১ম পর্ব
রাহেলা বেগম বিছানার উপর শুয়ে আছেন। তাঁর মনটা বিশেষ ভালোনা। তিনি হিসেবী মানুষ। হিসেব কষে চলতে পছন্দ করেন। ঠিক যেভাবে হিসেব করলে ফলাফলটা মনমতো হবে তিনি সেইভাবেই হিসাব করেন। আজকেও তাই করেছেন। এর আগেও করেছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। মানুষ তাকে ছোট মনের মানুষ বলে। ভুল বলেনা, ঠিকই বলে। তাঁর মনের গণ্ডিটা আসলেও ছোট। তাঁর দুই ছেলে মেয়েদের জন্যেই তাঁর মন, তাঁর জীবন। মানুষের মনের গণ্ডি যত বড় হয়, মনের ভেতরের শান্তিও তত দীর্ঘস্থায়ী হয়। তখন মনের কোন কোনায় ধাক্কা লাগলে অন্য দিক দিয়ে তা সামাল দেয়া যায়। কিন্তু গণ্ডি যত ছোট হয়, অস্থিরতা তত বাড়ে। এক কোনায় ধাক্কা খেলে পুরো মনটাই নাড়া খেয়ে যায়। রাহেলা বেগম চোখের কোনা দিয়ে দেখলো রুম্পু ঘরে ঢুকছে। এই মেয়েটার এতো বুদ্ধি হল কেন কে জানে।
“মা, এরকমটা না করলে হতোনা”?
“কি করেছি আমি”?
“কোনটার কথা শুনতে চাও মা। আজ যা হল সেটা না আজকের আগে যেটা হয়েছিলো সেটা”।
“কি বলতে চাস তুই”?
“আজকে তোমার সাথে ঘুমাই মা”?
“না”
“প্লিজ মা, আজকে একটু অন্য মেয়েদের মায়ের মতো হওনা। আমার বান্ধবিরা তাদের মায়েদের সাথে কত গল্প করে। গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যায়। আমি তো মনে হয় যখন কথাই শিখিনি তখনই শেষ তোমার সাথে ঘুমিয়েছি। আজকে তোমার সাথে একটু গল্প করবো”।
রাহেলা বেগম কোন কথা বললেন না। রুম্পু গুড়ি মেরে খাটে উঠে রাহেলা বেগমের পাশে শুয়ে পড়লো।
“মা, তোমাকে আমার ভার্সিটির গল্প বলি। আমি তখন নিতান্তই ফার্স্ট ইয়ার। আমার দুই জন বান্ধবী জুটে গেলো। আমরা তিনজন মিলে এমন কোন বাঁদরামি নাই যা করিনাই। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে আঁতেল ছিলো একটা ছেলে। বই আর ক্লাসরুমের হোয়াইট বোর্ড ছাড়া আর কোনদিকে তাঁর চোখ যেতোনা। আমরা মিলে ঠিক করলাম তাকে একটা বাম্বু দিতে হবে। তো কি করা যায়। আমরা একটা সিম কিনলাম। সিমটা থাকলো আমার কাছে। আমার দায়িত্ব হল, এই সিমটা থেকে তাকে এসএমএস করা। সেই এসএমএস এর পটভূমি হবে এরকম, একটা মেয়ে তার প্রেমিকের কাছ থেকে রিসেন্টলি ছ্যাকা খেয়েছে। ছ্যাকা খেয়ে তার ভীষণ জেদ হয়েছে। সে ঠিক করেছে আর কখনো তার প্রেমিকের চেহারা দেখবেনা এবং যোগাযোগ রাখবেনা। কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা। আবেগের কাছে পরাস্ত হয়ে ছোটখাটো এসএমএস পাঠিয়ে ফেলে। আর সেই এসএমএস গুলো এসে হাজির হয় একটা রংনাম্বারে। যেটা কিনা আমাদের প্রি প্ল্যানেড রং নাম্বার অর্থাৎ সেই ছেলেটার নাম্বার। তো প্রথম দিন আমি একটা মেসেজ পাঠালাম। মেসেজটা ছিলো এরকম।
“আজ তিনদিন হয়ে গেলো, খুব আশায় ছিলাম ভুল করে হলেও একটা ফোন পাবো। পাইনি। ভুলে গিয়েছিলাম, ভুল শব্দটা আমার সাথেই যায়। তোমার সাথে না। সরি বিরক্ত করছি। পুরোনো অভ্যাস তো। আস্তে আস্তে সেরে যাবে”।
কোন উত্তর এলোনা। আসার কথাও ছিলোনা। কিন্তু আমরা মজা পেয়ে গেলাম। ক’দিন পর আবার মেসেজ করলাম।
“বুঝিনি আমার জগতের এতোটা জুড়ে তুমি ছিলে। তুমি নেই। আমার জগতে কিছুই যেন ঠিক নেই। অথবা সবই হয়তো ঠিক আছে। সেটা বোঝার জন্য আমার মধ্যে আমিই হয়তোবা নেই”।
