আমি তাকে পছন্দ করি, বেশ পছন্দ করি। তবে কেনো পছন্দ করি এটা জানি না। কোনো কোনো মানুষকে অকারণেই পছন্দ হয়ে যায়, কোনো যুক্তিবোধের ধার ধারে না এই অযৌক্তিক আবেগ।
তার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই একটা অকারণ স্নেহবোধে আক্রান্ত ছিলাম, অহেতুক দায়িত্ববোধাক্রান্ত হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ ছিলো না। তবে যাদের এমন অহেতুক পছন্দ হয়ে যায় তাদের জন্য সার্বক্ষণিক উদ্বেগ সঙ্গী হয়েই থাকে।
অনেক অনেক দিন পরে তাকে দেখলাম। মাতৃত্বের উজ্জ্বলতা মলিন। তার চোখের নীচে না ঘুমানো কালো ছাপ। হৃদয়ে পাথর চেপে সৌজন্যতা দেখানোর কষ্ট মাঝে মাঝে সইতে হয়। আমি সম্পর্কে তার কি হই এটা আমি জানি না। তবে সে যে বাড়ীর বৌ আমি সে বাড়ীর জামাই। সুতরাং আমাদের দু জনই এই পরিবারের সাথে বিবাহসুত্রে সম্পর্কিত।
কিছু কিছু পরিস্থিতি আমাদের স্তব্ধ করে ফেলে। আমাদের মুখের ভাষা খুবই অকিঞ্চিৎকর বোধ হয়, আমাদের তখন অন্য কোনো ভাষায় কথা বলার সুযোগ খুঁজতে হয়। আমরা ইশারা আর স্পর্শ্বের ভাষায় আশ্বাস খুঁজি।
অনেক দিন কাঁদতে পারি না কোনো ছুতায়। চোখে পানি আসে না। শেষ বার কেঁদেছিলাম বোধ হয় ৩ বছর আগে, বুকে থম ধরে থাকে, নিঃশ্বাস আটকে আসে, তবে চোখের বাধ ভাঙে না।
আমার হাতের তালুতে তার চোখের পানি পড়তে থাকে অনর্গল, বাধ ভাঙা স্রোতের মতো তার চোখের পানি ঝড়তে থাকে আমার হাতের তালুতে। আমি হাতপেতে সেই চোখের পানি জমিয়ে রাখি, ভেতরে ভেতরে নিজেও কাঁদি, তবে চোখ ভিজে না।
কোনো কথা বলতে পারি না, অবশ্য বলার কিছুই নেই। পরিস্থিতিই এমন। আমি প্রার্থনাও করতে পারি না, কোনো ইশ্বর নেই আমার, কোনো মহা শক্তিমানের পদতলে নিজেকে সমর্পিত করতে পারি না, তাই মুখ ফুটে বলতেও পারি না, কাঁদো, কেঁদে বুকের ভার হালকা করো।
আমি নিজে জানি এ দুঃখ, এই আক্ষেপ ভুলে যাওয়ার মতো না। নিজের ভেতরে এই কষ্ট পুষছি ৩ বছর। এই ক্ষতি কখনই পুরণ হওয়ার নয়। যে মা জন্মের পরপরই জেনে গেছে তার সন্তান মৃত, যাবতীয় প্রচেষ্টা শুধুমাত্র এই মৃত্যুর অবশ্যসম্ভাবিতাকে একটু দুরে সরিয়ে রাখা, তাকে আমি কি সান্তনা দিবো?
