রিকশা সিমিকে রাস্তার মাথায় নামিয়ে দিয়েছে,ঘর থেকে অনেক দূরে…
সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছে,আকাশে সূর্যের শেষ চিণ্হ আঁচড় কাটছে। সিমি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটা ধরলো। সে সকাল সাতটা থেকে ঘরের বাইরে আছে,এখন ফিরছে…কোচিং এর খাতা,প্র্যাকটিক্যাল খাতা,বই সব মিলিয়ে সিমির পিঠের ব্যাগটি খুব ভারী হয়ে আছে…সে খুবই পরিশ্রান্ত বোধ করছে,হাঁটতে পারছেনা। রিকশা হাউজিং সোসাইটির পাহাড়ি উঠন্তি বেয়ে উঠতে পারেনা বলেই সবাইকে এখানে নামিয়ে দেয়।
এতক্ষণ পিনিপিনে বৃষ্টি হচ্ছিল,হঠাৎ বলা নেই কউয়া নেই বারিধারা ইলশেগুঁড়ি থেকে মুষলধারে রূপ নিলো…সিমি ভিজে যাচ্ছে,সে দৌড়ে উল্টো গিয়ে বন্ধ একটি সুপারশপের ছাউনীতে ঢুকে পড়ে। সিমির মোবাইল নিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সম্ভবত জে-এসসি পরীক্ষার আগে পর্যন্ত আর ফেরত দেয়া হবেনা,তা নাহলে বাসায় ফোন করে ছোট ভাইকে ছাতা নিয়ে আসতে বলতে পারতো। কিন্তু এখন বৃষ্টি ধরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন গতি নেই। অগত্যা সে সুপারশপের ছাউনীর রেলিং এ বসে পড়লো…কংক্রিটের রেলিং সিমির কোমরের চেয়ে উঁচু,লাফিয়ে উঠতে হলো। রেলিং এর একপাশে সুপারশপের শাটার,আরেকপাশে কিছু পরিত্যক্ত রেক-চেয়ার স্তুপীভূত করে রাখা আছে। শনিবারে এই সুপারশপটি বন্ধ থাকে।
আরো কিছু লোক আর ভাসমান ব্যবসায়ী ছাউনীতে আশ্রয় নিয়েছে। সিমির সেদিকে খেয়াল নেই,সে আপন তালে গুনগুন করে গান গাইছে আর বৃষ্টি দেখছে। রাস্তার সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোতে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোকে তরল সোনার মতো দেখাচ্ছে,তাই মুগ্ধনয়নে দেখছে সিমি।
হঠাৎ তার স্যালোয়ারের পেছনে নরম কি যেন নড়ে উঠে,সে পেছনে চোখ ফিরিয়ে চিৎকার দিতে দিতে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে। একটি ছোট বিড়ালছানা! এখনো চোখ ফুটেনি ভালোমতো,দু-তিনদিন বয়স হবে। গায়ের রঙ সাদাকালো মিশানো।
"কি সুন্দর!''
সিমি বিড়ালছানাটিকে হাতে তুলে নেয়। জঞ্জাল করে রাখা চেয়ার-রেকের মধ্যে মা বিড়াল ছানা দিয়েছে,সিমি সেদিকে তাকিয়ে অন্য কোন ছানা বা মা বিড়াল দেখতে পায়না। সে তার কোলের ওপর বিড়ালের বাচ্চাটিকে নিয়ে খেলতে থাকে…কি সুন্দর,কি আদুরে! সিমি আর কখনো এতো ছোট বিড়ালের বাচ্চা হাতে নেয়নি…
বৃষ্টির ছাট কমে আসলো আধাঘণ্টার মধ্যে,ইতোমধ্যে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পানির হলদে স্রোত নেমে আসছে। সিমি বিড়ালছানাটিকে রেলিঙে নামিয়ে রেখে হাঁটা দেয়। কিছুদূর গিয়ে পেছনে ফিরে দেখে যে বিড়ালছানাটি সেখান থেকে নড়েনি,রাস্তা চেনার বুদ্ধি বা পা শক্ত কোনটাই হয়নি ছানাটির। সিমি ভাবে এভাবে ফেলে গেলে হয়তো কুকুর বা অন্য বিড়াল এসে মেরে যাবে,নতুবা দুষ্টু ছেলেরা গলায় দড়ি বেঁধে টানাট্নি করবে। ভীষণ মায়া লাগলো সিমির। সে ব্যাগের চেন খুললো,বাইরের পকেট থেকে পানির বোতল ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো আর ছানাটিকে বাইরের ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটা দিলো…চেইন কিছুটা ফাঁক করে রাখলো যাতে নিঃশ্বাস পায়…বিড়ালছানা থেকে থেকে পিউঁ পিউঁ করে ডাকছে…এ ডাক সিমির ভীষণ ভালো লাগছে। সে নিজের মধ্যে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে,নারীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এটাই,খোদা তাদের মনে মায়ামমতার জন্য হয়তো আলাদা প্রকোষ্ঠ বরাদ্ধ করে রেখেছেন।
বাসায় ঢুকার পর সিমির ব্যাগে বিড়ালছানা দেখে তার মা হাউমাউ করে রাগ ঝাড়লেন কিছুক্ষণ মেয়ের ওপর,পরে অবশ্য নিজে কোলে নিয়ে আদর করেছেন!
