খুব ছোট বেলা থেকেই আমি বড় সোহাগ কাঙাল। মনে আছে সেই আট-ন'বছর বয়সে একবার টানা ছ'সাত দিন জ্বরে ভুগেছিলাম। সারাদিন কাঁথা গায়ে পড়ে থাকতাম। বাবা অফিসে, আমাকে ফেলে ভাইয়া স্কুলে, মা সংসারের কাজে ব্যস্ত। সারাটা সকাল জ্বরো শরীর নিয়ে একা একা শুয়ে থাকা। কখনো গা কাঁপিয়ে জ্বর এলে আধো চেতনার মাঝে যখন ডুবে যেতাম, স্বপ্নের মতো অবাস্তব মনে হতো সব কিছু। তপ্ত চোখ খুললেই জল গড়িয়ে পড়ত। কানে সমুদ্রের শোঁ শোঁ শব্দের মতো একটানা শব্দ। রান্না ঘরে মায়ের খুটখাট আওয়াজে বুক ভরে অভিমানের জল ঢুকত। মা কেন গায়ে হাত রেখে পাশে বসে থাকে না! মনে মনে কতো অভিযোগ তৈরী করে নিতাম। একটু এসে ফ্যানটা ছেঁড়ে দিলে কি হয়? বেয়াড়া রোদে পর্দাটা একটু টেনে দিয়ে যেতে পারে না? একটু এসে কপালে হাত রাখতে নেই? আরও কত কত অকারণ অভিযোগ! এসব ভাবতে ভাবতেই নিঃশব্দ পায়ে কখন একটু নিরোপরাধ ঘুম চলে আসে। সময়জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। হঠাৎই কপালে কারো ঠান্ডা স্পর্শে চমকে উঠি। জেগে দেখি - মা!
মা কপালে হাত রাখে, বলে, এখনো তো গায়ে গায়ে জ্বর আছে, কিছু খাবি? আমি মুখ ফিরিয়ে নেই। বুক চেপে ধরে শিশু অভিমান। অনেক অভিযোগ আর অভিমানে গলা বুঝে আসতে চায়। মাথা নেড়ে জানাই, না। জ্বরের ঘোরে আমার তপ্ত চোখের কোনা বেয়ে জল নামে। আমার সেটুকুকে কান্না বলে ভাবতে স্বাদ হয়।
মাথায় একটু পানি দিয়ে দেই বলে মা পানি ভরা বালতি নিয়ে আসেন। মাথার নিচে পাতলা অয়েলক্লথ বিছিয়ে মগে করে পানি ঢালতে থাকেন অনেকটা সময় নিয়ে। তন্ময় হয়ে ঝর্ণাধারার মতো গড়িয়ে পড়া জলের শব্দ শুনি। সেই জলের মুখর শব্দে আমার সমস্ত অভিযোগ, বুক ভরা অভিমান ধুয়ে মুছে যায়। কাঙালের মতো দু'টো হাত বাড়িয়ে দেই। মা বুকে তুলে নিয়ে মাথা মুছে দিতে দিতে বলেন, একটু দুধ দিয়ে ভাত খাইয়ে দেই। মায়ের বুকে মুখ গুজে দিয়ে বুক ভরে পরিচিত সুঘ্রাণ নেই। আমার ঠোঁট কেঁপে উঠে, বলি, হুঁ। সেই ছোট বেলা থাকেই আমি যে বড় সোহাগ কাঙাল।
এই সোহাগ কাঙাল আমিও যে এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে ফিরি আমার মা- বাবা, দুই ভাই, প্রিয় পরিজনদের এর জন্য। এই ব্লগেই বহুবার বলতে চেয়েছি আমার সেই অকথিত ভালবাসার কথা। কিছুই বলতে পারিনি। হয়তো পারব না কখনো।
মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়। অফিসের গাড়ীতে অনেকটা পথ ঘুরে বদ্দারহাট হয়ে আগ্রাবাদ। ঘন্টাখানেকের যাত্রা শেষে ফের ভীড়ের বাস ধরতে হয়। সেও বিশ মিনিটের ধাক্কা। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসতে চায়, তবু বাসায় ফেরার বড্ড তাড়া। মা ভাত নিয়ে বসে আছেন। অত রাতে বড় রাস্তার মোড়ের দোকানের সামনে বাবাকে সিগারেট টানতে দেখে ভেতরটা ভীষণ দুলে উঠে। ভিতরে স্রোতস্বিনীর মতো কলকল শব্দ হয়। ছেলের অপেক্ষায় থাকা অসহায় আমার বাবাকে সেই নিঝুম রাত্রিরে বড় ভালো লাগে। ইচ্ছে হয় দুটি ভালো মন্দ কথা বলি। পারি না। ধমকে উঠি, কেনো এত রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করো? বাবা অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে থাকে। বাবা কি শুনতে পায় আমার ভিতরকার সেই কলকল স্রোতের শব্দ?
শুধু বড় ভাইকেই কিছু বলার দরকার পড়ে না। ও হয়তো আমার ভেতরকার অনেক কিছুই টের পায়, যেমনটা পাই আমি। পিঠাপিঠি বলেই হয়তো। আর আমার ছোট ভাই, যে ছিল আমদের সবার ভীষন প্রিয় আর আদুরে। ও দেশে থাকতে আমার কাপড় আয়রন থেকে শুরু করে রাতের মশারি টাঙানো নিয়ে কখনো চিন্তা করতে হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে। মায়ের সাথেই ওর কথা হয় বেশি। আমার সাথে কথার বেশির ভাগ জুড়েই থাকে খেলা নিয়ে, কখনো কখনো দেশের পরিস্হিতি নিয়েও টুকটাক আলোচনা হয়। কত এলোমেলো কথায় সময় ফুরিয়ে যায়, ও ফোন রেখে দেয়। আমার জমিয়ে রাখা ভালবাসার কথা গুলোই শুধু বলা হয় না। বিদেশ যাবার পর কতদিন ওর কথা ভেবে রাতের শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি চোখে জলের ছায়া নিয়ে। সেই জলের অস্তিত্ব টের পেয়ে রাতের নিঝুম গাছেরা, সুরম্য দালান, নিঃসঙ্গ ল্যাম্পপোষ্ট মুক হয়ে থেকেছে।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমার অকথিত ভালবাসার কথা জানে এই শহর, আমার চতুষ্কোণী ঘর, বিছানা-বালিশ, বোবা ডায়রী। জানে না শুধু আমার প্রিয় প্রিয় মানুষেরা। হয়তো কখনো জানানো হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৩:০৮