আমি স্থানু বসে থাকি, আমার আশেপাশের মানুষগুলো নানাভাবে বুঝাতে চায় এই কান্না অর্থহীন, যদি কেঁদে সে ফিরে আসতো আমরাও আকুল হয়ে কাঁদতাম তোর সাথে। এই সান্তনা আমার অবস্থান বদলায় না। আমার কষ্টবোধ কমায় না এক তিলও।
তার হাত ধরে বসে থাকি, তার কান্না থামে, কিংবা সে নিজের কান্না দমাতে সফল হয়। বিছানায় এলিয়ে পড়ে, আমিও হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। নির্জন ঘরে গিয়ে বসে থাকি চুপচাপ।
সারাক্ষণ মনে হয় এই পরিণতি আসলে বাস্তব নয়। এই পরিণতি এড়ানো যেতো। চাইলেই এই ক্ষতি এড়ানো যেতো। তবে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুরাবস্থা নিয়ে কিছু বলার নেই। বরং সান্তনা খুঁজি এই পরিণতি আসলে ভালোই হয়েছে।
কিছু কিছু যুদ্ধ শুরুর আগেই পরাজয়ের শঙ্কা মাথার উপরে দুলতে থাকে। অমঙ্গল ছায়া গ্রাস করে জীবন শুরুর আগেই। অথচ অন্য কোনো স্থানে, অন্য কোনো হাসপাতালে হয়তো এই গল্পের সমাপ্তি অন্য রকম হতে পারতো।
গর্ভে সন্তান শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহন করে না। তাদের ফুসফুস আটকানো থাকে, তাদের শরীরের রক্তে অক্সিজেন আসে মায়ের রক্ত থেকে, নাড়ীর টান এমনই, নিরাপদ জলজ সন্তরণে সন্তান খাদ্য আর নিরাপত্তা পায় নাড়ী থেকে।
জরায়ুর পিচ্ছল পথ পারি দিয়ে যখন সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে প্রথম, তখন কেউ কেউ নিশ্চিত নিরাপদ জলজ সন্তরণ শেষে মায়ের সাথে লাগানো নাড়ীর টান ছিড়ে যায় তখন এই পথটুকু পারি দিতে গিয়ে তার ফুসফুসের আল্যুভিলাকে আটকে রাখা বাধা প্রবল প্রসব যন্ত্রনা আর চাপে গলে বেড়িয়ে আসে।
নিরাপদ খাদ্য আর শ্বাস প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়। তাকে নিঃশ্বাস নিতে শিখতে হয়, তাকে নিজের রক্তে অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়।প্রকৃতির নিয়মই এমন, শিশু কেঁদে উঠে, আর শিশু কেঁদে উঠলেই নিশ্চিত, তার ফুসফুসে অক্সিজেন যাচ্ছে ঠিক মতো। তবে কোনো কোনো শিশু সহজে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে না। তাদের শরীরের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন তারা পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করতে পারে না প্রাথমিক অবস্থায়। তারাই সবচেয়ে করুণ শিশু। তারা কাঁদতে পারে না, তাদের শরীর অক্সিজেনের অভাবে নীল হয়ে যায়, তাদের খিঁচুনিও আসে না ঠিক মতো। প্রবল জীবনিশক্তি না থাকলে তাদের মৃত বলেই ছুড়ে ফেলা হয়।
কেউ কেউ এই অবস্থা থেকেও ফিরে আসে। তবে ফিরে আসবার হার কম। আমার সদ্যোজাত ভাগনার অবস্থা ছিলো এমন। তার শরীরের অবস্থা এমন ছিলো না। তার দুর্বল ফুসফুস পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে নি তার শরীরে। এখানেই কষ্ট আমার। এইসব শিশুকে সহায়তার জন্য অক্সিজেন টেন্টের ব্যবস্থা আছে। সেখানে প্রয়োজনের অধিক অক্সিজেন সরবারহ করা হয় যেনো অক্সিজেনের অভাব বোধ না করে তার শরীর, তার বিপাক এত জোড়ালো নয় যে অতিরিক্ত অক্সিজেন তার কোনো ক্ষতি করবে।
