সকালে মায়ের তাড়া খেয়েই প্রতিদিন ঘুম ভাঙ্গে। সেদিনও ভাঙ্গল। মায়ের ডাকাডাকি এলার্ম ঘড়ির মতো বাজতেই থাকে। না উঠা পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না। উঠে দেয়াল ঘড়িতে চোখ পড়ল, সাড়ে ন'টা বাজে। বন্ধের দিন হিসেবে একটু তাড়াতাড়িই। টুথব্রাশ হাতে নিয়ে বসে বসে চ্যানেল আই সংবাদের শেষ অংশটুকু শুনছি। মা ক্রমাগত তাগদা দিয়ে যেতে লাগলেন সকালের নাস্তার। সকালের নাস্তাটা কেন যেন আমার গলা দিয়ে নামে না। চা'টুকুই ভালো লাগে। নাস্তা শেষে দ্বিতীয়বারের মতো চা চেয়ে নিলাম। মা চা দিতে দিতে বলতে লাগলো, সকালে সানি ফোন করেছিল।
- হুমম। কি বললো?
- কিছু না, এমনি কথা বললো কিছুক্ষণ। দেশে ঘুরে যাওয়ার কথা বলছিল বারবার। বলেই ব্যাস্ত সমস্ত হয়ে ফের রান্নাঘরে চলে গেলো। খানিক বাদেই ফিরে এলো নিজের জন্য আরেক কাপ চা হাতে। এসেই পাশে বসল। ওর জন্মদিনে কী কী করব তাই বলছিল।
আমি হাসলাম, তুমি কি বললা?
- কি বলব! ও কাছে থাকলেই না কিছু করার কথা উঠত। আর তোর ব্লগ না ফ্লগ, সেখানে নতুন লেখা দিতে বলল। আমি কিছু বললাম না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মা বলতে থাকে তার কোলপোছা আদরের ছেলের কথা, 'আর বলল দেশে আসলে ভাইয়ারা যেনো তোমাকে মা না ডাকে।' আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, সেকি! কেনো?
- এতদিন তোরা ডেকেছিস ও পারে নাই সেজন্য। ও আসলে শুধু ওই মা ডাকবে।
আমি হাসলাম মাত্র। চুপচাপ চা শেষ করে উঠলাম। আমি জানি ও আমার লেখাগুলো নিয়মিত পড়ে এবং কখনো সখনো নতুন লেখার জন্য তাগাদাও দেয়। বেশ ক'দিন ধরেই ব্লগে নতুন কিছু লেখার তাড়না অনুভব করছি। কিন্তু ব্লগে ঢুকেই নতুন নতুন সব চমৎকার লেখা পড়ছি, মন্তব্য করছি, নিজের ব্লগের মন্তব্যের উত্তর দিচ্ছি কিন্তু নতুন ব্লগ লিখুন ট্যাব খুললেই আমাকে বোবায় পেয়ে বসে। কী বোর্ডের উপর আঙ্গুল গুলোকে বড় অসহায় মনে হয়। সময় পেরিয়ে যায় কিন্তু আদতে কিছুই লেখা হয় না। আজ লিখতে বসে যখন কি লিখব তাই ভাবছি তখন বহু আগেকার একটা দৃশ্যের কথাই কেবল মনে পড়ছে। একটা ছোট্ট শিশু বাটিতে দেয়া মুড়িগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে হামা দিয়ে দু'আঙুলে একটা একটা করে মুড়ি তুলে মুখে পুরছে। ছোট ছোট নরোম আঙুলে মুড়ি খুঁটে খুঁটে মুখে পুরবার সময় তাকে যে কী সুন্দর দেখায়! মুড়ি খাওয়ার ফাঁকেই মাঝে মাঝে মুখ তুলে আপনজনের ভঙ্গিতে হাসে। কেনো যেনো আজ সেই সুন্দর দৃশ্যটার কথাই খুব মনে পড়ছে। একটু ভাল করে ভাবলে শিশু শরীরের সেই সুগন্ধটাও যেন পাওয়া যায়।
কারো জন্মদিনে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে কিছু কথা গুছিয়ে লিখতে হয়। অবশ্য গুছিয়ে কিছু লেখা আমার কখনোই হয় না। একসময় এক কাজিন কে খুব চিঠি লিখতাম। বিশাল বিশাল সেসব চিঠি। সেসব চিঠি ভুল করে অন্য কারো হাতে পড়ে গেলে কী হাসাহাসিই না হতো। আজ যখন ছোট ভাইটিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কিছু কথা লিখব ভাবছি তখন কেনো যেন কোন কথাই আসছে না। দু'টো লাইন লিখি আর ভাবি কী লেখা যায়। সুন্দর শব্দহীনতায়, প্রকাশ ভঙ্গির ব্যর্থতায় নিজেকে খুব অসহায় লাগে। মুক হয়ে বসে থাকি। মনে পড়ে এক ছোট্ট শিশুর দু'আঙুলে মুড়ি খুঁটে খাওয়া। সরল হাসি।
হয়তো ফেসবুকে বন্ধুদের শুভেচ্ছার জবাব দিয়ে, ইয়াহু মেসেঞ্জারে আলাপচারিতায়, মুঠোফোনে কোন দয়িতার সাথে অন্তরঙ্গ ফোনালাপে দিনটা বেশ কেটে গেছে ওর। তারপর হয়তো সন্ধ্যায় টেমস নদীর পাড়, এলোমেলো ঘুরে নিঃসঙ্গ ঘরে ফেরা। বহুকাল আগের সেই শিশু আঙ্গুলের তরুন ছেলেটি আপন ডায়রীতে নিশঃব্দে এঁকে দেয় কিছু বিষন্নতার ছোপ। 'মা তোমাকে যেন ভাইয়ারা মা না ডাকে'।
সেই করুন বিষন্নতা যেন ভর করে এক মধ্যবিত্ত ঘর। সে জানেও না তার বড় ভাইটি অফিস থেকে ফিরবার পথে বড় ভুল করে নিয়ে আসে সামান্য কেক। সেই কেক অনাদরে পড়ে থাকে শুন্য টেবিলে। বারান্দায় সন্ধ্যার অন্ধকারে ছায়ামূর্তীর মতো গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কোন মায়ের চোখে যখন অবিরল জল ঝরে তখন এই আমি কী করে লিখি শুভেচ্ছা জানিয়ে সুন্দর কোন লেখা!