বিড়ালকে খাওয়াতে হবে…ফ্রীজে দুধের প্যাকেট আছে,সিমির ছোট ভাই সাদাফ সিমির স্টীলের খেলনাবাটিতে করে অল্প দুধ গরম করে আনে। কিন্তু বিড়ালছানাতো ভালোমতো দাঁড়াতেই পারেনা,দুধ কি খাবে! এবার কাজে এলো সিমির বাবার ইনসুলিনের সিরিঞ্জ! সুঁচ ফেলে দিয়ে সিরিঞ্জে দুধ ভরে বিড়ালছানাটিকে যত্ন করে দুধ খাওয়ায় দুই ভাইবোন…ওহ! বিড়ালছানা বিড়ালছানা করছি কেন,তার তো একটা নাম দেয়া হয়েছে- ''কুটু''…!!!
কুটুর থাকার জন্য বানানো হয় 'ঘর'…জুতার বাক্সের ভেতরে সাদাফের পুরনো টিশার্ট গুঁজে দিয়ে! দুই-তিন দিনের মধ্যে কুটুর চোখ ফুটে…ছোট ছোট কালো মার্বেলের মতো চোখ দিয়ে অপার বিস্ময়ে পৃথিবী আর তার নতুন অভিভাবকদেরকে দেখে কুটু,তার চেয়ে বেশী বিস্ময় ও আনন্দ সিমি-সাদাফের…
কুটু এখন বেশ ছটফটে হয়ে উঠেছে। সাদাফের টেনিস বল নিয়ে ঘরময় হুটোপুটি করে,সিমি পড়ার সময় টেবিলের নিচে তার ঝুলন্ত পা আঁকড়ে ধরে খেলা করে,মাঝেমধ্যে অবশ্য আলতো কামড় ও দেয়! সিমি ব্যথা পায়না,সুড়সুড়ি অনুভব করে…!
সকালে সাদাফ-সিমি ঘুম থেকে উঠে মাটিতে পা রাখার শব্দ পেলেই কুটু জুতার বাক্স থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসে পা জড়িয়ে ধরে,আঁচড়াআঁচড়ি করে…
কয়েকদিন পর সিমি-সাদাফের ছোটমামা বেড়াতে আসেন তাদের বাসায়। সিমি-সাদাফের বাবা দেশের বাইরে গিয়েছেন কিছুদিনের জন্যে ব্যবসায়িক কাজে। ছোটমামা রাতে সাদাফের সাথে এক রুমে এবং অন্য রুমে মা এবং সিমি ঘুমায়।
সেদিন ছোটমামা সকালে ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যাচ্ছিলেন,সিমি-সাদাফের পায়ের শব্দ ভেবে কুটু দৌড়ে আসে আর ছোটমামা বেখেয়ালে কুটুর গায়ে পুরো পা চাপিয়ে দেন। কুটুর তীব্র চিৎকারে সবাই ঘুম ভেঙে দৌড়ে আসে। কুটু আর কোন আওয়াজ করছেনা,থেকে থেকে অল্প অল্প লেজ নাড়াচ্ছে। সিমি কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে আর মা দোয়া করছেন যেন তাড়াতাড়ি জান কবজ হয়,বেশীক্ষণ যেন কষ্ট সইতে না হয়…
সিমি-সাদাফ দেড়ঘন্টা নিস্তেজ কুটুর পাশে বসে থাকে,এখনো মারা যায়নি…কথায় বলে ''বিড়ালের প্রাণ'',কিন্তু এতো নিতান্তই শাবক…
এবার সিমি হাসপাতালে নেবার জন্য উঠেপড়ে লাগে…কাছেই পশু হাসপাতাল; মামা,সাদাফ আর সিমি জুতার বাক্সে করে কুটুকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ভেটেরনারী ডাক্তার এক্সরে করিয়েছেন,ঘাড়ের পেছনের হাড় ভেঙেছে বিড়ালছানার…অচেতন অবস্থায় আছে এখন,জ্ঞান নাও ফিরতে পারে। ডাক্তার স্যালাইনের লাইনে করে ডেক্সট্রোজ দিচ্ছেন কুটুকে শরীরের তাপ ধরে রাখার জন্যে। ডাক্তার আরো কিছু চিকিৎসা করে বাসায় নিয়ে যেতে বললেন। কুটুকে ২ ঘন্টা পর পর ১০ ফোঁটা করে ডেক্সট্রোজ খাওয়াতে হবে। কুটু অচেতন,তাই মুখ ফাঁক করে কোনমতে খাওয়াতে হচ্ছে।
