পায়খানার গন্ধে রি রি করছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সি ইউনিট। ষোল-সতের বয়েসী এক কিশোরী কীটনাশক পান করেছে,২ মাইল দূর থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে হাসপাতালে। বিষক্রিয়ার ফলে সে শরীরের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে,কাপড়চোপড় নোংরা করছে।
ইমারজেন্সীর অন্য রোগীদের অভিভাবকেরা কেও বিরক্ত,কেও আশ্চর্য,কেও ঘৃণা আবার কেওবা সমবেদনার দৃষ্টিতে পরপারযাত্রী মেয়েটিকে দেখছে। এখনো বিষপান করা মেয়েটির চারিদিকে পর্দা দেয়া হয়নি। কিছু ওয়ার্ডবয় ও উটকো দালাল লোলুপ দৃষ্টি বুলাচ্ছে তার সারা শরীরে।
কে একজন বলে উঠলো ''মরবি তো মর,অন্যকে শান্তি দিয়া মর…পোকার বিষ খাইয়া সবাইরে লানতে ফেইলা কোন পিরিতি মারাইছস রে বান্দির ঝি…''।
মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে তার মা ও চাচাতো ভাই। ইমারজেন্সি রুমের বাইরে সিএনজিওয়ালা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে,একে তো তার সিএনজি ভাড়া দেয়া হয়নি তার ওপর সিএনজির সীট মলে ভরে গিয়েছে। মেয়ের মা বারবার মাফ চাইছে,তার হাতে ২৫টা ভাংতি টাকা বাদে কানাকড়িও নেই। আধঘন্টা ক্রমাগত অশ্রাব্য গালাগালি,সাথে বিষ খাওয়া মেয়েটিকে শাপ-শাপান্ত করে ২৫ টাকা নিয়েই বিদেয় নিলো সিএনজিওয়ালা।
এদিকে মেয়েটির মুখগহবর দিয়ে পেটে নল ঢুকানো হয়েছে,বমি করানোর চেষ্টা চলছে। মেয়েটি দাঁত দিয়ে নল কামড়ে ধরেছে,কিছুতেই ওয়াশ করাতে দেবেনা; সে মরতে চায়
ডিউটি ডাক্তার,নার্স,বয় সবাই চোয়াল নাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে,কিছুতেই কামড় ছাড়ছেনা। এক পর্যায়ে থাপ্পড় দেয়া শুরু করে কয়েকজন মিলে,ডাক্তারের চোখেমুখে ভয়ের চিণ্হ। মা মরাকান্না জুড়ে দিয়েছে।
মলের গন্ধ,ফিনাইলের গন্ধ,ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ,মেয়ের মায়ের আর্তচিৎকার,আরেকজন আগুনে পোড়া রোগীর আর্তনাদ সব মিলিয়ে ইমারজেন্সী ইউনিটের ভেতরে এক নারকীয় পরিবেশ,বীভৎস কিছু একীভূত দৃশ্য।
ফ্ল্যাশব্যাকঃ-
জায়েদ দুবাই থেকে ফিরেছে মাস দুয়েক হয়েছে। সে বিদেশে কোন এক ধনকুবেরের শোফারের চাকরী করে বেশকিছু টাকা জমিয়ে দেশে ফিরেছে। গ্রামের সবাইকে বলে বেড়ায় যে সে বিদেশে গাড়ীর পার্টসের ব্যবসা করতো এবং এখন দেশেই কাপড়ের ব্যবসা ধরবে। দেশে ফিরে আসার মূল কারণ অন্য কিছু নয়,সে দেশের সরকার অবৈধ অভিবাসনের দায়ে জায়েদসহ আরো কয়েকজনকে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
দেশে ফিরে সে জমানো টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কেনে,বাজারের মাঝখানে ৫ লাখ টাকা সেলামী দিয়ে কাপড়ের দোকান দেয়। মোটামুটি দারিদ্র্যপীড়িত জনপদে চোখে পড়ার মতো অবস্থাসম্পন্ন চালচলন। বেশ কিছু দুধের মাছি বন্ধুবান্ধব জোটে যায় জায়েদের,সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকান,সন্ধ্যার পর তাসের আসরে মাঝরাত পর্যন্ত আড্ডা।
বাবা মারা যাবার পর পাওয়া ৪ গণ্ডা ভিটেয় বাড়িও করা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।
বন্ধুদের তাসের আড্ডার বিষয়বস্তু ছিলো অশালীন…কার ঘরের মেয়ের চরিত্র খারাপ,কোন মেয়ের শরীর ভালো,কোন মেয়ে দেখতে অপু বিশ্বাসের মতো এসব…
বেশীরভাগ সময় গ্রামের এতিম মেয়ে লুতফাকে নিয়ে আলোচনা হতো। ইদানিং চোখে পড়ার মতো ডাগর হয়ে উঠেছে,চালচলনে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পনের স্ব-অনাকাঙ্খিত বহিঃপ্রকাশ,যা তাবৎ পুরুষের চোখে আবেদন হিসেবে মোহনীয় রূপে ধরা পড়ে। লুতফার মা বিড়ির কারখানায় বিড়ি বাঁধার কাজ করে,দিনে ১৫০ টাকা মজুরী। তা দিয়ে মেয়েকে হাই স্কুলে পাঠিয়েছে। এখন অবশ্য খরচ তেমন একটা হয়না কারণ লুতফা অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে,জেলায় দ্বিতীয়।