তারপর পাঠাতেই থাকলাম।
“খুব খুব খুব জানতে ইচ্ছে করছে......তুমি কেমন আছো”।
“১০ সংখ্যাটা দেখলে ইদানিং খুব হাসি পায়। মনে মনে কল্পনা করি তুমি ১, আমি শুন্য। এতদিন একসাথে ছিলাম এখন আলদা হয়ে গিয়েছি। আমার পাশে আর ১ নেই। আমি কেবলই শুন্য। অর্থহীন। ঠিক এই SMS তার মতো”।
বান্ধবী মহলে আমার SMS প্রতিভা সেইরকম পপুলার হয়ে গেলো। এরপর চলতেই থাকলো। কোনবারই উত্তর এলোনা। একসময় ঠিক করলাম, নাহ, এইবার ফাইনাল এট্যাক করতে হয়। আমরা বান্ধবীরা ক্লাসের পর একদিন সবাই মিলে টিএসসি তে গেলাম। ঠিক হল তাকে এবার লাস্ট মেসেজটা পাঠানো হবে। মেসেজটা হবে এই রকম।
“সরি। আর পারছিনা। ভাঙ্গা হাত পা নিয়ে হয়তো বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু ভাঙ্গা মনের বোঝা অনেক কঠিন। আমি TSC তে আছি ১ ঘন্টার জন্য। একটু আসবে। শেষবারের মতো একটু তোমাকে দেখতে চাচ্ছি। এরপরই মোবাইলটা Destroy করে ফেলবো। এক বোতল ডেটল কিনেছি। কেউ তোমার কথা জানবেনা। কেউ বুঝবেনা ভাঙ্গা মনের কতবড় বোঝা থেকে আমি মুক্ত হতে যাচ্ছি”।
মেসেজটা সেন্ড করেই আমরা বাজি ধরলাম। সবাই বললো যদিও ঐ লেভেলের হয় নাই তাও মেসেজ দেখে মগারামের ছুটে আসা উচিত। ডিপার্টমেন্ট থেকে হাঁটা পথেরই তো ডিসট্যান্স। রিকশা ভাড়াও খরচ হবেনা। কিন্তু আমি বললাম, না। আসবেনা। খাঁটি আঁতেলরা একমাত্র বইয়ের রাইটারদের জীবন-মরণ ছাড়া আর কারো জীবন মরনের তোয়াক্কা করেনা।
এক ঘন্টার মধ্যে ৪০ মিনিট পার হয়ে গেলো তার দেখা নাই। আমরা তখন যাই যাই মুডে চলে গিয়েছি। তাও মিনিট দশেক দেখলাম তারপর যখন চলে আসবো তখন দেখি আঁতেলটা মাথায় কালো কুচকুচে একটা ক্যাপ পড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ক্যাপের অনেক খানিই মুখের উপর নামানো। সহজে চেহারা দেখা যায়না। কিন্তু যতটুকু দেখা যাচ্ছিলো ততটুকুতেই বোঝা যাচ্ছিলো বেচারা জানটা হাতে নিয়ে ছুটে এসেছে। আশ্চর্য অচেনা একটা মানুষের জন্য কারো এমন টান থাকতে পারে।
আমি বাজিতে হেরে গেলাম। তারো ক’দিন পর আবিস্কার করলাম আমি একটু একটু করে নিজের কাছেও হেরে যাচ্ছি।
যা হওয়ার এরপর তাই হল। আমাদের বাঁদরামির কথা চাপা থাকলোনা। আমার SMS আর তার চোরামুখে TSC তে আগমন সবই বন্ধুমহলের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো। একটা শব্দ পরস্পরের সাথে বিনিময় না করেও আমরা হয়ে গেলাম কাপল। ল্যবের জন্য পার্টনার দরকার লোকজন আমাকে ঠেলে দেয়। তার কাছ থেকে পিকনিকের চাঁদা আদায় করা দরকার। সেই দায়িত্বও আমার উপর। একটা মজার কথা কি জানো মা, আমার না ভীষণ বিরক্ত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু খুব অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম আমার ভেতরে খুব সুক্ষ একটা ভালোলাগা কাজ করছে।
পরীক্ষার রেজাল্ট হল। ও ফার্স্ট হল আর আমি হলাম সেকেন্ড। আবহমান কালের রীতি অনুযায়ী আমরা একজন আরেকজনের বান্ধা গ্রুপ পার্টনার, ল্যাব পার্টনার, স্টাডি পার্টনার হয়ে গেলাম।
