আশেক ও পুষ্পিতা বসে আছে মাঠের আধাভাঙা সীমানা পাঁচিলের উপর। দুজনে মিলে চটপটি খাচ্ছে…একই বাটি থেকে,একই চামচে করে! তবে নিজে খাচ্ছেনা,আশেককে খাইয়ে দিচ্ছে পুষ্পিতা আর পুষ্পিতা খাইয়ে দিচ্ছে আশেককে।
তাদেরকে এভাবে অন্তরঙ্গ অবস্থায় বসে থাকতে দেখে আশেপাশের লোকজন কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে,সাথে চটপটিওয়ালাও। মাঠে কিছু ছেলে ফুটবল খেলছে,তারা ইচ্ছা করে বারবার এদের দিকে বল ফেলছে এবং বল আনার ছুতো করে দেখতে চাইছে এরা কিছু করে কিনা!!
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আকাশের নীলাভ আভা মুছে যেতে শুরু করেছে পূর্বদিক হতে আচ্ছন্ন হয়ে আসা কালো অন্ধকারের চাদরে।
আশেকঃ- ওহ ওহ আহ আহ আহ…!!!
পুষ্পিতাঃ- কি? কি হয়েছে সোনাবু???
আশেকঃ- ঝঝঝালল…
পুষ্পিতাঃ- ধুর হাঁদারাম,আমি ভেবেছি কি না কি,নে পানি খা…ঝাল খেতে না পারলে চটপটিওয়ালাকে ফুটানি দেখালি কেন ''ঝাল বেশী দেন'' বলে?
পুষ্পিতা মুখ ভেংচে দেখায় যে আশেক কিভাবে ঝাল বেশী দিতে বলেছিলো…
আশেকঃ- পানি লাগবেনা,একটা হামি দিলেই হবে…!
পুষ্পিতাঃ- তোর ফাজলামি আর গেলোনা…হামি খাবে,সাধ কতো…তে যেমনকি আমার ভাতার লাগে!
আশেকঃ- রাগ করিস কেন,তুই না আমার সোনা!
আশেক আর পুষ্পিতা প্রেমিক-প্রেমিকাযুগল নয়,যদিও সবাই প্রথম প্রথম তাদের দেখে তাই ভাবে…তারা একে অন্যের বন্ধু,অন্তঃপ্রাণ বন্ধু…ভুবনভুলানো,বিষাদ তাড়ানো বন্ধু। তাদের এ অস্বাভাবিক মেলামেশা তাদের দুজনের পরিবারের লোকজনের চোখ সউয়া হয়ে গিয়েছে। সেই ছোটকাল থেকে একসাথে বড় হলো তারা,পুষ্পিতা পড়ছে মেডিকেলে আর আশেক পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং নিয়ে। ঈদের ছুটিতে দুজনের দেখা ছয় মাসেরো বেশী সময় পর,আবেগের প্রকাশ যেনো স্থান-কাল-পাত্র থেকে 'পাত্র' বাদে আর দুটোর কোনটি মানতে চাইছেনা। 'পাত্র' বাদে,কারণ আশেক ও পুষ্পিতা একে অন্যের আবেগের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা…তাই যথাপাত্রেই মণিসঞ্চার হচ্ছে!
আশেকের পরিবার থেকে চাইছে তাদের দুজনের গাঁটছাড়া বেঁধে দিতে কিন্তু পুষ্পিতা সেভাবে কিছুই ভাবছেনা…গ্র্যাজুয়েশনের সময় কাছিয়ে এসেছে দুজনেরই,গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পড়েছে শিক্ষাজীবনের দৌড়ের। পুষ্পিতা যখন আশেকের কানের লতিতে আলতো করে কামড় দেয়,যখন এক চামচে দুজন ফুচকা খায় বা নিজের ব্যক্তিগত মেয়েলী জিনিসপত্র কেনানোর কাজটা আশেককে দিয়ে সারিয়ে নিতো বিনাসঙ্কোচে,তখন আশেক ভাবতো ''একি আসলেই আমাকে ভালোবাসেনা? তা যদি নাই হয় তাহলে কেন এই অনর্থক মায়াবী জালের সম্প্রসারণ?''