জায়েদদের পৈত্রিক নিবাস লুতফাদের কয়েক ঘর পরেই,লুতফার মায়ের দূরসম্পর্কের ভাইপো হয়…সে সুবাদে লুতফাদের ঘরে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করে জায়েদ,প্রায়শই লুতফার জন্য চুড়ী,জামাকাপড়,খাবার ইত্যাদি নিয়ে আসে। লুতফার মাকে 'মা' বলে সম্বোধন করতে শুরু করে।
অন্ধের চোখে যেমন জোনাকিও প্রদীপ বলে প্রতিপন্ন হয়,তেমনি লুতফার মাও জায়েদের মেকি অমায়িকতা ও ধনদৌলতের প্রদর্শনীর মোহে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলো।
আর জায়েদ ও ঘরেবাইরে লুতফার মন ভুলানোর চেষ্টা করতে থাকে। স্কুল ছুটির সময় মোটরসাইকেল নিয়ে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা,ছুটির দিনে নাস্তা-উপহার নিয়ে বাসায় হাজির হউয়া,পাশে বসে গল্প করা ইত্যাদি। লুতফাও স্বপ্নের জগতে বিচরণ করতে থাকে,এজগতে কেই বা তাকে এতো দাম দেবে জায়েদ ছাড়া? এই ভেবে তার আত্নতুষ্টি ও জায়েদের প্রতি ভরসার পারদ সপ্তমে চড়তে থাকে। জায়েদের মুখে শীতের দেশের রাজরাজড়ার গল্প চিবুকে হাত দিয়ে ভাবুকের ভঙ্গিতে রূপকথার মতো মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে লুতফা। গালগল্পের মাঝে হঠাৎ খিলখিলিয়ে হেসে দেয়,বেসামাল হয়ে পড়ে। আর এদিকে জায়েদের ভেতরে তুষের আগুন দপদপ করে বাড়তে থাকে দিনের পর দিন।
লুতফার মুগ্ধতা ও জায়েদের কামাগ্নি মিলে একটা সময় তাদের সম্পর্কটি 'প্রেম' পর্যন্ত গড়ায়। স্কুলের নাম করে প্রায়শই জায়েদের দোকানে চলে যেতে শুরু করে লুতফা,আর জায়েদ তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় তাসের আসরের বন্ধুদের সাথে। তারা কেমন করে যেন লুতফার সাথে কথা বলে,লুতফার ভীষণ অস্বস্তি হয়।
এভাবে চলতে চলতে লুতফার গণ্ডী জায়েদের দোকান থেকে নির্মিতব্য ঘরের অর্ধসমাপ্ত কামরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়,আর সময়ের গণ্ডী স্কুলের সময় থেকে বৃদ্ধি পেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
লুতফার মা কারখানা থেকে ঘরে ফেরে রাতে,এতো কিছু দেখার ফুরসত তার নেই।
সেদিন স্কুল থেকে সরাসরি জায়েদের নতুন বাসায় চলে যায় লুতফা,লুতফাকে চাবি দিয়ে রেখেছিলো জায়েদ। কক্ষের দেয়ালে রঙ লাগানো হয়নি এখনো…কক্ষের এক কোণে টিম্বার,রঙের কৌটা,বেলচা,শাবল,সিমেন্টের কড়াই স্তুপ করে রাখা হয়েছে; আরেক কোণে একটি বক্সখাট…
কয়েকমিনিট পর দরজায় কষাঘাত হয়। লুতফা দরজা খুলে একটু বিস্মিত হয়,জায়েদ নয়; তার বন্ধুরা এসেছে ৪ জন।
মজনু বলে ''ভাবিজান,ভাই আসতে তো একটু দেরী হইব,শহর থেইকা মাল আইছে…বুইঝা লইতাছে''…
তারা চারজন রুমে ঢুকে। লতিফ দরজার হুক বন্ধ করে আর টিপু লুতফার মুখ চেপে ধরে। সন্ধ্যার পর থেকে পালাক্রমে মাঝরাত পর্যন্ত পাশবিক নির্যাতন চালায় তারা ৫ জন…হ্যাঁ,ভুল বলিনি ৫ জনই…টিপু,মজনু,লতিফ,আশীষ ঘরে ঢুকার আধাঘন্টাখানেক পরে জায়েদ ও এসে যোগ দেয় তাদের সাথে…
পরের দিন সকালে গ্রামবাসী জায়েদের ঘর ঘিরে ফেলে। তাদের কাওকেই পায়না,রক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায় লুতফাকে।
সে কিছুদিনের চিকিৎসা ও শশ্রুষায় সুস্থ হয়ে উঠছিলো বটে,কিন্তু এ সুস্থতা তার ধাতে সইলো না…বাড়ির পেছনে বেগুনক্ষেতের পোকা মারার বিষের পুরো বোতল গিলে ফেললো…আজকালকার বিষেও ভেজাল বলেই কিনা বিষ খাওয়ার ২ ঘন্টা পরেও এখনো বেঁচে আছে…
এখনো দাঁতে ওয়াশের নল কামড়ে আছে লুতফা,বাঁচতে চায়না সে আর একটিও মুহুর্ত। অবশেষে ৪৫ মিনিটের ধস্তাধস্তির পর সবাইকে নিস্তৃতি দিলো লুতফা…
পুনশ্চঃ- শোনা যাচ্ছে জায়েদের বাজারের কাপড়ের দোকানে বেশ লাভ হচ্ছে,এখন শহরে মোটরসাইকেলের শোরুম ও দেবে…সামনের মাসে তার নতুন ঘরে বউ এনে তুলবে। তিন গাঁয়ের সবাইকে দাওয়াত ও দিয়ে রেখেছে এর মধ্যে।
লুতফার কবরের আদ্রতা এখনো পুরোপুরি শুকায় নি…কবরে গুঁজে দেওয়া খেজুরগাছের ডালগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে।