আমার বাল্যবন্ধু সোহরাবের সাথে দেখা হলো প্রায় ৪ বছর পর,আমাদের গ্রামের বাড়ীতে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক গল্পসল্প হলো পাড়ার মাঠে বসে,সাথে আরো কয়েকজন। তারপর সে একপ্রকার জোর করেই নিয়ে গেলো তাদের বাড়ীতে। আমার আবার লোকের ঘরে ঘরে ঘুরতে বেশ লাগে,ঘরের চেয়ে ঘরের মানুষগুলোকে বেশী রঙীন লাগে,তাও সোহরাবকে আমাকে ওদের ঘরে নিতে জোর খাটাতে হয়েছিলো,কারণ আমি ওদের ঘরে যেতে আগ্রহী ছিলাম না। সাকল্যে ওদের ঘরে তিনবার গেলাম এ নিয়ে।
প্রথম বার গিয়েছিলাম ক্লাস ফোরে থাকতে এবং প্রথমবারেই ওদের পরিবার সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ি। সোহরাবের বাবার মধ্যে দু'রকমের স্বভাব ছিলো যা আমার পছন্দ হতোনা তখন থেকেই,রক্ত গরম এবং রক্তের গরম।
সোহরাবের বাবার নাম আশরাফ আজিম চৌধুরী,এনাদের পূর্ববর্তী কয়েকপুরুষ ধরে জমিদার ছিলেন,রক্তের গরমের উৎস এটি। আর বৃটিশ বেনিয়াদের বুঝিয়ে দেয়া তকমা এবং বংশগত 'সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স' হলো রক্তগরমের চালিকা…
এবার গিয়ে যা দেখলাম তা কখনো দেখবো বলে আমি প্রস্তুত ছিলাম না,সোহরাবের বাবা আশরাফ চাচা ওনাদের ঘরের দাওয়ায় বসে জমির ধান কাটা কামলাদের সাথে নাশতা করছেন,পরোটা দিয়ে বুটের ডাল। অভাবনীয়! ইনার চরিত্র আগে এমন ছিলো যে পারলে নিচুশ্রেণীর লোক যে রাস্তা দিয়ে হাঁটে,সে রাস্তা আগে গোলাপজল দিয়ে ধুইয়ে তবে হাঁটেন! ব্যপারটি কতোটা প্রকট ছিলো যে ক্লাস ফোরের বাচ্চাও বুঝতে পারে সেটি একটি ঊদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন,উনি নামাজ পড়তেন উনাদের পারিবারিক মসজিদে,সে মসজিদে উনি নামাজ পড়ার জন্যে আলাদা কামরা করা ছিলো ইমামের পেছনে ডানপাশে! আবার কেও উনাকে দাওয়াত করলে ওনার জন্যে আলাদা করে নতুল গ্লাস,প্লেটের ব্যবস্থা করতে হতো,অন্যের ব্যবহৃত তৈজসপত্র তিনি ব্যবহার করতেন না…
সেই তিনি কিনা ক্ষেতের কামলাদের সাথে এক পাটিতে বসে নাশতা করছেন!!
আমি বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওদিকে এবং এসব ভাবছিলাম। সোহরাবের কণ্ঠে সম্বিত ফিরলো " আব্বা,আমার বন্ধু সিতারা…লণ্ডনে ব্যারিস্টারী পড়ে,বার্ষিক ছুটিতে এসেছে দেশে। আমাদের বাসায় আগেও এসেছিলো"…
আমার বাবার নাম বলার পর তিনি আমাকে চিনতে পারলেন,বাসার খোঁজখবর নিলেন,বসতে বললেন উনার পাশে। আর সোহরাব "হাতমুখ ধুয়ে কাপড় বদলে আসি" বকে অন্দরে চলে গেলো।
আশরাফ চাচা আমার চোখেমুখে বিস্ময়টি এবং তার সম্ভাব্য কারণটি সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছেন,বিষয়সম্পত্তি সামলানো বুদ্ধিমান লোক,না বোঝার কারণ নেই। কামলারা ততোক্ষণে খাওয়া শেষ করে মজুরী বুঝে নিয়ে উঠে পড়েছে।
আশরাফ চাচা আমার দিকে তাকিয়ে একটি নিস্পাপ হাসি হাসলেন,উনার চোখে এবার কোন জাত্যাভিমান ছিলোনা,সারল্য ছিলো যা এলাকার লোক কিছুদিন আগেও দেখবে বলে ভাবতে পারতোনা,ইনি আশরাফ আজিম চৌধুরী,আমার সামনে চাটাইয়ে উপবিষ্ট।
তাঁর বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে,এবয়েসী লোকেদের হড়বড় করে কথা বলার এবং জিলিপীর প্যাঁচের মতো এক কথা থেকে অন্য কথায় চলে যাওয়ার বিরক্তিকর একটি প্রবণতা থাকে,ইনি সেরকম না। বেশ গুছিয়েই কথা শুরু করলেন,আমার মনে হুটোপুটি করতে থাকা প্রশ্নের জবাব দিতে শুরু করলেন সাজিয়ে গুছিয়ে।
-- তিন বছর আগের কথা,আমি তখনো আজকের মতো ছিলাম না,লোকে আমাকে যেমন বলে জানতো তেমনই ছিলাম। তুমিও আমাকে এ অবস্থায় দেখতে পাবে তা আশা করোনি,তাই হকচকিয়ে গিয়েছো।
আমি লজ্জা পেলাম,মনের কথা অন্যজন অবলীলায় ধরে ফেললে তা লজ্জাজনক বটে। আমি বিব্রতভাব সামলে নিয়ে বললাম "না চাচা,অল্প কয়েক বছরেই আপনার শরীর বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে,তাই দেখছিলাম"
