পিচের রাস্তায় ভারী ফোঁটায় বৃষ্টিপাতের একটানা শণ-শণাত শব্দের তালের মাঝে একটি মৃদু ধাতব শব্দ আলাদা হয়ে ধরা পড়লো শুভ্র’র কানে। সে মৃদু কৌতুহলী হয়ে শব্দের উৎসের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।...
বর্ষার প্রথম বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে আজ,সেই বিখ্যাত মুষলধারের বৃষ্টি। শুভ্র প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বের হয়,সারাদিনের ক্লাস,প্র্যাকটিক্যালের ধকল কাটাতে। আজও বেরিয়েছিলো প্রতিদিনকার মতো,১৫ মিনিট আন্তাজ হাঁটার পর হঠাত বলা নেই কওয়া নেই আকাশের কমলা আভা মুছে গিয়ে গাঢ় ধূসর রঙ স্থান করে নিলো আর শুরু হলো বৃষ্টি। আধঘন্টা ধরে শুভ্র একটি বন্ধ চায়ের দোকানের চালার নিচে বেঞ্চিতে বসে আছে,বৃষ্টির থামার নামগন্ধ নেই। বিকেল বেলায় চায়ের দোকানগুলোতে বেশ ভীড় হয়,তবে এই দোকানটি এসময়ে বন্ধ কেন? দোকানদারের বা তার পরিবারের কিছু হয়নিতো? শুভ্রকে এজাতীয় ছোটখাট জিনিস বেশ চিন্তামগ্ন করে তোলে প্রায় সময়। অন্য সময় হলে শুভ্র আকাশে ভারী মেঘের গর্জন শুনে খুশী হতো,বৃষ্টিতে ভিজতো...আজ সে ভিজছেনা,তার মন কেমন যেন খচখচ করছে অকারণে।
শব্দটা ছিলো উড়ে আসা একটি রঙিন ছাতার পতনের। ছাতাটি ধরতে পেছনে পেছনে ছুটে আসছে একটি মেয়ে,ছাতাটির মালিক। এদিকেই আসছে,তবে ইতমধ্যেই মেয়েটি ভিজে জবুথবু হয়ে পড়েছে। শুভ্র চিন্তা করছে যে মেয়েটি এমনিতেও ভিজে গিয়েছে,তবে দৌড়োচ্ছে কেন,বেকুব মেয়ে...!
“এইযে ভাইয়া,তোমার কাছে কি টিস্যু হবে?”
মেয়েটি হন্তদন্ত হয়ে দোকানের চালায় ছাতা কুঁড়িয়ে এসে শুভ্রকে জিজ্ঞেস করলো।
“না টিস্যু তো নেই,তবে রুমাল আছে”
“আচ্ছা,আমার তাতেই চলবে...একটু দাও দয়া করে”
শুভ্র অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো,একটি অপরিচিত মেয়ে তার ব্যক্তিগত রুমাল দিয়া মুখ-মাথা মুছবে এ ব্যপারটিই তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। সে সঙ্কুচিতভাবে পকেট থেকে লাল রুমালটি বাড়িয়ে দিলো মেয়েটিকে।
শুভ্র তাকিয়ে তাকিয়ে মেয়েটিকে দেখছে,মেয়েটি মুখ-হাত মুছতে মুছতে গুনগুনিয়ে গান গাইছে- “আমি তাকিয়ে এখনো বৃষ্টি তোমায় ভেজায় বলে”...
মেয়েরা সাধারণত ভিজে গেলে অন্য লোকের সামনে লজ্জাবোধ করে,এরকম পরিস্থিতিতে হলেতো কথাই নেই অথচ এই মেয়েটি শুভ্রকে লজ্জা পাচ্ছেনা; উপরন্তু গান গাইছে তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। শুভ্র’র চেহারায় একটি বালকসুলভ ভাব রয়েছে যার কারণে অপরিচিত অনেকেই কোন কথা বলতে প্রথম পরিচয়ে তাকে ‘বাবু’,’এই শোন’ এসব বলে কথা শুরু করে। তাকে কি এতই ছোট লাগে যে এই মেয়েটি তার উপস্থিতিকে পাত্তা দিচ্ছেনা? শুভ্র’র মন-মেজাজ আরো খারাপ হতে লাগলো।
“হ্যালো,আমি রোদেলা” বলে হঠাত মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিলো এগিয়ে এসে শুভ্র’র দিকে।
শুভ্রও হকচকিয়ে গিয়ে যন্ত্রচালিতের ন্যায় হাত বাড়িয়ে দিলো,রোদেলা হাত টেনে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে। শুভ্র এবার বুঝতে পারলো যে তার চেহারার কারণে নয়,মেয়েটি যথেষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী বলেই একটা গা-ছাড়া ভাব রয়েছে ওর মধ্যে।
“হাই রোদেলা,আমি আহমেদ শিহাব সাদী...সবাই শুভ্র বলে ডাকে”
“বাহ,শুভ্র নামটি আমার বেশ ভালো লাগে...তবে তোমার আসল নামটিও বেশ ভালো,একটি সম্ভ্রান্ত সম্ভ্রান্ত ভাব রয়েছে!”