দুদিন পর কুটু দুপুরের দিকে হঠাৎ পিউঁ শব্দে ডেকে উঠে,জ্ঞান ফিরেছে…বাক্সে পা ছুঁড়ছে,দাঁড়াতে পারছেনা। তার পেছনের বাম পাও ভেঙেছে,ডাক্তার ধরতে পারেন নি…আর ঘাড়ের হাড় ভাঙায় সম্ভবত প্যারালাইসিসড হয়ে পড়েছে,কুটু মাথা আলগাতে পারছেনা। সিমি আবার অঝোরে কাঁদতে থাকে,নামাজ পড়ে দোয়া চাইতে থাকে যেহ কুটু সুস্থ হয়ে যায়। আরো ১২ দিন পর কুটু উঠে দাঁড়ায়,কিন্তু কাওকে চিনতে পারেনা…এক জায়গাতেই ঘুরে ঘুরে হাঁটতে থাকে,সবাই বুঝতে পারে সে সে দৃষ্টিশক্তিও হারিয়েছে; খাট,চেয়ার,দেয়ালে গিয়ে বাড়ি খাচ্ছে…
আর কিছুদিন পর সে পুরোপুরি সবল হয়ে উঠে,যদিও অন্ধ এবং গলার ডাক ও চিনতে পারেনা। আগে মাটিতে টয়লেট করতোনা,এখন করে।
একদিন বেশ দেরী করে ঘুম থেকে উঠে সবাই। সাদাফ স্কুলে চলে গিয়েছে,সিমির টেস্ট পরীক্ষা বলে রাত জেগে পড়েছে। ঘুম থেকে উঠেই কুটুকে বাক্সে খুঁজে সে। বাক্সে নেই। তন্ন তন্ন করে সব আসবাবপত্রের নিচে,দরজার আড়ালে খোঁজে সে; পায়না…সিমির মাও ঘুম থেকে উঠে সারাবাড়ি এলো করে খুঁজতে থাকেন…পাওয়া যায়না।
তারা ধরে নিয়েছে যে হুলো বিড়াল ঢুকে নিয়ে গিয়েছে কুটুকে…আবারো কান্নার তোড়ে খেই হারিয়ে ফেলে সিমি…
সিমিদেরক ওয়াসার পানি সেদ্ধ করে খেতে হয়। বড় বড় ডেকচিতে পানি ফুটিয়ে রাখা আছে,সিমি গ্লাসে করে পানি নিতে গিয়ে দেখে যে খাবার পানির ডেকচিতে কুটুর মৃতদেহ পড়ে আছে। রাতে বাক্স থেকে নেমে পায়চারী করার সময় পানির ডেকচিতে উঠে পড়ে মারা গিয়েছে। সিমি হাত দিয়ে ধরে মৃতদেহটি ডেকচি থেকে তোলে,কাঠের মতো হয়ে জমে শক্ত হয়ে আছে…অনেক আগেই মারা গিয়েছে। সিমি আর সাদাফ পাহাড়ে গিয়ে মাটিচাপা দিয়ে আসে কুটুকে। সিমি এবার কাঁদেনা,সে শোকে মূহ্যমান হয়ে গিয়েছে,কেমন যেন ঘোরাচ্ছন্ন হয়ে আছে সে।
সেদিন রাতেই শরীর কেঁপে কেঁপে সিমির প্রবল জ্বর আসে। ১০৪ ডিগ্রী পেরিয়েছে জ্বর,সিমি প্রলাপ বকছে…সে তার চারিদিকে হলদে রঙের করে দেখতে পাচ্ছে। সিমি দেখে কুটু যেন তার বিছানার পাশে এসে পিউঁ পিউঁ করে কান্না করছে আর তার হাতে খামচি দিচ্ছে…সিমি জ্বরের ঘোরে বলছে
''আমাকে আর কষ্ট দিসনা তুই…তোকে তোর মায়ের কাছ থেকে চুরী করে এনেছি বলে এতোবড় শাস্তি দিলি আমাকে…আমি জানি আমি তোকে চুরী করে পাপ করেছি,কিন্তু তাই বলে এতোবড় শাস্তি? তুই জানিস যে আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবোনা,তাই তুই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিস যাতে আমি কষ্টে শেষ হয়ে যাই…চলে যা,যেখান থেকে এসেছিস সেখানে চলে যা…চলে যা…দূর হ লক্ষীছাড়া বিড়াল…দূর দূর''