ঢাকা আমার প্রিয় শহর অন্তত পৃথিবীর যেকোনো শহরের তুলনায় ঢাকা আমাকে বেশী টানে। এখানের জীবনের গতি , এখানে অকারণ ব্যস্ততা, এখানের ছলনা এবং এখানের নানামাত্রায় বিভক্ত সামাজিক সম্পর্ক আর এদের উত্থান-পতন প্রতিদিনই রোমাঞ্চকর কোনো উপন্যাস পাঠের অনুভুতি দেয়।
আমি ইদানিং কোনো গল্প উপন্যাসে মন বসাতে পারি না, এই নেশাই আমাকে বুঁদ করে রাখে। আমি দিনরাত এইসব সম্পর্কের ভেতরে থাকি, মানুষের গল্প পড়ি, প্রতিদিন নতুন নতুন মুখ সামনে আসে। তাদের চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখে। হয়তো কোনো মানুষের হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তাকানোর দৃশ্যটা করোটিতে লেপ্টে যায় আজীবনের জন্য।
হঠাৎ একদিন মহাখালীর ৬ নম্বর বাসে একজনকে দেখলাম, বিশেষত্বহীন সাধারণ একজন। তখন সমস্ত শহর রোদে তেতে আছে। আমরা পাতলা টি-শার্ট পড়ে ঘেমে নেয়ে একশা। এর ভেতরে একজন হঠাৎ করেই বাসের গেটের সব ভীড় ঠেলে উঠলো। তার পরণে হালাকা চাদর। মুখে ব্রণের দাগ, চোখের নীচে না ঘুমানোর কালি। ঠোঁটে রাজ্যের বিরক্তি। আর চেহারার পোড় খাওয়া ভাব। দেখেই বুঝা যায় জীবনের সবকটা অন্ধকার আর উজ্জ্বল গলিতে তার পা রাখা শেষ।
বাসের সীটের হাতলে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিলো। ঢাকার রাস্তা, বিশেষ করে মহাখালীর রাস্তার পীচ এই সামান্য গরমেও গলে গলে যায়। রাস্তার রেখাগুলো বাঁকাচোরা। জেব্রাক্রসিং দেখে মনে হয় জলের উপরে জেব্রা ক্রসিংএর ছায়া দেখছি।
রাস্তায় অহেতুক ভাংচুর। বাসযাত্রা অনেকটা পাহাড়ী রাস্তায় গরু গাড়ী হাঁকানোর মতো। বাস দুলছে, বাসের ভেতরে থাকা যাত্রীরা দুলছে, মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সহযাত্রীর গায়ের উপরে। এই ভীড়ে মহিলা যাত্রীর গায়ে হাত বুলানোর সুযোগ থাকে এবং সুযোগ সন্ধানীও থাকে।
একটা জোরালো শব্দ আর গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিহবল যাত্রী, গল্পটা ভীড়ের ভেতরে অনুমাণ করে নেওয়া যায়।
তবে নিয়মিত জীবনটা নেহায়েত একঘেয়ে হয়ে গেছে। প্রতিদিন প্রায় একই রকম জীবন যাপন। এক একটা দিন প্রতিদিন ফটোকপি করে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা। সেই সকালে উঠে বাসের লাইন, সেই একই মুখ, সেই একই সমৃদ্ধির সংগ্রাম। সেই একই কলিগ- কলিগের হানাহানি, সেই একই রাস্তায় বাড়ী ফেরা, সেই একই গালাগালি, একই গলাগলি। মাঝে মাঝে মাত্রা বদলায়, তবে মোটামুটি জীবনটা এরকমই, ফটোকপি করে রাখা।
ফটোকপি করে করে জীবনের রঙ ঝাপসা হয়ে যাওয়ার আগেই আসলে একটু পরিবর্তন প্রয়োজন ছিলো। তাই অনুরোধ পাওয়া মাত্রই রাজী হয়ে গেলাম। আর পরিস্থিতিও অনুকূলেই ছিলো। বাসার সবাই যাবে দাদা বাসায়। সেখানে আমাকে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নাই।