একদিন কি হল বলি, সে আমাকে বললো তোমাকে চোখে কাজল দিলে একটুও মানায় না। সে বলে শেষ করলোনা, আমি সাথে সাথে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে কাজল ধুয়ে ফেললাম। বের হয়ে এসে তার মুখোমুখি হওয়ার সাথে সাথেই বুঝলাম একটা বিশাল ভুল করে ফেলেছি। আমি এই ছেলেটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। এরপর থেকে আমি তার চোখের দিকে ঠিকমতো তাকাতে পারিনা, তার সাথে ভালোমতো কথাও বলতে পারিনা। কিন্তু সে আশে পাশে না থাকলে মনে হয়, এই বুঝি মরে গেলাম, এই বুঝি মরে গেলাম। সে বার বার আমাকে জিগ্যাস করে আমার কি হয়েছে। আমি কি বলবো, বল। ভেতরে মনে হয় একটা আগ্নেয়গিরি ধরে আছি, কিন্তু মুখে বলি কই, কিছু নাতো।
তারপর সেই বহু প্রতীক্ষিত মেসেজটা পেলাম। ল্যাব পার্টনার হিসেবে তো অনেক দিন হল। ল্যাব তো আর সারা জীবন থাকবেনা। লাইফ টাইমের পার্টনার কি হওয়া যায়।
মা, সেদিন আমার মনে হল আমি আনন্দেই মারা যাবো।
এরপরের দিনগুলো আরো ভালো কাটার কথা ছিলো। কিন্তু সেটা হলনা। আমি বাস্তবে ফিরলাম। বুঝলাম, আর এগিয়ে লাভ নেই। তোমাকে কখনই রাজি করাতে পারবোনা। আর তোমার ছেলে মেয়েরা এতোটাও স্বার্থপর না যে দুই দিনের প্রেম ভালোবাসার জন্য নিজের মাকে ভুলে যাবে।
আমি গুটিয়ে যেতে থাকলাম। কিন্তু আমি যতই সরে আসতে চাই, সে যেন ততটাই বেপরোয়া হয়ে উঠতে থাকে। আমি ল্যাব পার্টনার চেঞ্জ করলাম। ফোন নাম্বার চেঞ্জ করলাম। কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। তাকে জানতেও দিলাম না, এই শাস্তিটা আমি নিজেই নিজের জন্য বেছে নিয়েছি। আমি তোমার দেয়া সীমা লংঘন করেছি। কিন্তু তাকে থামাতে পারলাম না। জুনে ভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেলো। সে বাড়ি গেলোনা। আমার বাসা খুঁজে চলে এলো। সারাদিন আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি দেখেও দেখলাম না।
যা ভয় করেছিলাম তাই হল। তোমার চোখে পড়ে গেলো। তুমি এমন ভাব করলে একটা বখাটে তোমার মেয়েকে উত্যক্ত করছে। তুমি কিন্তু সবই জানতে, সবই টের পেয়েছিলে। জানতে, দোষটা তোমার মেয়ের, ঐ ছেলের না। কিন্তু তুমি করলে কি, চুপি চুপি গিয়ে ডিপার্টমেন্টে কমপ্লেইন করে এলে। থানায় জিডি করলে। সে এক বছরের সাসপেনশন খেলো। তারপর এমন ভাব করলে এই বখাটের উৎপাতে তোমার জীবন অতিস্ট। নিজেদের বাসা ছাড়লে। এলাকার প্রচার করে বেড়ালে। সেটা আবার এলাকার কতিপয় স্বঘোষিত রক্ষাকর্তা তথা উঠতি মাস্তানদের খুব লেগে গেলো। তাদের এলাকার মেয়েদের উপর অন্যের দখল হযম করতে পারলোনা। ফলশ্রুতিতে, খুব এক চোট ধোলাইও জুটে গেলো সেই আঁতেল ছেলেটার কপালে, এতোকিছুর পরও।
“রায়হান কোথায়রে রুম্পু”।
“মা, কথায় কথায় তোমাকে কিন্তু একটা ক্লু দিয়ে ফেলেছি। জুনে ভার্সিটি বন্ধ থাকে। এখন কিন্তু জুন মাস। আমি কিন্তু তাও পরীক্ষার নাম করে ভার্সিটি যাই। আসলে ভার্সিটির নাম করে ঢাকা মেডিকেলে যাই। ঐখানে তিনতলার এক বারান্দার কোনায় ও পড়ে ছিলো। অমন ধনী ঘরের কেউ ছিলোনাতো, লবিং করে কেবিন নিতে পারেনি। আর যাবোনা। আজ দুপুরেই সে মারা গেছে। এখন জুন মাস বাকিটা পুরো ছুটি”।
“রায়হান কোথায় রুম্পু”?
“মা, তুমি কিন্তু মনে করোনা ধোলাই খেয়ে মিস্টার আঁতেল পটল তুলেছে। তিন দিন অজ্ঞান ছিলো। গত দুইদিন কিছুটা জ্ঞান ফিরেছে। শরীরে একটু বল হতেই একটা ডেটল জোগাড় করে পেটে চালান করে দিয়েছে। খুব আঁতেল তো। ভার্সিটি থেকে এমন এক অভিযোগে সাসপেনশন খাবে, হজম করতে পারেনি”।
“রুম্পু, প্লিজ মা, হাতজোড় করি, বল রায়হান কোথায়”?
“ছিঃ মা, কি বলছো এসব। মেয়ের কাছে হাত জোর করতে আছে। ভাইয়া বাসায় নেই। শিপু আপু বের হওয়ার পর পরই ভাইয়াও বের হয়ে গিয়েছে। আর ফেরেনি। ফিরবে কিনা জানিনা। ভাইয়ারও কিন্তু একটা গল্প আছে মা। শিপুপুকে ভাইয়া প্রথম দেখে ভার্সিটিতে থাকা কালীন। তখন ভাইয়া ছোট। আপু তো আরো ছোট। আপুকে ভাইয়া তখন থেকেই খুব পছন্দ করতো। কিন্তু করে কি লাভ। আমাদের অবস্থা তখন খারাপ। বাবা মারা গেলেন। আমাদের নিয়ে তুমি অথৈ সাগরে। ভাইয়া শিপুপুর কথা ভুলে গেলো। আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ভাইয়া কাউকে বলেনি শিপুপুকেও না। কিন্তু আমি জানতাম ভাইয়া আপুকে কি পছন্দটাই না করতো। কিন্তু কপালের কি খেল দেখো মা। বাসা খুঁজতে খুঁজতে শিপুপুর সাথে আবারো দেখা। মাঝখানে কিছু বছর পেরিয়েছে। আপুর লাইফেও একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। কিন্তু ভাইয়ার ভালোবাসায় কোন কিছুতেই চিড় ধরাতে পারলোনা। সম্ভবত বিধাতারই ইচ্ছা এই দুইজন দুইজনেরই থাকুক। আমি বিধাতার কাজে একটু হাত লাগালাম। তোমাকে কিছু বললাম না। শিপুপুদের বাসার নিচেই বাসা নিলাম।
ভাইয়ার ব্যপারে তুমি ঠিক ছিলে মা। ভাইয়া খুব নরম প্রজাতির মানুষ। ঠিক ঐ আঁতেলটার মতো। এদের মন থাকে ভাসমান প্রজাতির। একবার যে খুঁটিতে আটকে যায় সেখান থেকে আর বের হতে পারেনা। শিপু আপু কিন্তু খুব শক্ত মেয়ে মা। দেখলে, এতো বড় একটা ঘটনার পরেও কিরকম শক্ত হয়ে ছিলো। ঠিক তোমার মতো। ভাইয়ার জন্য একদম পারফেক্ট। আমিও যদি একটু শক্ত হতে পারতাম না। একটু যদি সাহস করে বলতে পারতাম, সব মিথ্যা। সব মিথ্যা। আমি পারিনি কিন্তু শিপুপু পেরেছে। মা, যে চলে গেছে সে তো আর আসবেনা। যে আছে তাকে বাঁচাই চলো”।
“তোরা আমাকে এতো ঘৃণা করিস? এতো ঘৃনা করিস! অথচ এই আমি বেঁচে আছি শুধু তোদের মুখ চেয়ে। শুধু তোদের জন্য। যা করছি সব তোদের জন্য। বাড়ির দেয়ালগুলো আমার কাছে রক্তচোষার মতো লাগতো তারপরও সেগুলোকে কামড়ে ধরেই তোদের এতো দূর এনেছি। আজ আমি তোদের চোখে নিজেই রক্তচোষা। চুষে চুষে তোদের সব ভালোবাসা খেয়ে দিচ্ছি। এইটাই তো বলছিস”।
“এটা বলছিনা মা। আমি বলছি যেই মানুষটাকে তুমি ঘৃনা করে আসছো। ধীরে ধীরে তুমি নিজেই ঐ মানুষটা হয়ে যাচ্ছো। বাবাকে তুমি ঘৃণা করো। তুমি কি টের পাচ্ছো মা, আস্তে আস্তে তুমি নিজেও একজন বাবা হয়ে যাচ্ছো”।
