somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক টুকরো অতীত

২৪ শে মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কালো শাড়ী পরা শ্যামবর্ণা একটি মেয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি দেখছে এক্সিবিশনে,সে এখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে জয়নুল আবেদীনের আঁকা ম্যাডোনা ৭৩ এর একটি প্রতিলিপি। নাজলী,চারুকলা নিয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিলো ছোটকাল থেকে,আঁকিঝুকির প্রতি তীব্র ঝোঁক অথচ এখন পড়ছে রসকষহীন ফলিত পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে…তাও আশৈশব মনের এককোণে অতিযত্নে লালিত স্বপ্ন মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে,যেমন আজকে…বিকেলবেলায় একটি টিউশন ছিলো,ফাঁকি দিয়ে এসেছে এখানে; নির্ঘাত মাসের শেষে এক ক্লাসের পুরো ২০০ টাকা কেটে রেখে দেবে ছাত্রের মা।
-ম্যাডাম একটু সরে দাঁড়াবেন প্লীজ…
পেছন থেকে খসখসে গলায় একটি কণ্ঠ ভেসে এলো নাজলীর কানে,সে ফিরে তাকালো…চোখে মোটা ফ্রেমের পাওয়ারী চশমা পরা লম্বা চুলদাড়িওয়ালা একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ক্যামেরা হাতে। ছেলেটার মাথার লম্বা চুল মেয়েদের মতো পনিটেইল করা…সরে দাঁড়ালো নাজলী,ক্লিক ক্লিক করে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে ম্যাডোনা ৭৩ এর কয়েকটি ছবি তুলে নিলো ছেলেটি।
"পাগল ছাগলদের জ্বালায় আর থাকা গেলোনা,কাঁধে চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে নিজেকে বিশ্বকবি লেভেলের কেও ভাবে আর লম্বা চুল বানিয়ে লালনের ভাব ধরে…'' নাজলী বিড়বিড় করে বললো পাশে দাঁড়ানো বান্ধবী অনি-কে; অনিন্দিতা থেকে ছোট করে অনি,শক্তির সাশ্রয়! ছবি তুলে যাবার সময় ছেলেটি নাজলীর দিকে ফিরে মুখ বেঁকিয়ে হাসলো,এদিকে ভিড় একটু কম বলে নিচু স্বরে বলা কথা ওর কানে গিয়েছে…
মুখে দাঁড়িগোঁফের জঙ্গলউয়ালা,মাথায় পনিটেইল বাঁধা,চোখে পুরো কালো ডাঁটের চশমা আঁটা,বাদামী ফতুয়া পরা ও কাঁধে ঝুলানো চটের কবিতার ব্যাগ নিয়ে চলা যুবক ঢাকার অলিতেগলিতে ঘুরলে এক লক্ষ উনপঞ্চাশ হাজার জন দেখা যাবে,যার বিশ্বাস হবেনা সে নিজে গুণে দেখুক নাহয়! নাজলীদের ক্লাসের সাজু ও অনেকটা এরকম ভেক ধরে থাকে,তাও অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে দেখা ছেলেটির চেহারা ভাসতে থাকে নাজলীর চিন্তাধারায়…
মোবাইলে অনি'র কল আসলো…
-নাজু,তোর ব্যপারে একজন জানতে চেয়েছিলো…
(ওহ বলতে ভুলে গিয়েছিলাম,নাজলীকেও তার বন্ধুরা 'নাজু' ডেকে শক্তির সাশ্রয় করে!)
-কে?
-ওই যে কালকে এক্সিবিশনে যাকে পাগল ছাগল বলে গালি দিয়েছিলি সে
-সে তোর দেখা কোথায় পেলো?
-ও আমাদের রিক্সার পেছনে পেছনে এসেছিলো গাড়ী নিয়ে,তোকে ড্রপ করার পর রিক্সা থামিয়ে আমার সাথে কথা বলে
-তুই কি বললি?
-আমি কি বলবো,আমিতো ভয়েই অস্থির…আমি শুধু তোর নাম বলেছি আর বলেছি যে তুই ঢাবিতে এপ্লাইড ফিজিক্স থার্ড ইয়ারে পড়িস
-তোরে চাবকাইয়া পাছার ছাল তুইলা ফালাইতে মুঞ্চাইতেছে হারামজাদী,কে না কে কি জিগাইল আর সোনামণি উইকিপিডিয়া খুইলা বসলেন
খুব রেগে গেলে নাজলী পরিশীলিত ভাষায় কথা বলতে পারেনা,আর শব্দ নির্ধারণের বোধ ও কিছুটা হ্রাস পায়,তা নাহলে নাজলী কাওকে চাবকে পশ্চাদ্দেশের চামড়া তোলার হুমকি দেয়ার পাত্রী নয় আদৌ!
নাজলী সচরাচর হিজাব পরে,পরের ক্লাসে মায়ের থেকে চেয়ে নেকাব পরে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে,কবিমার্কা ফটোগ্রাফারের ব্যপারটা তাকে অস্বস্তিতে রেখেছে কয়েকদিন ধরে…নাহ,আশঙ্কা অমূলক; তাকে ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে দেখা গেলোনা। ক্লাসে অনির পিঠে কয়েকটা বসিয়ে দিলো নাজলী! বিপত্তি ঘটলো ক্লাস শেষে ফেরার সময়,ছেলেটি ক্যান্টিনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে,একই গেটআপ…নাজলী নেকাব খুলে ফেলেছিলো,ছেলেটি হাতের ঈশারা করে ডাকলো নাজলীকে,সাথে হাসি…ছেলেটির হাসিতে বিদ্রুপ মেশানো,যেন কোন ছোট বাচ্চার মতলব ধরতে পেরে প্রশ্রয়ের হাসি…
-আমার আসলে আপনার কাছে দুঃখ প্রকাশ করা উচিৎ,আমি আপনার অনুমতি না নিয়ে বেশ কিছু ছবি তুলেছি আড়াল থেকে
-দুঃখ প্রকাশ করা উচিৎ হলে তা করছেন না কেন?
-ওহ আই এম এক্সট্রিমলি সরি,আই এপোলোজাইজ…