তবে যেই হাসপাতালে এই সন্তান জন্ম নিয়েছিলো তাদের কোনো অক্সিজেন টেন্ট ছিলো না। বাংলাদেশের অধিকাংশ হাসপাতালের শিশু বিভাগে এই টেন্ট নেই। অথচ এই সমস্যাটা শিশুদের খুবই সাধারণ একটা সমস্যা। বার বার এই আক্ষেপটা মনে জাগছে আমার, যদি অন্য কোনো অবস্থায় এই শিশু জন্ম নিতো, তার একটা সুযোগ থাকতো। তাকে অসম রণে লিপ্ত করেছে আমাদের সিদ্ধান্ত।
আমি বসে বসে ভাবতে থাকি, যদি এমন কোনো হাসপাতালে সে জন্মাতো, বাংলাদেশের অধিকাংশ হাসপাতাল নয়, বরং এমন সুবিধাসম্বলিত কোনো একটা হাসপাতাল, তাহলে এই গল্পের সমাপ্তিতে একটি শিশুর হাসিমুখ থাকতো। হয়তো তার মায়ের অশ্রুও থাকতো এই গল্পে, তবে অশ্রু হতো আনন্দের অশ্রু।
আমাদের সীমাবদ্ধতা আমরা সবাই এমন কোনো লোকালয়ে থাকি না যেখানের হাসপাতালের শিশু বিভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাই যখন রাত ১২টা বেজে ১০ মিনিটে তার জন্ম হয় তখন ডাক্তার চেষ্টা করেও তাকে কাঁদাতে পারে নি। তার শরীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন যাচ্ছে না এটা উপলব্ধি করেছে তার নীল হয়ে যাওয়া শরীর দেখে।
তাদের করার কিছুই ছিলো না, অক্সিজেন টেন্ট নেই, মৃত্যু পরোয়ানার সই করবার মতো নিরুত্তাপ ভাবেই এই সংবাদ জানিয়েছে তারা। অতঃপর তাকে নিয়ে ছুট ছুট, ঢাকার কাছাকাছি শিশু হাসপাতালে, সরকারী শিশু হাসপাতালেও অক্সিজেন টেন্ট নেই, আগারগাঁও থেকে মগবাজার, হলিফ্যামিলি ঘড়িতে সময় কাটে টিক টিক,
হলিফ্যামিলিতেও নেই, ঘড়িতে রাত ৩টা, সেখান থেকে আদ-দ্বীন, সেখানের ডাক্তারের পরামর্শে আয়েশা মেমোরিয়াল। ঘড়িতে তখন ৪টা ১০। জন্মের পর থেকে ৪ ঘন্টা সীমিত অক্সিজেনে তার জীবন চলছে, মাথায় অক্সিজেন সরবরাহ কম বলেই মাথার সাথে স্নায়ুর সংযোগ আর জীবনের প্রয়োজনীয় নির্দেশগুলো নিয়ে সেইসব স্নায়ুর বিভিন্ন মাংশপেশীতে সাড়া জাগানোর প্রক্রিয়াটা প্রায় স্থবির। এই পর্যায়কে ব্রেন ডেড বলা যায় না। বরং প্যরালাইজড চাইল্ড বলা যায় বড়জোর।
সেখানে থেকেই দ্বীতিয় দিন সকালে মারা যায় সে।
তারপর থেকেই নানা উপায়ে সান্তনা খুঁজছি মনে মনে। হয়তো ভালোই হয়েছে, জন্মের সময়ে পর্যাপ্ত অক্সিজেন মস্তিস্কে না গেলে প্রতিবন্ধি হয়ে যায় শিশু। হয়তো শ্রবন প্রতিবন্ধি, হয়তো দৃষ্টি প্রতিবন্ধি, কোথায় আঘাত করবে এই অক্সিজেনসল্পতা জানা নেই। আমি তার বাবার হাত ধরে বসে থাকি। তার বাবা কাঁদে, কাঁদছে সেইসময় থেকেই।
যদি রাখবেই না তো তাকে পৃথিবীতে আনলো কেনো? এত কষ্ট করেও তাকে রাখতে পারলাম না ভাই।
