পূর্বানুমান ক্ষতিকর, মাঝে মাঝে বিভ্রান্তিকর এবং এক ধরণের ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কম না। যৌন বিষয়ক ট্যাবুর ভেতরে বেড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত বাঙালী যারা অন্তর্জালে ঘুরাঘুরি করে এবং বিভিন্ন ব্লগে বিভিন্ন সময়ে নাকিসুরে অনুযোগ করে এদের অনেকের ভেতরের যৌনবুভুক্ষু মনোভাব ব্লগের অক্ষরে অক্ষরে ঠিকরে বের হয়। এরা সংখ্যালঘু হলে বিষয়টা স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া যেতো, তবে বাস্তবতা হলো এরাই সংখ্যাগুরু এবং খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের বাইরে এসে তারা নারী পুরুষের সম্পর্ককে দেখতে এখনও অভ্যস্ত না।
নারি এবং পুরুষের ভেতরে বন্ধুত্ব না হোক পারস্পরিক সম্মান ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে এক ধরণের স্বাভাবিক সম্পর্কও যে সম্ভবপর এটা তাদের নিরেট মস্তিস্কে কখনও ঢুকে না। অধিকাংশ ধনীর সন্তান ইংলিশে মিডিয়ামে পড়ে, অধিকাংশ ধনীর সন্তান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, তাদের বেলেল্লাপনা এবং ইতংবিতং শাররীক সম্পর্ক বিষয়ে কল্পনার রোমাঞ্চ এই মানুষেরা ত্যাগ করতে পারে না। এই রোমাঞ্চ নিয়েই তারা তাদের যৌনহতাশা এবং তাদের শ্রেনীঘৃণা প্রকাশ করে।
আজ জাগো ফাউন্ডেশনের ফান্ড রেইজিং ক্যাম্পেইনে অনেক কিশোর কিশোরী অংশগ্রহন করেছে, তাদের অধিকাংশই দারিদ্র দেখে নি, কৈশোর কিংবা তারুণ্যের আবেগে তারা ভেবেছে এভাবেই পৃথিবীটাকে বদলে দেওয়া সম্ভব, তারা বছরে একটা দিন পথশিশুদের বদলে নিজেরাই ফুলহাতে রাস্তায় নেমেছে, এবং তাদের বক্তব্য পৌঁছে দিতে তারা অন্তত সফল , যে মানুষগুলো আগে কখনও ফুল হাতে কিংবা সওদা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা পথশিশুর দিক মুখ তুলেও তাকাতো না, তারা আজ আগ্রহ নিয়ে ফুল কিনেছে, তাদের স্বভাবের এই বৈপিরিত্য তারা হয়তো তাৎক্ষণিক উপলব্ধি করতে পারে নি কিন্তু আমাদের শ্রেণীবিভাজিত সমাজে আমরা দরিদ্রদের মানুষের মর্যাদা দেই না এই সত্যটুকু আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক আচরণেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সে বাস্তবতাটুকু চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পেরেছে তারা।
আজ তারা সারা দিনে ফুল আর অন্যান্য সওদা বিক্রী করে যা পেয়েছে তা তারা গতবারের মতো পথশিশুদেরই ফেরত দিবে, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রচারণাটাও হয়তো সফল হবে। গতবারও তারা এমন উদ্যোগ নিয়েছিলো, তবে তা তেমনভাবে প্রচারমাধ্যমে আসে নি।
গত দুই দিন ধরে পত্রিকায় নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমানের মৃত্যুর ধারাবাহিক বিলাপ চলছে, তারা মৃত্যুর বিভিন্নমুখী আবেগী উপস্থাপন, পরিচিতজনের বিলাপ এবং সাধারণের বিক্ষোভের সাথে রাজনৈতিক অন্তর্কোন্দলের সংবাদগুলো উপস্থাপিত হচ্ছে প্রতিটি পত্রিকায়। লোকমান নরসিংদির দৃশ্যমাণ উন্নয়নের জন্য যথাসাধ্য করেছেন, তার উদ্যোগ এবং আন্তরিকতার ফলাফল হিসেবে তিনি দুই বার শ্রেষ্ঠ পৌর মেয়রের স্বর্ণপদক জিতেছেন। স্বর্ণপদক তার উন্নয়ন প্রয়াসের মৃদু স্বীকৃতি।
তবে একই সাথে চমৎকারভাবে আড়াল করে দেওয়া হয়েছে একদা ছাত্রলীগের ক্যাডার হিসেবেই রাজনীতিতে উত্থান ঘটেছিলো তার, অস্ত্রের সক্রিয় ব্যবহার পরবর্তীতে না করলেও তার পেছনে একটা সন্ত্রাসের দাগ রয়েই গেছে। প্রথম আলো গডফাদার শামীম ওসমানের বিরুদ্ধাচারণের সাথে সাথে লোকমানের মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসায় মূলত জনগণের ভাবনাটুকুই কিংবা জনগণের ধারণার অন্তসার:শূণ্যতাটুকুই প্রকাশ করেছে।
আমাদের ভাবনার অগভীরতায় আমরা যেভাবে দৃশ্যমান উন্নয়নের ঝলক দেখে অতীত ভুলে যাই, আমরা যেভাবে একজন সন্ত্রাসীকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে আশাবাদী হয়ে উঠি তিনি জনদরদী হয়ে উঠবেন, তিনি শিক্ষিত রুচিসম্মত আচরণ করবেন, এই ধরণের চলমাণ বিভ্রান্তি নিয়েই আমাদের বসবাস।