উঠলো বাই তো কটক যাই অবস্থায় খুব সকালেই রওনা দিলাম। অবশ্য খুব সকাল আমার হিসাবের সকাল। যখন আমি ঘুম থেকে উঠি তখন মোটামুটি শহরের রাস্তার ব্যস্ততা চরমে উঠে, সেই ব্যস্ততার ভেতরেও রাস্তা ডিঙানো। ছুটির দিনেও এত মানুষ কেনোই বা রাস্তায় থাকবে, নাকি সবাই আজকের দিনে আমার মতো নিরুদ্দেশ যাত্রায় যেতে চায়।
কোনো কন্সপিরেসী থিওরী কি আছে এর পেছনে। আজকে আমি রাস্তায় নেমেছি বলেই সবার এই রাস্তায় অহেতুক ঘোরাঘুরির বাতিক চেপেছে? নিয়মিত এই প্রশ্নটা আমি নিজেই নিজেকে করি। ঢাকা থেকে প্রতিটা গন্তব্যে প্রতিদিন অন্তত ২০ টা বাস যায়। কোনো বাস কিংবা ট্রেন কিংবা মিনিবাস কিংবা টেম্পু আমি খালি যেতে দেখি না। সবাই ভর্তি যাত্রী নিয়েই যায়। আবার আসবার পথে ভর্তি যাত্রী নিয়েই আসে।
যেকোনো একটা দিনে ঢাকা থেকে মোট বাইরে চলে যাওয়া মানুষ এবং ঢাকায় ফেরত আসা মানুষের সংখ্যা সমান। বরং এমনটাও হতে পারে প্রতিদিন ঢাকায় আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, প্রতিদিন শহরের মানচিত্রে নতুন আঁচঅর লাগছে, নতুন নিঃশ্বাস পড়ছে।
যেকোনো যাত্রার একটা উদ্দেশ্য থাকে। এখানেও একটা আপাতগন্তব্য ছিলো। তবে মূল গন্তব্য আরও দূরে। অন্য কোথাও।
অনেক রকম চিন্তা ভাবনা শেষে ঠিক হলো বাসেই যাবো। অন্তত কিছুটা সময় বাঁচবে। যাত্রা শুরুর আগেই গন্তব্যে পৌঁছানো এবং সেখান থেকে ভদ্রজনোচিত সময়ে ফেরত আসবার বিষয়টা নিশ্চিত করতে চাইছিলাম। আপাতত যেখানে যাবো এই জ্যামক্লিষ্ট শহর থেকে সেখানে পৌঁছানোর ন্যুনতম সময় ৪ ঘন্টা। বিকল্প যা আছে তাতে অনেক রকম যানবাহনের ব্যবহার থাকলেও সেটা আমাদের অন্তত ৪০ মিনিট সময় বাঁচাবে।
অবশ্য সম্পূর্ণ ধারণাটাই হোটেলে নাস্তা করতে করতে পাওয়া। সেখানের কর্মচারীর দৃঢ় বক্তব্য শুনে তারই নিশ্চয়তায় উঠে পড়লাম বাসে। অন্তত যানবাহনে উঠে পড়লে বিকল্প অন্যকিছু ভাববার সুযোগ নেই। চুপচাপ বসে আছি। আমাদের কথাবার্তা শুনে সবাই কিঞ্চিত বিরক্ত।
সকাল থেকেই মেঘ আর বৃষ্টি তাড়া করছে আমাদের। যখনই কোনো ভীড়ে আটকে পড়ি বৃষ্টি ঝাপিয়ে পড়ে , আমি বাসের জানাল লাগিয়ে গরমে সিদ্ধ হতে থাকি। আবার যাত্রা শুরু হয়, বাস বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে রাস্তা পেরোয়। কোথাও থামলেই বৃষ্টি হামলে পড়ে।
বৃষ্টির সাথে লুকোচুড়ি খেলতে খেলতে অনেকটা পথ পার হয়ে আসলাম। এখন আর পিছে যাওয়ার রাস্তা নেই। হোটেলের কর্মচারীর কথার সত্যতা নির্ণয়ের সময় চলে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের অন্বিষ্ঠ গন্তব্য আদৌ বাসে যাওয়া যায় কি না। তারা ৩ জন পথের হদিশ দিলো। বাসের কন্ডাক্টর, আর দুই সহযাত্রী, তারা কোথায় নাম্বে জানি না। আমার জন্য এটা এই রাস্তায় প্রথম আগমন।