শুভ্রকে মেয়েটি তুমি তুমি করে বলা শুরু করেছে,শুভ্রও তাকে তুমি করে বলবে কিনা কূল পাচ্ছিলোনা,সে শুধু বললো “রোদেলা নামটিও সুন্দর”
“হুম আমি জানি যে আমার নামটি সুন্দর হিহিহি! দেখি একটি গান শোনাও তো!”
ওমা! এ মেয়ে বলে কি!
“আমি গান গাইতে পারিনাতো!”
“আচ্ছা কবিতা শোনাও তবে...তোমার চোখের দৃষ্টি কবিদের মত,তুমি কবিতা অবশ্যই জানো” এই বলে রোদেলা তাকিয়ে রইল শুভ্র’র দিকে,এমনভাবে বুকের উপর হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে আছে যেন কবিতা না জানা কিংবা না বলা শুভ্র’র জন্য বিশাল অপরাধ বা অযোগ্যতা।
শুভ্র আবৃত্তি করছে-
“ভুলেতো গিয়েছো আমায় সেই কখন,
তবে কেন আসো বারে বার ভাঙতে এ মন,
দুজনার দু’পথ আলাদা আজ জনমের তরে
তবে কেন অশ্রু ঝরে অতীতেরে স্মরে...”
-বাহ দারুণ তো,কার লেখা কবিতাটি? আগে কোথায় যেন পড়েছি মনে হচ্ছে...
-আগে কোথায় পড়েছো আমি জানিনা,এটি আমারই লেখা
-হ্যাঁ মনে পড়েছে,আমি ফেসবুকে পড়েছি একজনের প্রোফাইলে
-কার প্রোফাইল?
-‘শুভ্র মেঘের ছায়া’ নামের একজনের আইডিতে
-ওটা আমারই আইডি
-ও আচ্ছা তুমি তাহলে ফেসবুকের শুভ্র? আমার আইডির নাম ‘চলন্তিকা’,চিনতে পেরেছো?...তুমি এতো সুন্দর করে কিভাবে লেখ?! আমার তো তোমার প্রোফাইল দেখে মাঝেমাঝে হিংসে হয়!
শুভ্র ওকে চিনতে পারলো,চলন্তিকা’র সাথে ফেসবুকে ওর প্রচুর চ্যাটিং হয়। তবে চলন্তিকা তো বলেছিলো যে ও রাজশাহী থাকে।
-তুমি না রাজশাহী থাকতে?
-হ্যা,রাজশাহীতে থাকতাম...আমার বাবা ট্রান্সফার হয়েছে এখানে...ওহ,বৃষ্টি থেমেছে...চল আমার বাসায় চলো। আমার আপুও মাঝে মাঝে তোমার লেখা পড়ে,তোমাকে দেখতে পেলে বেশ খুশী হবে।
-নাহ প্লীজ আজকে না,কালকে আমার ক্লাস টেস্ট আছে। এমনিতেই আজ দেরী হয়ে গেলো বৃষ্টির কারণে,জানোই তো মেডিকেলে পড়াশোনার কতো চাপ...
-তুমি মেডিকেলে পড়ো? আমি এখানে ল্যাবরেটরী কলেজে ভর্তি হয়েছি ইন্টার সেকন্ড ইয়ার,কমার্স নিয়ে। তুমি কোথায় থাকো?