রাহেলা বেগম এবার মেয়ের দিকে ঘুরে তাকালেন। আশ্চর্য রুম্পুর চোখ টলটল করছে। তিনি মনে করতে পারলেন না শেষ কবে মেয়ের এমন টলটলে চোখ দেখেছিলেন। কি অদ্ভুত তার মেয়ের চোখের পানিও কি তার মতো শুকিয়ে যাচ্ছে। তার নিজের গলাও হঠাৎ তার মেয়ের চোখের মতোই ভিজে এলো।
“জানিস, তোর নানা ছিলেন তোদের মতোই। বোকা। মানুষের উপর অগাধ বিশ্বাস। এক ঝড় বৃষ্টির দিনে তোর বাবা তাকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। ব্যাস কাজ হয়ে গেলো। ছেলে ছিলো নাতো। মোটামুটি একটা চাকরি করতো তোর বাবা। মেসে থাকতো। তোর নানা বললেন, আমার এতো বড় ঘর কি করতে। ঘরে এনে তুললেন। দুই দিন পর একমাত্র মেয়েটাকেও তুলে দিলেন। ভাবলেন, হাতের কাছে তার একমাত্র মেয়ে থাকবে, খারাপ কি। আর আমি তো খুশিতে বাক বাকুম। মনে হচ্ছিলো সবকিছু স্বপ্ন। স্বপ্নও তো এতো সুন্দর হয়না। আসলে স্বপ্নই দেখসিলাম। বিয়ের মাস কয়েক যেতেই তোর বাবা দেশের বাড়ি যাবার নাম করে চলে গেলেন। আর আসার নাম গন্ধ নাই। এদিকে তোর নানা অসুস্থ। চিঠির পর চিঠি পাঠাই। কোন খোঁজ নাই। শহরের যতজনকে চিনতাম সবার কাছেই ধন্যা দিলাম। কেউ বলতে পারেনা। কি অদ্ভুত হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো নাকি। একদিন সাহস করে চলে গেলাম অফিসে। ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম ঠিকানা নাকি ভুল। এর মধ্যে একজনের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তোর বাবার নাকি খুব ঘনিষ্ট। আমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বললো, “আরে আপনি দেখি দিব্যি সুস্থ। ভাই যে বলে গেলো আপনার নাকি শরীর ভালোনা”। জানিনা কেন বুকটা ধক করে উঠলো। আমি কথা বাড়ালাম না। ঠিক ঠিকানা বের করে একলাই রওনা দিলাম। তখনো জানতাম না তুই আমার পেটে। তার বাড়ি গিয়ে আমি পুরো অবাক। আমাকে দেখে চারদিকে কানা ঘুষা পড়ে গেলো। এক কোনায় দেখি তোর বাবা দাঁড়িয়ে আছে। কাচুমাচু মুখ। যেন জানতো আমি একদিন ঠিক এইভাবে এসে হাজির হবো। আমাকে দেখে এগিয়েও আসলোনা। এতকাল যে ডুব দিয়ে ছিল একটা কৈফিয়তও দিলোনা। দূর থেকে কে জানি চেঁচিয়ে বলল, “পরের পক্ষের বউ দেখি এক্করে বাড়িত আইয়া বইসে”
আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। কে যেন টেনে একটা ঘরে নিয়ে গেলো। জরাশীর্ন ঘর। আর বিছানায় যে মহিলা পড়ে আছে সে যেন আরো জরাশীর্ন। সে আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলো। আমি গেলাম। সে আমার হাত ধরলো। আমি পাশে বসলাম। সে টেনে টেনে বললো, “উনারে মাফ কইরা দিও বৌ। পুরুষ মানুষ, সামলাইতে পারেনাই। আর আমি তো যাওনের রাস্তাই ধরছি। বুঝিরে বইন। তোমার বুকের ভিতরে যেমন উথাল