ছেলেটি একটি খাকী এ-ফোর খাম ধরিয়ে দিলো নাজলীকে,নাজলী খাম খুলে দেখে নিজের কিছু ছবি; অপ্রস্তুত ভঙ্গীর ছবি তবে বেশ সুন্দর এসেছে…নাজলীর আতঙ্ক কমে গিয়েছে ইতোমধ্যে,দূর থেকে অনি হাসছে!

এই প্রথম ছেলেটির দিকে সরাসরি তাকালো নাজলী,আর তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে রইলো।
-নাজু?
-নাজু কেমন আছো?
-ভালো না

ছেলেটির নাম নজরুল,নাজলী তাকে কলেজে থাকতে নাজু ডাকতো,আর নাজলীকেও সে ডাকতো নাজু বলে…আর কলেজে তাদের দুজনকে বন্ধুবান্ধবরা ডাকতো নাজু স্কোয়ার…কলেজের কিছু লিজেণ্ড থাকে,দুই নাজু'র জুটিটাও তাদের কলেজে কিংবদন্তিতুল্য ছিলো…
-তোমার চেহারার এই হাল কেন? দেখতে কিম্ভূতকিমাকার লাগছে…
-তুমি কলেজে থাকতে বলতে আমি যেন কাঁধে চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে,ফতুয়া পরে তোমাকে প্রপোজ করি…আমার তখনো দাঁড়ি গজায় নি বলে আলগা দাঁড়িগোঁফ আর উইগ লাগিয়েছিলাম,মনে আছে??
-হ্যাঁ তখন গল্প-উপন্যাস পড়ে ওরকম চরিত্র নিয়ে ফ্যান্টাসীতে ভুগতাম,এখন আর সেই মোহ নেই
-আমাকে এতোদিন মনে পড়েনি,মিস করোনি?
-নাহ করিনি,আসলে তুমি চলে যাবার পরপরেই আমি আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি,সে ছেলেটির সাথে আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে,বিয়ে আগামী মাসে
-তুমি হয়তো খেয়াল করোনি যে কেও বিনা অনুমতিতে ছবি তুলে এতো গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করেনা…আমি তোমাকে যখন সরি বলছিলাম তখন তুমি আমার কণ্ঠে কিছু অনুভব করোনি?
-আমার অনুভূতির তীব্রতা এখন তলানীতে এসে ঠেকেছে,আমি আজকাল অপ্রয়োজনীয় কিছু অনুভব করিনা…
-আমাকে তোমার অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে?
-সংজ্ঞা অনুসারে যার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই তাকেই 'অপ্রয়োজনীয়' বলে,আমার জীবনে তোমার আদৌ আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই
-কেন মিথ্যে বলছো,তোমার সাথে কারো কোন এফেয়ার নেই,অনি বলেছে
-থাকুক না থাকুক তাতে কোনকিছুই প্রভাবিত হবেনা,অন্তত তুমি সংশ্লিষ্ঠ কোন ব্যপারে…আমার ধারণা আমি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি
-আমি তোমার পায়ে পড়তে রাজী আছি,যা হয়েছে তার জন্য আমি অনুতপ্ত…আমায় ক্ষমা করে দাও প্লীজ,আমি এতোদিন শান্তিতে ছিলাম না,আমার বিবেক আমাকে রাতের পর রাত জ্বালাতন করেছে,দু চোখের পাতা এক হতে দেয়নি…
-তুমি আমার লগে আর কন্টাক্ট করার ট্রাই নিবানা,যাইতাছি
-নাজু,আমি জানি তুমি এখন অনেক রেগে যাচ্ছো…আগে তুমি রেগে গেলে আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম…
-শাট আপ ইউ মাদার্ফাকার…গেট দ্যা হেল এওয়ে অফ মা' সাইট