-আমি মেডিকেলের হোস্টেলেই থাকি
-আচ্ছা তোমার নাম্বারটা দাও তো
শুভ্র মেয়েটির সাথে পূর্বপরিচয়ের সূত্র পেয়েছে,তাই এবার তেমন সঙ্কোচ না করেই নাম্বার দিয়ে চলে এলো হোস্টেলে। প্রচুর পড়া,রাতের ২-৩টা অবধি না পড়লে এঁটে ওঠা যাবেনা।
শুভ্র বাহিরে যতোই রক্ষণশীল আচরণ করুক না কেন,ভেতরে ভেতরে তার একটি একাকীত্ব রয়েছে। সে রোদেলার সাথে একটু রয়েসয়ে কথা বলছিলো তা তার সহজাত লাজুকতা ছাড়া আর কিছুই নয়,সে তাকে পছন্দ করেছে বেশ। ফেসবুকে রোদেলা শুভ্রকে ছবি দিয়েছিলো,হঠাত করে অন্য পরিস্থিতিতে দেখার কারণে তাকে চিনতে পারেনি শুভ্র। আচ্ছা,শুভ্রতো একবার রোদেলা ওরফে চলন্তিকাকে ছবি দিয়েছিলো ইনবক্সে,তবে রোদেলা কেন চিনতে পারলোনা শুভ্রকে? নাকি সে ইচ্ছে করেই শুভ্রকে কবিতা বলতে বলেছে যাতে সামনাসামনি পরিচয়পর্বে নাটকীয়তা আনা যায়? ফেসবুকে রোদেলার সাথে শুভ্র’র বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পরক,অনেকটা প্রেমের পর্যায়েই পড়ে তা,কখনো কেও কারো কণ্ঠ শোনেনি এই যা! শুভ্র মনে মনে ভাবে “যাক বাবা,বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম যে মেয়েটি একথা বলেনি- এত পিচ্চি ছেলে এতসব পাকনামো কঠা থেকে শিখলে?”। রোদেলা বেশ স্মার্ট ও আত্মবিশ্বাসী,এটি বলা তার জন্যে তেমন কোন ব্যপার ছিলো না। শুভ্র রোদেলার চেহারা মনে করার চেষ্টা করে,তার মুখ অজান্তে হাসি হাসি হয়ে ওঠে। বইয়ের পাতা উল্টাতে যাবে এসময়েই ফোন বেজে উঠলো শুভ্র’র। রোদেলারই ফোন ছিলো,ফাজিল মেয়েটা বলে “সত্যি সত্যি তোমার নাম্বার ছিলো কিনা দেখলাম”...!
সেদিন শুভ্র পড়াশোনায় তেমন মন বসাতে পারলোনা,দেড়টা বাজতেই ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে এলো। ঘুমের ঘোরে সে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখলো।
দেখলো যে সে আর রোদেলা একটি বিশাল তেজী ঘোড়ার পিঠে বসে আছে,ঘোড়াটি প্রবল বেগে ছুটে চলেছে নিমিষেই মাঠ,মরুভূমি,মহাসাগর,বরফ পার হয়ে। শুভ্র ঘোড়ার লাগাম ধরে ছিলো আর পেছন থেকে রোদেলা শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে ছিলো। বরফ পার হবার সময় হঠাত ঘোড়ার খুর বরফে হড়কে গেলো,ঘোড়ার খুরের আঘাতে বরফ ভেঙে পানির স্তর হয়ে যাচ্ছে,আর রোদেলা পিছলে পানিতে পড়ে গেলো। শুভ্র রোদেলাকে বাঁচাতে ঝাঁপ দিলো হিমশীতল পানিতে। রোদেলাকে ঠেলে বরফের দিকে পৌঁছে দিলো শুভ্র,কিন্তু সে নিজেই তলিয়ে যাচ্ছে...যাচ্ছে...যাচ্ছে...
শুভ্র নিঃশ্বাস পাচ্ছেনা,দম ফুরিয়ে আসছে...সে চাইছে ‘মা’ বলে একবার ডাকতে। ‘মা’ বলে ডাকতে যাবে এমনসময় ঘুম ভেঙে গেলো তার। বিদ্যুৎ চলে গিয়ে ভ্যাপসা গরম পড়ছে,বর্ষাকালের গরম শুভ্র’র অসহ্য লাগে। সে ভাবছে এ গরমের মধ্যে স্বপ্নে বরফপানিতে তলিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখলো কেন। স্বপ্নটিকে সে দুঃস্বপ্ন বলে আখ্যা দেবে নাকি শুধুই স্বপ্নের কাতারে ফেলবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছিলোনা।
তার আর ঘুমে ধরছেনা,তার খুব ইচ্ছে করছে এ স্বপ্নের কথা যেন রোদেলা জানতে পাক। আচ্ছা,রোদেলার পুরো নাম কি? জানতে চাওয়া হয়নি তো...তাকে কি ফোন দেয়া যায়? থাক এতো রাতে ফোন দেয়ার কোন মানে হয়না,হয়তো পাশে তার বড় বোন থাকবে। শুভ্র ল্যাপটপ ওপেন করে স্বপ্নের কথা লিখে পাঠিয়ে দিলো ‘চলন্তিকা’ ওরফে রোদেলার ফেসবুক ইনবক্সে...যাক বাবা একটু শান্তি লাগছে এখন...