আমার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। নিরুত্তর তাকিয়ে থাকি। হয়তো ভালোই হয়েছে, একটা প্রতিবন্ধি শিশুকে লালন-পালন করবার মতো পরিবেশ এবং পরিস্থিতি নেই বাংলাদেশে। এখানে প্রতিবন্ধি শিশুর বারা মা হওয়া সামাজিক অপরাধের মতো। সমাজের সবাই পূর্বজন্মের পাপের প্রতিফলন খুঁজে পায় প্রতিবন্ধি শিশুর সর্বাঙ্গে। পাপ খোঁজা সাধু প্রতিবেশীর কট্টর চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে কাঁদার লজ্জা নেই এখন, যা গেছে তা গেছেই।
তবুও বাবার মন মানে না, কাজ ফেলে সন্তানের কবরের কাছে গিয়ে বসে আছে, গত এক সপ্তাহ এই করছে তারা। শিশুর কবর পাহারা দিচ্ছে বসে বসে, যদি শেয়াল আসে, যদি সে ভয় পায়, যদি কোনো কষ্ট হয় তার।
আমি স্থানুর মতো বসে থাকি। মাথা কাজ করে না।
কি উত্তর দিবো এর? সবাই নিশ্চিত মনেই সমর্পিত ইশ্বরে, তাদের অনাবিল বিশ্বাস দেখে স্তম্ভিত হতে পারি বড়জোর। তাদের মতো করে বলতে পারি না, মাওলার ইচ্ছা ছিলো না তাই তিনি নিয়ে গেছেন, এ কষ্ট তিনিই দিয়েছেন, এই কষ্ট থেকে মুক্তিও তিনি দিবেন।
আমার সারাক্ষণ থেকে থেকে মনে হয়, যদি অন্য কোনো পরিবেশে এই ঘটনা ঘটতো, কোনো উন্নত হাসপাতালের নিরাপদ আশ্রয়ে তবে আমার এই গল্পের সমাপ্তি অন্যরকম হতো। আমি এমন অসহায় বসে থাকতাম না। অন্তত একটা সান্তনা থাকতো মনে, আমাদের যতটকু করবার ছিলো ততটুকু করেছিলাম যথাসময়ে, সেটা জন্মের ৪ ঘন্টা পরে অক্সিজেন টেন্টের ব্যবস্থা নয়, সেখানে প্রতিটা সেকেন্ড মহামূল্যবান সেখানে ৪ ঘন্টা একজনকে কোনোরকম লাইফ সাপোর্ট না দিয়ে ফেলে রাখা তাকে হত্যা করা। এই হত্যার দায়ভার কার?
কারো কি কিছু করার ছিলো? কেউ কি এই গল্পকে অন্য ভাবে সমাপ্ত করতে পারতো?
প্রশ্নের উত্তর পাই না। আমি সদ্যমাতৃত্বের উজ্জলতা মলিন হতে দেখি, আমি একজন মাকে নিঃসাড় শুয়ে থাকতে দেখি বিছানায়, তার কান্নায় ভেঙে পড়া দেখি। আর তীব্র চাবুকের আঘাতে পালিয়ে আসি। সামাজিকতা আর ইশ্বরন্যস্ততা তখন সেখানে প্রবল।
শুধুমাত্র স্বামীর জন্যই দীর্ঘ স্থায়ী শোকের আধার ধর্মে গ্রহনযোগ্য। পিতা কিংবা সন্তানের মৃত্যুতে ৩ দিনের বেশী শোক পালনের নিয়ম নেই। শালার ধর্ম। ৯ মাস তিল তিল করে প্রতি মূহুর্তে একটা জীবনকে পালন করা, এর অভ্যস্ততা এবং এর সাথে সারাজীবন ধরে লালন করা কল্পনার অপমৃত্যুকে ধারণ করে না ধর্ম। সে নিয়ম জানে, জানে পুঁথির বিধান। সে পুঁথিতে বলা আছে মোহাম্মদ এই শোক প্রকাশকে অপছন্দ করেন। তাই ৩ দিনের বেশী শোকে মলিন হয়ে থাকা সুন্নাহ বিরোধী।
আমি সেই মাকে নিরাপত্ত দিতে পারি না, সেইসব বিশ্বাসীকে কিছু বলতেও পারি না। সন্তানের কবরের কাছে বসে থাকা অসুন্নতী বাবাকে বলতে পারি না, তুই চলে আয়, তুই চলে না আসলে কবরের ফেরেশতারা গোর আজাব শুরু করতে পারবে না। পিতার হৃদয়ে গত একসপ্তাহ গোর আজাব চলছে, এই আজাব কবে শেষ হবে জানি না।