অন্ধের সঙ্গী আরেক অন্ধ। তবে কন্ডাক্টর নিশ্চিত করলো সে আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। সেই মতো আমাদের নামিয়ে দিলো, একটা রিকশাওয়ালাও ঠিক করে দিলো। অচেনা শহরে একমাত্র ভরসা আমাদের ৩ চাক্কা। যাওয়ার পথ ২টা। ট্রেনে চেপে গেলে ৩০ মিনিট লোকালে, আর ২০ মিনিট আন্তঃনগর। আর অন্য পথে যেতে হলে টেম্পু, এরপর আবার টেম্পু। অতঃপর ঠিকানা জানা নেই।
যার কাছে যাচ্ছি তাকে না জানিয়ে সেখানে পৌঁছানোর একটা ইচ্ছা ছিলো, তবে এমন ভাষাবিষয়ক জটিলতায় আর সাহস পেলাম না। একদল মানুষ নিজেদের ভেতরে বাংলায় কথা বলছে, আমরা অনুমাণে বুঝবার চেষ্টা করছি এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ মেয়াদে সফল হবে না।
ট্রেনে যাওয়াই আমাদের জন্য ভালো হবে, রিকশাওয়ালার এই মহান বানীতে সাথে সাথে সায় দিয়ে ফেললাম। এমন কি অবাক করা কান্ড সে সময়েই একটা ট্রেন আসছে প্লাটফর্মে। মোটামুটি ৩টা স্টেশন পরে গন্তব্য তবে ভাড়াটা অবাক করার মতো। অন্তত ঢাকা শহরে নিয়মিত বাসে চড়ে যে অভিজ্ঞতা তাতে রাস্তার মোড় ঘুরলেই বাসের ভাড়া বাড়ে গাণিতিক হারে, হয়তো ৬ টাকা না দিলে একটা রাস্তার মোড় পার হওয়া যাবে না এখানে, তাই ৩ স্টেশন পরের গন্তব্যের ভাড়া যখন বললো ৫ টাকা আকাশ থেকে পড়বার দশা হলো।
উঠেই নিশ্চিত হতে চাইলাম যার কাছে যাচ্ছি সে আছে স্বস্থানেই। অবগত করবার জন্য এর বেশী সময় ছিলো না।
আমাদের মেইল ট্রেনের সহযাত্রীরা সবাই যে যার মতো বোঁচকা নিয়ে বসে আছে, ছেলে-বুড়ো, আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা, দাঁড়ানোর জায়গা নেই। বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় চলা এই ট্রেনে ৫ টাকা ভাড়া দিয়ে অন্তত ১৫ কিলোমিটার যাওয়া যাচ্ছে।
একটা রাস্তা দিয়েই পার হচ্ছে অন্তত ৪০০ যাত্রী অথচ পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আছে। সীটের মান খুব ভালো বলা যাবে না। এরপরও ৪০০ যাত্রীকে অন্তত ১৫ কিমি রাস্তা নির্ভাবনায় ৫ টাকায় পার করিয়ে দিতে পারছে এই ব্যবস্থা।
একই সেবা দিতে বাস কতৃপক্ষ কতটা পয়সা নিতো?৪০০ যাত্রী ধরবার জন্য হলেও ৮টা বাস লাগে, সেগুলো হাইওয়েতে এলোপাথারী চলবে,নিয়মনীতির তোয়াক্কা নেই, যে যার মতো জায়গা বেজায়গায় থামিয়ে যাত্রী তুলবে,
শহরের অপ্রশস্ত রাস্তা আরও সংকীর্ণ হয়ে যাত্রীর গলায় চেপে বসবে। এরপর নিজেদের দক্ষতা দেখাতে তারা রাস্তায় রেস শুরু করে কোনো খাদে উল্টে পড়ে থাকবে একদিন। ট্রেনের সিগন্যালে ভুল হয়, তবে যেকোনো বন্যায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ট্রেন লাইন। ট্রেন লাইন বন্যার্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হয়, রিলিফের বহর পৌঁছায় সেখানে। ঢাকা শহরের বিশ্রী জ্যাম কত সহজেই কাটিয়ে দেওয়া যেতো যদি ট্রেনের ব্যবস্থা ভালো হতো।
সহযাত্রী প্রশ্ন করে কোথা থেকে আইছুইন?
কই যাইবাইন?