চোখে ঘুম নেই বলে শুভ্র ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো,মিনিট দশেক পর অপ্রত্যাশিতভাবে শুভ্রকে রিপ্লাই দিল রোদেলা,মেয়েটিও এখনো জেগে আছে এতো রাতে? শুভ্রকে বেশী চিন্তা না করতে মানা করেছে সে। রোদেলা স্বপ্ন নিয়ে বেশী মাথা না ঘামাতে বলেছে ওকে,তার মানে স্বপ্নটিকে নির্ঘাত দুঃস্বপ্নের কাতারে ফেলা যায়,তবে শুভ্র’র কাছে সেটি এখন খুব ভালো একটি স্বপ্ন কারণ ঘোড়ার পিঠে সারা পথ শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো রোদেলা,শুভ্র যেন এখনও রোদেলার সে উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করছে তার পিঠে,রোদেলার নিঃশ্বাস যেন তার কানে এসে লাগছে সত্যি সত্যিই,স্বপ্ন এতো জীবন্ত হয় কিভাবে?
শুভ্র প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে বের হয় যথারীতি,তার কোন বন্ধু নেই বলে একাই বের হতো। এখন তার সাথে রোদেলা থাকে। মেডিকেল কলেজের পাশের সোসাইটির ভেতরের সুনসান রাস্তার একদিক দিয়ে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে বের হতে হতে অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ।
শুভ্র ইতোমধ্যে অনেকবার রোদেলাদের বাসায় গিয়েছে,রোদেলার বাবা-মা ও বিশেষ করে তার বড় আপু সেলিনা বেশ সমাদর করে শুভ্রকে। বাড়ী থেকে বহুক্রোশ দূরের এই যান্ত্রিক শহরে রোদেলাদের বাসাতেই যেন সে পরিবারের স্বাদ পায়।
একদিন রোদেলা ও শুভ্র বিকেলে ছায়াঘেরা পথটির পাশে বানানো কংক্রীটের বেঞ্চে বসে গল্প করছিলো,আশেপাশে তেমন কেও ছিলোনা..। সোসাইটির রাস্তা,যারাই আসে সাঁ সাঁ করে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে যায়।
রোদেলা- আমার হাতটি একটু ধরবে?
শুভ্র- সবসময়ই তো ধরি,আজ এভাবে বলছো যে?
রোদেলা- নাহ এমনিই...ধরো না একটু
রোদেলার আচার-আচরণে কেমন যেন পরিবর্তন এসেছে শুভ্র’র সাথে দেখা হবার ৬ মাসের মধ্যে,পরিবর্তনটি খুব ধীরে ধীরে হওয়ায় শুভ্র ধরতে পারেনি এতোদিন। কিন্তু শুভ্র আজ যখন রোদেলার হাত ধরলো সে তখন কেমন শুণ্য দৃষ্টিতে যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো,হতাশ; অকূল সমুদ্রে দিক হারানো জাহাজীর দৃষ্টিতে...শুভ্র বুঝতে পারলো যে এই রোদেলা আগের সে স্বতঃস্ফূর্ত,আত্মবিশ্বাসী রোদেলা নয়।
শুভ্র কাতর গলায় রোদেলার সামনে হাঁটুগেঁড়ে বসে তার দু’হাত বুকে জড়িয়ে ধরে বলল “কি হয়েছে তোমার?”
রোদেলা শুকনো হাসি দিয়ে দৃষ্টি আরেকদিকে সরিয়ে নিলো। শুভ্র বেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো মানসিকভাবে। রোদেলা মুখ ফুটে কিছু বলছেনা শুভ্রকে,জিজ্ঞেস করলে অন্যদিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসে কিংবা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।
সেলিনা আপাকে অনেক জোরাজুরি করার পর শুভ্র ভয়ঙ্কর কথাটি জানতে পারলো- রোদেলার ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে।
শুভ্র বিমূঢ় হয়ে গেলো। এ কি শুনল সে নিজের কানে,শুভ্র কান চেপে আছে...সে সত্যকে অস্বীকার করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে “নাহ নাহ,তুমি মিথ্যা বলছো সেলিনা আপু,মিথ্যা মিথ্যা...”