উনার চেহারা দেখে মনে হলো আমার অজুহাতে সন্তুষ্ট হয়েছেন। উনি আবার বলা শুরু করলেন,শুদ্ধ বাংলায়,আঞ্চলিক টান ছাড়া। শুনেছি ইনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এমএ পাশ করেছিলেন।
-- তা যাই হোক,তিন বছর আগে তোমার শিউলী আপার মেয়েকে (উনার নাতনী) নিয়ে শহরে গিয়েছিলাম ডাক্তার দেখাতে,তোমার দুলাভাই (উনার মেয়ের জামাই) ঢাকায় ছিলো তাই আমি-ই ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম,ঘনঘন জ্বর উঠতো। সেদিন ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হবার সময় একটি রিকশা এসে আমার ডান পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়,তিতলী আমার কোল থেকে ছিঁটকে পড়ে রাস্তার এক পাশে। আমি পায়ের ব্যথা ভুলে ওকে নেবার জন্যে ছুটলাম,আশেপাশে খেয়াল করিনি,এর মধ্যে আরেকটি বেবিট্যাক্সী এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেললো। আমি চোখে অন্ধকার দেখছিলাম,কোনভাবে নাতনীর কাছে গিয়ে ওকে ধরে রেখেছিলেম। একে অসুস্থ,তার উপর কপালের দিকে ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। আশেপাশে লোকজন জমে গিয়েছিলো,তারা বেবিট্যাক্সীটিকে থামিয়ে চালককে মারধর করছে।
আমার চিৎকার করার শক্তিটুকু অবশিষ্ঠ ছিলোনা,পায়ের পাতার হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিলো,কোমরের হাড় নড়ে গিয়েছিলো,সাথে চার বছরের আহত তিতলী। আমি ওর ফেটে যাওয়া কপাল চেপে ধরে সাহায্যের জন্যে চেঁচাচ্ছিলাম ক্ষীণস্বরে,তিতলীও কাঁদছিলো।
আমার আর্তনাদে কেও কান দিচ্ছিলোনা,সবাই বেবীট্যাক্সীওয়ালাকে ধোলাইয়ে ব্যস্ত,এদিকে এক বৃদ্ধ ও এক বাচ্চা আহত হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে তার দিকে কারোরই নজর নেই। আমি হুঁশ হারিয়ে ফেলছিলাম,তিতলীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম যেন কেও নিয়ে যেতে না পারে,পকেট হাতড়ালাম…আমার মোবাইলফোনটা কোথায় যেন পড়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ হয়ে শরীর অবশ হয়ে এলো। অর্ধচেতন অবস্থায় শুনতে পেলাম কয়েকজন বলাবলি করছে-
" আরে এদেরকে হাসপাতালে নিতে হবেতো,বাচ্চাটার তো রক্ত পড়ছে"
"না না,অবস্থা সুবিধার না। মারা টারা গেলে পুলিশী ঝামেলা হবে"
"ভাই তাড়াতাড়ি চলুন,প্রোগ্রামে দেরী হয়ে যাচ্ছে"
"হ্যাঁ জসীম,আসছি আসছি…তোমার ভাবীরা আলাদা গাড়ীতে করে যাচ্ছে। এইতো কাছে এসে পড়েছি,আর পাঁচ মিনিট"
এভাবেই ভদ্রলোকগুলো আমাদেরকে আহত অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে যে যার কাজে চলে যাচ্ছিলো,সম্ভভত আধাঘন্টা এভাবে পড়ে ছিলাম,এরপর চূড়ান্তভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
চৈতন্য ফেরার সময় চোখ বন্ধ অবস্থায় আবারো হিজিবিজি কথা শুনতে পাচ্ছিলাম,তবে বুঝতে পারলাম যে এবার আমি রাস্তার পিচে না,নরম গদিতে শুয়ে আছি,আমার পায়ের পাতা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বুঝতে পারলাম যে আমি হাসপাতালে,কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে আসলো। কেও একজন গেঁয়ো ভাষায় কথা বলছে,বাংলা করলে এমন হয় " আরে ইনি আর একটি বাচ্চা মেয়ে রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে পড়ে ছিলেন,কোন লোকই একটু ফিরেও তাকায়নি,তারপর আমি আমার রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে আসি,পকেটে টাকাপয়সাও বেশী নেই…দেড়শো টাকার ঔষধ কেনা হয়েছে"
আরে,বাচ্চা মেয়ে! তিতলী! তিতলী তিতলী বলে ডেকে উঠলাম,চোখ মেলে দেখি এক ছেঁড়া গেঞ্জি ও লুঙ্গী পরা লোক আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শুইয়ে দিলো,সম্ভবত এই নিজের রিকশায় করে আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে; রিকশাওয়ালা। সে বললো " আব্বা,ওইতো পাশের বেডে। আপনার নাতনী হয় ও,তাই না?"