পুষ্পিতার দোষ দেয়া যায়না,সে কখনো আশেকের কাছে নিজের ভালোবাসার ইঙ্গিত দেয়নি সে অর্থে। আশেক গোসল করে বের হয়ে কোনদিন হয়তো দেখে পুষ্পিতা তার বিছানায় কোলবালিশ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে,আবার আশেকেরই মা টেবিল ফ্যান এনে পুষ্পিতার দিকে তাক করে দিচ্ছেন…এসব দেখলে মনে হয় যেনো একই পরিবারের আবর্তনপথে সব সম্পর্ক ঘুর্ণিপাকের কবলে পড়ে একাকার হয়ে গিয়েছে…
আশেকের জন্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের পার্থক্যপ্রভেদ টিকিয়ে রাখা আজকাল আরো দুরূহ হয়ে পড়ছে…পুষ্পিতাকে দেখলে তার কেন জানি হাহাকার অনুভূত হয় মনে।
পুষ্পিতা এখনো তাকে আগের মতোই চুল আঁচড়ে দেয় বাসায় এলে,সোফায় বসে ফিল্ম দেখতে দেখতে আশেকের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে টিনএজের সময়ের মতোই, তবে এখন পুষ্পিতার চুলের মৃদু গন্ধ আশেকের নাকে ভীষণ তীব্র হয়ে আলোড়নের সৃষ্টি করে…পুষ্পিতার নিয়ন্ত্রণহীন চুল যখন আশেকের নাকেমুখে উড়ে আসে তখন আশেক অনুভব করে যে তারা দুজনের কেওই আর কিশোর-কিশোরী নয়,ভরাযৌবনা যুবক-যুবতী…
আশেক,পুষ্পিতা দুজনেরই বিয়ে হয়ে যায়…পুষ্পিতা এখন আমেরিকা থাকে,তার স্বামী ম্যাসেচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করছে…দেশে প্রচুর ভূসম্পত্তি আছে পুষ্পিতার শশুরবাড়ীতে…দেশে এসে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় খোলার চিন্তা আছে পুষ্পিতা ও তার স্বামী ডক্তর ইনকিয়াদের।
আশেকের স্ত্রী পুরোদস্তুর সংসারী। হিন্দুর ঘরে সে মেয়ের বিয়ে হলে দিনরাত লক্ষীমন্ত,পয়মন্ত এসব সম্ভাষণ শুনতে হতো। আশেকের চেয়ে ইঞ্চিখানেক ছোট,গায়ের রঙ খোলতাই সাদা…আশেকের বাবার বন্ধুর মেয়ে। সারাদিন সারাঘরে গুটগুট করে কাজ করে,মুখ থেকে হাসির রেখা মিলায় না…এক কথায় ঘর আলো করা বউ…জসীম উদদীনের ভাষায় ''সারা ঘরময় এতো সোনা ছড়াইয়া দিলো কারা''…
পুষ্পিতা আজ প্রায় দশ বছর ধরে আমেরিকায়,দেশে আসার পরিকল্পনা অনেক আগেই বাতিল। পুষ্পিতার স্বামী কেপ কেনেডিতে রিসার্চারের চাকরী পেয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা নেয়নি তারা…
আর আশেক তার কর্মক্ষেত্র জেনেটিক্সের দিকে না গিয়ে গ্রামের বাড়িতে বিশাল খামার খুলেছে,ভালো আয় হয়…খামারের পাশে কাউন্টি ফ্যাশনের বাংলোবাড়ী…আশেকের দু বাচ্চা,প্রথম ছেলে আশিয়ান আর এক মেয়ে আফিফা…
