গে পড়ার কি দরকার ছিল?

সারাজীবন অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করেছি, বিশ্বাসের দূর্গটায় কখনো আঘাত আসেনি। যত বড় বিপদই হোক না কেন, ওই বিশ্বাস আর ভালবাসার দূর্গটা ছিল সব বিপদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু এখন বাইরের যুদ্ধ সামলে ক্লান্ত মন সেই পুরনো দূর্গে আশ্রয় নিতে এসে যখন দেখে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে দূর্গ হাতছাড়া হয়ে গেছে, প্রাসাদের ভিতরের কারো কূটচালে শেষ ফ্রন্টিয়ারে আমি যুদ্ধে নামার আগেই হেরে বসে আছি- তখন সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনকিছুরই মূল্য থাকেনা। উদ্ভ্রান্তের মত উদ্দেশ্যহীন হেঁটে যেতে যেতে পথের ধারে নীল ঘাসফুলই তখন পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য নিজের মধ্যে ধারণ করেছে বলে মনে হয়। আমার ক্ষেত্রে খুব সম্ভবত এটাই হয়েছে। সব আশা-আকাঙ্খা-স্বপ্ন কিংবা উৎকন্ঠার জায়গা দখল করে নিয়েছে এক কাপ চায়ের স্বাদ চাখার ব্যাকুলতা। ব্যাপারটা বুঝতে পারার পরপরই মনে হল সবকিছু হারালেও জীবন এখনও শেষ হয়ে যায়নি! আমাকে পরাজিত করতে “জীবন” এর আরো প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হবে। জীবনের সাড়ে ২৪বছর পর সবকিছু ‘শূন্য’ না বরং ঋণাত্মক অবস্থান থেকে শুরু করতে যাচ্ছি জেনেও যেই মানুষ এক কাপ চায়ের মধ্যে জীবনের সব সুখ খুঁজে পায়, নির্লিপ্ত ৫দিন পর নিজের বোধ ফিরে পায়- তাকে পুরোপুরি কাত করতে হলে নিয়তিকে আরো ঘাম ঝরাতে হবে।

সাগরে পড়ে আছি, জানি একদিন না একদিন কুলে ভিড়বোই। সমস্যা একটাই- আশেপাশে খড়-কুটোর টিকিটাও দেখছি না।
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×