পাথাল করতাছে। আমারো করতাছে। কিন্তু আমার সময় নাই। দুধের একটা পোলা রাইখ্যা যাইতেছি। পারলে একটু দেইখো। মনে মনে হয়তো গাইল পাড়তেসো। কিন্তু মা হইলে বুঝবা, পোলাপানের লাগি আত্মা যেমন কান্দে তেমনে পাষাণও হইতে পারে”। মহিলা আর কিছু বলতে পারলোনা। শ্বাসে টান দিলো। ঐদিন রাতেই মারা গেলেন। দুইদিন থেকে আমিও চলে আসলাম। তারও কয়দিন পর তোর নানা মারা গেলেন। আল্লাহর রহমত ছিলো উনার উপর। তিনি জানলেনও না তার মেয়েকে কি তুফানের ভেতর ফেলে গেলেন”।
“একটা অংশ বলোনাই মা”
“কোনটা”
“ঐ যে ঐ ছোট ছেলেটা। তুমি তো একলা আসোনি। সাথে করে ছেলেটাকেও নিয়ে আসছো। পেলে পিঠে মানুষ করেছো। আমাকেও এতো আদর করনাই যতটা তাকে করেছো। এক সন্তানের জন্য না হয় পাষাণ হলে আরেক সন্তানের জন্যে না হয় মমতাময়ী হও”।
“মানুষের দ্বিতীয় সংসার কখনো সুখের হয়নারে মা”।
“ভাইয়ার আম্মুর সংসার তো প্রথম ছিলো। কই তারটাও তো সুখের হলোনা। শিপু আপু খুব ভালো মেয়ে মা। শিপু আপুর হয়তো ভাইয়াকে দরকার নাই। ভাইয়ার জন্যই শিপু আপু কে দরকার”।
“চল রায়হানকে খুঁজে আনি”।
“ভাইয়াকে খোঁজা লাগবেনা মা। কান টানলে মাথা এমনিই আসে। শিপুপুদের বাসায় যাও। শুক্রবার বিয়ের ডেটটা পাকা করে আসো। ভাইয়া এমনিতেই চলে আসবে”।
রাহেলা বেগম কিছু বললেন না। চোখ দুইটা আস্তে করে বন্ধ করলেন। দুই চোখের পাশ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তিনি কতদিন পর কাঁদছেন, নিজেও জানেন না।
“রুম্পু, কিছু কিছু মাটি হাজার বার পোড়ালেও ইট হতে পারেনা। তাইনা”।
“না, মা পারেনা। কিছু কিছু মাটি, মাটি হিসেবেই ভালো”।
আজ রুম্পুদের বড় আনন্দের দিন। কিছুক্ষণ আগেই শিপুর সাথে রায়হানের আকদ হয়ে গেলো। রাহেলা বেগম ভীষণ ব্যস্ত। কথা বলার ফুসরত নেই। শিপুর মা কিছুক্ষণ পর পরই হেঁচকি দিয়ে কেঁদে উঠছেন। সবচেয়ে মজায় আছে লাবনি। কোন কারণ ছাড়াই সে এঘর ওঘর করে বেড়াচ্ছে। রুম্পুরও অনেক কাজ কিন্তু করতে ইচ্ছে করছেনা। সে বসে আছে বারান্দার ধারে। সামনের বাড়ির ছাদটা ঘিরে একদল কবুতর চক্কর মারছে। তাদের আগের বাসাটায়ও অনেক কবুতর ছিলো। বাবার পোষা। বিকেল হলে তাদের বাক বাকুম শব্দে টেকা যেতোনা। রুম্পুর সবসময় মনে হতো কবুতরগুলোর বাক বাকুম আসলে এক ধরণের কোড। এই কোড দিয়ে তারা বলে বেড়াচ্ছে ভালোবাসি, ভালোবাসি। পৃথিবীর বোকা মানুষগুলো ধরতে পারেনা। রুম্পুর মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একদিনের জন্যে কবুতর হয়ে যেতে। তারাপর সারাদিন ধরে কোড করে বলবে ভালোবাসি ভালোভাসি। কেউ বুঝবেনা শুধু একজন বুঝবে। মেঘের ওপারে একজন। যাকে মুখোমুখি বলার সাহস তার কোনদিন হয়নি।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:২৪