আশেকের মনে হয়তো এখন পুষ্পিতাকে নিয়ে প্যারাইউনিভার্সাল চিন্তাভাবনা বা আবেগ কিছুই কাজ করেনা,কিন্তু তবু কোন একদিন হয়তো মনের কোন এক কোণে কিছু একটা 'খচ' করে উঠে! তখন সে ঘুমাতে পারেনা,খামারবাড়ির বারান্দায় গিয়ে আকাশ দেখে,আকাশের বুকে তীরন্দাজ কালপুরুষের তাক করা তীর দেখে, পুকুরের পানিতে তারার প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব দেখে,জোনাকির মিটমিটে আলো দেখে…মাঠের দেয়ালে বসে এক চামচে ফুচকা খাওয়ার দিনগুলো খুব বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠে তার চোখে…তার চেয়ে বেশী এটা মনে আসে যে পুষ্পিতা কি আদৌ তাকে মনে রেখেছে দীর্ঘদিন? জবাব আশেক নিজেই নিজেকে দিয়ে দেয়,নিজেকে সান্তনা দেয় এই ভেবে যে- সময়,কাজ,ক্ষেত্র এসব জিনিস সম্পর্কের গভীরতা পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখে,হাঁটুপানির সম্পর্ককে অতলে নিয়ে যায়,আবার অতলস্পর্শী আবেগকে কফিমগের সমান গভীরতায় নামিয়ে আনে…
আশেক এখন তার শহরের বাসায় এসেছে আরেক কুরবানীর ঈদের ছুটিতে…মানুষ শহর থেকে গ্রামে যায় ছুটিতে,কিন্তু এর উল্টো…কারণ শহরেরই বাসিন্দা আশেকের তিন পুরুষ। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে,রাত এখন আড়াইটা। আশেকের মোবাইলফোনে কর্কশ রিংটোনে বেজে উঠে…
-কে?
-ভালো আছিস সোনা?
-ককককে পুপুপুপুপুষ্পি…তা…
-হ্যাঁরে…তোর তোতলামি আর গেলোনা শালা মৃগিরোগী!!!
-তুতুতুই কোকোথায়?
-পক পক না করে আমাদের সামনের পার্কে চলে আয়
-এততততো রাতে…আমার ওয়াইফফ
-অই হালার পো,তরে না আইতে কইলাম!!! ৫ মিনিটের মধ্যে চইলা আয়!
আশেক এবার স্থান,কাল,পাত্র তিনটাই ভুলে যায়…মাঝরাতে ছাতা ছাড়াই দৌড়ে পুষ্পিতার কাছে যাবার সম্পর্ক বা অধিকার নেই আশেকের। তবু যায়। যায় পুষ্পিতাদের ঘরের সামনের পার্কে…পুষ্পিতা নীল শাড়ি পরেছে…পার্কের নিয়ন আলোয় পুষ্পিতার নীল শাড়ীকে কমলা রঙের মনে হচ্ছে, তাকে দেখে চিনতে পারে আশেক। বয়সের ছাপ পড়েছে পুষ্পিতার শরীর ও চেহারায়…আশেক কাঁদছে,পুষ্পিতা কাঁদছে কিনা আশেক জানেনা,কারণ বৃষ্টি পড়ছে মুষলের ধারে…পুষ্পিতা কাঁদছে না,সে কাঁদতে পারছেনা; তার অশ্রুর জলাধার ফুরিয়ে গিয়েছে নিভৃতে অপচয় হতে হতে...তার কান্নার জলের অভাব চুল বেয়ে গালে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির জল পূরণ করে দিচ্ছে হাসসিমুখে।
বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় নিয়নের হলুদ আলো পড়ে এমন একটি দৃশ্যের অবতারণা করেছে যেন স্বর্গের কোন অলৌকিক ঝরণাধারা থেকে তাদের দুজনের ওপর ভালোবাসার বৃষ্টি হচ্ছে। আশেপাশে কোন টিনের বাড়ি নেই,তবু যেন আশেক বৃষ্টির ঝন-ঝনাৎ শিঞ্জন শুনতে পায়…আশেক এখনো কাঁদছে,এ কান্না আনন্দের এবং এ আনন্দ পুনর্মিলনের;ভশতসহস্র রাতের দলিলী বন্ধন যে পুনর্মিলনকে ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে পর্দার আড়ালে মুখ লুকিয়ে নিয়েছে সঙ্কোচে…