গন্তব্য বলি পছন্দ হয় না। অবশ্য পছন্দ হওয়ার মতো কিছু না, একটা স্টেশনে সবাই নামবে, সেটা কোনো গন্তব্য হতে পারে না, বড়জোর গন্তব্যের কাছাকাছি কোথাও পৌছানোর আলামত হতে পারে।
অগ্যতা জানাতে হয় যার কাছে যাচ্ছি তার সাকিন আমাদের জানা নেই। সে কোথায় থাকে জানি না, শুধুমাত্র আমাদের কাছে কয়েকটা সংখ্যা আছে, যে সংখ্যা চাপলে তার কথা শোনা যায়।
ট্রেনে উঠেই তাকে জানিয়েছি আমরা আসছি।
সে তখন ছিলো অন্য কোথাও কোনো বন্ধুর সাথে, আমাদের সাথে দেখা হবে কি না তাও জানি না। তবে আশা হয়তো দেখা হয়েও যেতে পারে।
এর পরে কোন স্টেশন?
কথাবার্তা জমে উঠে, আমাদের আপাত গন্তব্যহীনতা এবং তাদের প্রতীক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা আমাদের নিশ্চিত ভাবেই কৌতুককর করে তুলেছে। তারা শহুরে ভদ্রতায় মুখ টিপে হাসে, আড়ে আড়ে চায়।
একটা শব্দ উচ্চারিত হয় সহযাত্রীনির মুখে, আমরা বোধগম্যতায় সেই শব্দ ব্যবচ্ছেদ করি। কোনো পরিচিত আঙ্গিক ফুটে উঠে না সেই উচ্চারণে।
এইতো সামনে- স্টেশনের নাম খুঁজি ব্যগ্র হয়ে, বাইরে তখন বৃষ্টি তাড়া করছে আমাদের, ট্রেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলে, বৃষ্টি আমাদের নাগাল পেয়ে যাবে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি এমনটা বলা যাবে না।
বরং হালকা চালে বৃষ্টি পড়ে, আমাদের নাগাল পেয়ে হয়তো তার তাড়া কমে গেছে।
শৌশব খুঁজে পাই, ট্রেন লাইনের দুই পাশে ব্যকুল চোখ মেলে দেখি আর ফিরে যাই প্রথম ট্রেনে চাপবার দিনে, সবকটা স্টেশনের নেমপ্লেট দেখে আনন্দে আত্মহারা, তখনও নাম মানেই অর্থবোধকতা। নামের কোনো অর্থ থাকবে না তা কি হয়, তাই একটা না একটা কল্পিত অর্থ দাঁড়াও হয়ে যায়।
আব্দুল্লাপুর,বানিরচং, কাউডাঙ্গা, নিজের মতো অর্থ করে নিয়ে আমরা খুশী। অথচ এখানে স্টেশনের নাম পঘাচং।
পছন্দ হয় না, গৌরীপুর জংশন কানে বাজে, একটা আমন্ত্রন খুঁজে পাই সেখানে।
সে স্টেশন পার হয়ে আবার সামনের স্টেশন। সামনের স্টেশনের নাম বাখাল্লি- অন্তত তেমনটাই মনে হয় সহযাত্রীনির কথায়। বাণিজ্য আর বিপননের ছোঁয়ায় সব কিছুই বিপন্ন এখন, কেউ মাটির জ্বালায় বাদাম বুট ভাজে না এখন, সবাই প্রাণ ডাল আর প্রাণ বাদাম খায়, মুঠোয় মুঠোয় সময় পার হয় আর শৈশব দুরবর্তী কোনো স্টেশনে ট্রেনের ঝমঝম তুলে পালাতে থাকে।
সামনের স্টেশনের নামটা অদ্ভুত ভাতখালী। ততক্ষণে তোমার কথা বোঝার আশা দিয়েছি বিসর্জন।
দুইপাশে বর্ষাকালের বাংলাদেশ। জলথইথই, ডিঙি নৌকা, ছেঁড়া পাল, আর তার মাঝে ডুবে থাকা মানুষের বসতি, ছেলেদের বৃষ্টিতে ফুটবল আর কৃষকের নিড়ানী, আমাদের আমন্ত্রন জানায় গন্তব্য।
আর বেশী দূরে নেই
ফোন আসে, আপনারা কোথায়?
আপনার কাছাকাছিই আছি। সহযাত্রীরা সবাই গাটরি বোঁচকা তুলে নিচ্ছে, আমাদের তুলে নেওয়ার মতো কিছু নেই।
দূরে স্টেশন দেখা যায়।