নাজলী দৌরোচ্ছে,একটি মেয়ের মুখে এরকম অশালীন গালি শুনে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ঘাড় বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনা কি…মানুষ রাগ আর দুঃখ একই সময়ে সচরাচর অনুভব করতে পারেনা। নাজলী পারছে; সে দৌড়োতে দৌড়োতে নজরুলের নামে গ্রাম্য ভাষায় খিস্তি করছে এবং তার চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটার পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে অবিরত।

-----

সেদিন পালিয়ে বিয়ে করার কথা ছিলো দুই নাজুর,নজরুল ও নাজলী। কম বয়সের আবেগী সম্পর্ক বহুদূর গড়িয়েছিলো,বিয়ে ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা ছিলোনা।
বিয়ে তাদের হয়েছিলো,তারা পালিয়ে গিয়েছিলো ময়মনসিংহ…নাজলী ঘর থেকে বের হবার সময় সাথে মায়ের বিয়ের দুটো বালা ও একটি হার চুরী করে নিয়ে এসেছে আর নজরুল এনেছিলো ছয় লাখ টাকা,বাবার সই জাল করে সে প্রথমে দাগকাটা চেক বানায়,অতঃপর নিজ ব্যাঙ্ক একাউন্টে চেক জমা দিয়ে ক্যাশ করে নেয়।
তারা ময়মনসিংহে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে ঘর ভাড়া নেয়। নজরুল বলেছিলো সে দোকান করবে দুজনের টাকা একত্র করে,কিন্তু সেরকম কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলোনা নজরুলের চালচলনে,সে ঘরে বসেই টাকা উড়াতে লাগলো দুই মাস ধরে…একদিন সকালে উঠে নাজলী তার পাশে নজরুলকে দেখতে পায়না,টেবিলে রাখা একটি চিরকুট,যার সারমর্ম এই যে নজরুল নিজের ও নাজলীর মায়ের গয়না বেচা টাকা নিয়ে ভারত চলে যাচ্ছে এবং নাজলী যেন আর তার খোঁজ না করে…সাথে কিছু টাকা ছিলো নাজলীর ফিরে যাবার জন্যে…নাজলীকে নিজ থেকে যেতে হয়নি,থানায় জিডি করেছিলো তার বাবা-মা,পুলিশী জিম্মায় তাকে ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়…পারিবারিক চাপ,বিচ্ছেদ ও প্রতারণার শোক,এবর্শন সব মিলিয়ে চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়ে অষ্টাদশী কিশোরী নাজলী…আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে আসছিলো,কিন্তু আজ তার অতীত আবার সামনে এসে দাঁড়ালো…এ অতীত বিশ্বাসভঙের অতীত,এ অতীত ঘৃণার অতীত…
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×