পাশে তাকিয়ে দেখলাম তিতলী ঘুমিয়ে আছে,মাথায় ব্যাণ্ডেজ করা,হাতে ক্যানোলা ঢুকিয়ে রক্ত দেয়া হচ্ছে ব্যাগ থেকে। আমি দুর্বলভাবে জিজ্ঞেস করলাম " ওর কি অবস্থা?"
রিকশাওয়ালাটি বললো " আব্বা,এখন ভালো আছে। মাথায় চারটি সেলাই পড়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে। আমার বউয়ের রক্ত এবি নেগেটিভ,ওকে ডেকে আনিয়েছি পাশের একজনকে ফোন করে,চিন্তার কিছু নেই"
মাথা ঘুরিয়ে দেখি পাশে মাটিতে এক মহিলা বসে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে,রিকশাওয়ালার স্ত্রী হবে,রক্ত দেয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। সে সালাম দিলো আমায়।
আমার বুক ফেটে কান্না এলো সে অবস্থাতেই; আমার এতোদিনের জাত্যাভিমান যেন আমার বুকে এখন খড়্গ হয়ে বিঁদছে,রাস্তায় এতো ভালো ঘরের লোক কেও আমাদের দিকে ফিরে তাকায়নি,এই দরিদ্র রিকশাওয়ালা আমাদেরকে হাসপাতালে এনেছে,নিজের টাকায় ঔষধ কিনেছে,নিজের বউকে ডেকে এনে আমার নাতনীর রক্তের জোগান দিয়েছে। আমি সেদিন বুঝতে পারলাম যে মানুষের মনুষত্য সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করেনা এবং সেদিন থেকেই আমি সাধারণ জীবনযাপন করা শুরু করলাম। রিকশাওয়ালার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে বাসায় ফোন করলাম,এক ঘন্টার মধ্যে আমার আত্মীয়স্বজনে ভরপুর হয়ে গেলো সদর হাসপাতালের ওয়ার্ড।
কে যেন বলে উঠলো "হায় হায়! উনাকে এই নোংরা হাসপাতালে কেন আনা হলো? পাশেই তো অরবিট হাসপাতাল,তাড়াতাড়ি রিলিজ করিয়ে ওখানে নিয়ে যান"
আমি ধমকে উঠলাম " আমার আর আমার নাতনীর চিকিৎসা এখানেই হবে,কারো যদি এখানের পরিবেশ ভালো না লাগে তবে তার আমাকে দেখতে আসার দরকার নেই,বড়লোকি আমিও অনেক করেছি এবং আজকে দেখেওছি"
যে বলেছিলো সে চিমসে গেলো,মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি রিকশাওয়ালাকে খুঁজলাম আশেপাশে দৃষ্টি মেলে,দেখতে পেলাম না; তার স্ত্রীও নেই। কোন এক ফাঁকে আমার আত্মীয়স্বজনের চোখ গলিয়ে বেরিয়ে চলে গিয়েছে।
আমার গৌরব,দম্ভ পরাজিত হলো চূড়ান্তভাবে,আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো ঔষধের টাকাটুকু ফেরত চাইবে।
--------
আশরাফ চাচার কাহিনী বলা শেষ হলো,আমি নতুন করে বিস্ময়াপন্ন হলাম,মানুষ কোন পরিস্থিতিতে কার কাছ থেকে কি শিক্ষা পেয়ে কিভাবে বদলে যায় তা আরেকবার দেখতে পেলাম,প্রতিউত্তরে কোন মন্তব্য করলাম না। সোহরাবের মা নাশতা করতে ডাকছেন ভেতরে। খাবার ঘরে যেতে হলে আশরাফ চাচার ঘর পেরিয়ে যেতে হয়,উঁকি দিয়ে দেখলাম একটি সাধারণ খাট,একটি আলনা আর একটি তেপায়া বাদে আর কিছুই নেই ঘরটিতে,দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো একটি কবিতার দু'টি চরণ-
"মানুষেরে ঘৃণা করি,
ও কারা কোরান,গীতা,বেদ,বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি?"