সেই মানসিকতার মানুষজনেরাই ব্লগে ঘুরাঘুরি করে, তারাই যৌনকাতর হয়ে এইসব ধনীর দুলালদের সাময়িক দারিদ্রের অভিনয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে, আমি বরং উল্টো এতে আশার ঝলক দেখি।
নিজেকে বদলে পরিবর্তন শুরু করতে হয়, এরা অভাব দারিদ্র দেখে নি, যেসব প্রতিষ্ঠানে এরা পড়ছে তা ব্যয়বহুল এবং নিজেদের পয়সায় এরা টি শার্ট ছাপিয়ে জার্সি বানিয়ে প্রচারনায় নেমেছে, এরা পথশিশুর অভিনয় করছে, এবং বেশ চমৎকার শোভন আচরণ করেছে। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে অন্য সকল কিশোর কিশোরী তরুণ তরুণীদের মতো প্রেম ভালোবাসা আছে, তারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রেমিক প্রেমিকার সাথে ঘনিষ্ট হয়, চুমু খায়, প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে , কিন্তু সেটা তাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের গল্প।
এদের ভেতরে ততটা ছ্যুৎমার্গ নেই, এরা বন্ধুর হাত ধরলে ভাবে না এই বুঝি বন্ধু তাকে নিয়ে বিছানায় যাবে, কিন্তু অন্য সবাই এইসব দেখে পরবর্তী নীল আলোর যৌনদৃশ্যটা কল্পনা করে শীর্ষসুখের শীৎকারসমেত ব্লগ লিখে ফেলে। যারা এখনও নিজেদের ভেতর থেকে এই যৌনকাতর যৌন অভিলিপ্সাটুকু কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ, যাদের কোনো মেয়ের হাত ধরলেই কল্পনা পিছলে এখনও মেয়ের বুকের দিকে ছুটে যায় তারা এর বাইরে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া অনুমাণ করতে ব্যর্থ হবে।
আমার জন্মের পর পৃথিবীতে আরও ২৭৫ কোটি মানুষ জন্মেছে, তারা আগামী ১০ বছরের ভেতরেই তরুণ হয়ে উঠবে, এইসব তরুণেরাই পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, এরাই সমাজটাকে বদলে দিতে চায়, তারাই সকল অতীতের কুসংস্কার এবং বিকৃত ভাবনাকে দুরে সরিয়ে দিতে চায়, এদের দিকেই আশাবাদী হয়ে তাকাতে হয়। তবে এইসব তরুণদের অনেকেরই অপশিক্ষা কিংবা কুশিক্ষায় ভাবনা যৌনাঙ্গের গোড়ায় আটকে আছে, তারা শিশ্নের বাইরে কিছু ভাবতে পারছে না, সেইসব তরুণেরা আরও অনেক কালই এমনই যৌনশিহরণে ভুগে ভুগে শীর্ণ হয়ে যাবে, অন্য সবাই সুস্থ স্বাভাবিক কল্পনা নিয়ে জীবনযাপন করবে, তারা পরিবর্তনের হাল ধরে একটা সুন্দর পৃথিবীর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।
আজকের জাগোর কিশোর কিশোরীদের ফুল বিক্রী এবং পথশিশুর অভিনয়টা হয়তো রাতারাতি সবকিছুই বদলে দিবে না, কিন্তু এর মাধ্যমে তারা সমাজের অসাম্যের বিরুদ্ধাচারণ করছে, তারা অসাম্যটাকে স্বীকৃতি দিয়ে পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়ে উঠছে এই পাওয়াটুকু কম নয়।
এরা ক্যান্সারাক্রান্ত শিশুদের জন্যও কাজ করছে, এরা বিভিন্ন সময়ে অসুস্থ এইসব শিশুদের সাথে বিকেল সন্ধ্যা কাটিয়ে আসে, সেইসব হাইপ্রোফাইল সামাজিক উদ্যোগগুলো পত্রিকায় আসে না, এইসব না করে তারা কেনো ফুটপাতের বাচ্চাদের হাগু সাফসুতারা করছে না, কেনো তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পতিতাদের হয়ে একদিন খদ্দেরসেবা করছে না জাতীয় আবাল আব্দার যারা করছেন তাদের লোকদেখানো সমাজকল্যান উদ্যোগের নেপথ্যেও কোনো না কোনো বদভাবনা আছে।
যে মানুষ এখনও নিজের ভেতরের পশুটা দমন করতে পারে নি, যে মানুষ নিজের রিপুর ভারে আগাতে পারছে না, সে মানুষ মানবকল্যানে আন্তরিক ভাবে কাজ করতে পারবে না, দেখা যাবে দরিদ্র কোনো নারীর সুঠাম শরীর দেখে সমাজকল্যানের নামে সেও একটা সময় নিজের যৌন অভিলাষ চরিতার্থ করবে যেমনটা ঘটে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে, ৭৪ এর দুর্ভিক্ষে যারা অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, পাওয়া গিয়েছে ৮৮ র বন্যায়। এইসব মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমাজ কল্যান করার বদলে আমি বরং জাগোর সাথে থাকটে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো। অন্তত তারা এইসব সামাজিক গলদভাবনার যুপকাষ্ঠে এখনও বলি হয়ে যায় নি।
ধন্যবাদ এইসব কিশোর কিশোরীদের।