শুভ্র দৌড়ে বেরিয়ে চলে এলো ওদের বাসা থেকে...মেডিকেলের মাঠে বসে হাঁপাতে লাগলো,কান্নার দমক আসছে কিন্তু কাঁদতে পারছেনা সে,কান্না যেন বুকের কাছাকাছি এসে বাঁধা পাচ্ছে কোন কিছুতে।
রোদেলাকে চিকিৎসার জন্যে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। রোদেলা ২ মাস পর ফিরে এলো; বিজনেস ক্লাস সীটে চড়ে নয়; বিমানেই এসেছে,তবে নাম্বার লেখা কাঠের বাক্সে চড়ে।
আজ প্রায় একমাস হয়ে গেলো রোদেলা নেই,তবে শুভ্র মাঝেমাঝে রোদেলাকে দেখতে পায়, দেখতে পায় যে সে সোসাইটির রাস্তাটির বেঞ্চে বসে আছে...শুভ্রকে ডাকছে,কবিতা শুনাতে বলছে। শুভ্র রোদেলাকে জিজ্ঞেস করে “কেমন আছো”,রোদেলা জবাব দেয়না...রোদেলা এমন হলো কেন,আজকাল কোন কথারই জবাব দেয়না,শুভ্র মনে মনে ভাবে...সে রোদেলার হাত ধরে,সে কিছুই অনুভব করেনা,যেন বাতাসে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে আছে...রোদেলা আহত দৃষ্টিতে হাতের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে যায়...
শুভ্র চিৎকার করে “আরেকটু থাকো,যেওনা...যেওনা...প্লীজজজজ...দয়া করে আরেকটুক্ষণ থাকো”
শুভ্রকে মেডিকেল কলেজ থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়েছে,সে এখন পুরোপুরি মানসিক বিকারগ্রস্ত। সারাক্ষণ তার মুখে একটিই কথা “নিয়ে যাও,নিয়ে যাও আমাকে...একা একা চলে যেওনা...আমাকে সাথে নিয়ে যাও”
শুভ্র এখন সে ঘোড়ার পিঠে চড়ার স্বপ্নটি প্রতিদিন দেখে,সে বৃষ্টির রাতে স্বপ্নটির এক বিশেষ অংশে এসে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলো,এখন পুরো স্বপ্নটিই দেখতে পায়...সে ‘মা মা’ বলে চিৎকার করছে অতল বরফজলে তলিয়ে যেতে যেতে...কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হয়না,সে দেখতে পায় যে রোদেলাও বরফের স্তর ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে,সে পানির নিচে রোদেলার হাত ধরার চেষ্টা করে,রোদেলা হাত বাড়িয়ে দেয় কিন্তু শুভ্র’র নাগাল পায়না,সে অতলে হারিয়ে যায় আর শুভ্র ভেসে উঠে ঘোড়ার লাগাম ধরে...কিন্তু তাকে উদ্ধার করেই ঘোড়াটি পালিয়ে যায়,জনমানবহীন এক বরফের রাজ্যে একা ফেলে রেখে,এখানে কেও নেই,চারিদিকে শুধুই সাদা।
“রোদেলা শুনতে পাচ্ছো গো? এখানে সবাই আমায় পাগল ডাকে,দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় আমাকে বন্ধ ঘরে,জানালা দিয়ে খাবার দেয়...আমাকে পাগল কেন বলে? আমি পাগল নই...তুমি আমার সাথে আছো এটাই বাস্তব,বাকি সব বিভ্রম...সবাই পাগল,আমি নই...আমি পাগলদের সাথে থাকবো না,আমি তোমার কাছে আসছি”
এটিই ছিলো শুভ্র’র সুইসাইড নোট। তাকে যে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছিলো সেটিকেই দিনের পর দিন আস্তে আস্তে দাঁত দিয়ে কেটে ছিঁড়ে ফেলেছিলো,সে দড়ি ফ্যানে লাগিয়ে শুভ্র ফাঁসীতে ঝুলে পড়েছিলো।