somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেঘের ওপারে একজন

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাহেলা বেগমের মেজাজ খারাপ। ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ। পরিচিত মহলে উনি খুব কঠিন মহিলা হিসেবে পরচিত। সোজা বাংলায় দজ্জাল। খুট করে কিছু একটা মাথায় এসে গেলো আর হুট করে সেটা করে ফেললেন, এই রকম স্বভাব তার একদমই না। কিন্তু তারপরেও এই বিশাল ব্যপারটা কিভাবে তার চোখ এড়িয়ে গেলো তিনি ধরতে পারছেন না। কিছু একটা ঝামেলা নিশ্চয়ই আছে। রাহেলা বেগম গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার বয়সী লোকজনের মতো তার হার্টের ব্যমো, মাথার ব্যমো কিছুই নেই। দিব্যি সুস্থ মানুষ। কিন্তু টেনশন হলে তার বাম পা কাঁপতে থাকে। তিনি তখন তার কম্পিত পাকে বশে আনার জন্য দ্রুতগতিতে এ ঘর ও ঘর পায়চারী করতে থাকেন। নতুন বাসা নেয়ার সময় তার এই পা কাঁপাকাপির বিষয়টাকেও মাথায় রাখা হয়েছে। এই কারণেই বাসাটা তাদের তিনজনের পরিবারের তুলনায় একটু বেশীই বড়।

রাহেলা বেগম ঠিক করলেন তিনি পায়চারী করা শুরু করবেন। অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হল সৈন্য সামন্তের মতো। বশে না রাখলে বিদ্রোহ করবে। হাঁটতে হাঁটতে তিনি রুম্পুর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালেন। তারপর পর্দা সরিয়ে একটু উঁকি দিলেন। এই মুহুর্তে কেউ তাকে দেখলে এই বাড়ির গৃহকর্তী মনে না করে পাশের বাসার অতি উৎসুক প্রতিবেশী মনে করার সম্ভাবনাই বেশী। রুম্পু একমনে পড়ছে। রাহেলা বেগমের এই মেয়েটা বড় পড়াকু হয়েছে। বই ছাড়া কিছু বুঝেনা। কলেজের রেজাল্টও খুবই ভালো। এই যুগে যদি স্ট্যান্ড ফ্যান্ড করার সুযোগ থাকতো। এই মেয়ে একটা না একটা মেরিট পসিজন বাগাতোই। রাহেলা বেগম মেয়ের ঘরে ঢুকলেন।

“এই রুম্পু শুনেছিস উপর তলার বাসার কাণ্ড”।
“না”
“উপর তলার মহিলা দিব্যি তার দুই মেয়ে নিয়ে সংসার করে যাচ্ছে। তার মধ্যে এক মেয়ে আবার বিধবা। ঘরে কোন পুরুষমানুষ নাই। দেখেছিস কি কাণ্ড”।
“এখানে কাণ্ডের কি হল”।
“ঘরে যে তুই ছাড়াও তোর একটা বড় ভাই থাকে, সেটা মাথায় আছে”।
“মা, তোমার সবসময় কেন মনে হয় আশে পাশে অল্প বয়সী মেয়ে থাকলেই ভাইয়া তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকবে। অথবা আসে পাশে লায়েক কোন ছেলে থাকলেই আমি প্রেম পত্র পাওয়া আরম্ভ করবো। ঘর গুছানোর নাম করে তো হাজার বার আমাদের বই পত্র, টেবিল, বিছানা সব তল্লাশী করো। আজ পর্যন্ত পেয়েছ কিছু। শোন, তোমাকে একটা ক্লু দেই। যুগ অনেক এগিয়ে গিয়েছে। প্রেম পত্র ফত্র মার্কেট আউট। সময় করে তোমাকে একদিন কিভাবে মোবাইলে আর পিসিতে ইন্টারনেট চালাতে হয় শিখিয়ে দেবো। চোর এগিয়ে যাবে পুলিশ পিছিয়ে থাকবে এটাতো হতে পারেনা”।

রাহেলা বেগমের মেজাজ সপ্তমে উঠে গেলো। এই মেয়েটার মুখ মেশিন গানের মতো চলে। তিনি যথেষ্ট বিরক্ত কন্ঠে বললেন, “নিজেকে এতো বেশী চালাক মনে করিস না। সত্যিকারের চালাকেরা নিজেকে কখনো জাহির করেনা”।
“মা, আমি যতটা চালাক তার থেকে অনেক কম চালাকি মানুষকে দেখতে দেই। তুমি তো মা কম, পুলিশ বেশী হয়ে যাচ্ছ এর জন্যেই বুঝতে পারোনা তোমার ছেলেমেয়েরা কতবড় ঘাঘু চালাক”।
“একটা নমুনা দেখা দেখি তোরা কতবড় ঘাঘু চালাক”।
“তুমি যেই মেয়েটার কথা শুনে সকাল থেকে ঘরে জগিং করে বেড়াচ্ছো, ঐ মেয়েটার নাম শিপু। শিপুপু। ভাইয়া আগেই জানতো উনাদের কথা। তোমাকে বলতে বলেছিলো। কিন্তু আমি তোমাকে কিছু বলিনি। ভাইয়াকেও কিছু বলিনি। তাই ভাইয়া ধরেই নিয়েছে সিগনাল পজিটিভ। তোমার কোন সমস্যা নাই। সো এডভান্স দিয়ে বাসা ফাইনাল করে ফেলেছে। এবার বল, বুদ্ধি না থাকলে এতবড় পেচকি লাগাতে পারতাম”।
রাহেলা বেগম দাঁতে দাত চেপে বললেন, “আমাকে বলিসনি কেন তুই”।
“গত একমাসে আমরা ২০ টা বাসা দেখেছি। বুঝতে পারছো ৩০ দিনে মাস ধরলে প্রতিদিন গড়ে ০.৬৭ টা বাসা পরে। কিন্তু সবই তোমার কাছে রিজেক্ট খেতে লাগলো। কোন বাসা রাস্তার অনেক ভেতরে, আগুন লাগলে ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ি ঢুকতে পারবেনা। কোন বাড়িওয়ালার তিনটা ধাড়ি আইবুড়ো মেয়ে। কোথাও আবার উঠতি মাস্তানের সংখ্যা বেশী। তাই বাধ্য হয়ে এই সুক্ষ কারচুপি করতে হল। আমি ডিসক্লেইমার দিচ্ছি, আমি সুস্থ মস্তিস্কে, কারো প্ররোচনা ছাড়াই এই কুকর্ম ঘটিয়েছি। ভাইয়ার এতে কোন হাত নেই। ভাইয়া বড়ই মা ন্যাওটা”।
“রুম্পু, তুই উঠ। রাতে মাংসের কোপ্তা বানানো হবে। মাংস কসাতে দে। আর ফ্রিজের মাংস না খোলা পর্যন্ত তুই মাংসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি”।
“মা, কাল মিডটার্ম আছে। আর এমনিতেও দুপুরের তরকারি অনেক খানি রয়ে গিয়েছে। রাতে না রাঁধলেও চলবে।
“তোকে যা করতে বলছি সেটা কর”।
রুম্পু চেয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো এবং কিছুক্ষণ পরেই আবার ফিরে এলো। “মা ফ্রিজে মাংস নাই। শেষ হয়ে গিয়েছে। কাল ভাইয়াকে দিয়ে আনিয়ে নিও”।
বলেই বই নিয়ে খাটে শুয়ে পরলো। শুয়ে শুয়ে না পড়লে তার নাকি পড়া মুখস্থ হয়না।


ঠিক সেই মুহুর্তে রায়হান ছিলো বাড়ির নিচের সিড়িঘরটায়। তার বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছিলো। সিঁড়ির লাইট নষ্ট আজ তিনদিন। আধুনিক ছেলেদের মতো সে ভূতে বিশ্বাস করেনা কিন্তু অন্ধকার দেখলেই বুকের ভেতরটা ধরফর করতে থাকে। তবে আজকের বুক ধড়ফড় করার কারণ শুধু অন্ধকার না। শিপুর সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে এমন সব জায়গাতেই তার বুকের ভেতরটা কেমন কেমন যেন করতে থাকে। বুকের ভেতর কেমন কেমন লাগাটা কমানো দরকার। আর এর জন্য মাথাটাকে অন্যদিকে খাটানো দরকার। এদিক ওদিক মাথা ঘুড়িয়ে রায়হান দেখতে পেলো গেটের দারোয়ানকে। দাড়োয়ান ঝাড়ুর শলা দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিল। সে তাকে জিগ্যেস করলো, “মামা, সিঁড়ির লাইট ক’দিন থেকেই দেখছি নষ্ট। ঠিক করেনা কেন”?

দারোয়ান তার মুল্যবান দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতেই বললো,“আমি গেটের বাইরে ডিউটি করি। গেটের ভেতরের খবর রাখন আমার কাম না। আর আমারে মামা কইবেন না। আমার দাঁড়ি পাকতে পারে কিন্তু বয়স বেশী বাড়ে নাই”।

রায়হানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এই দাড়োয়ান তাকে একেবারেই দেখতে পারেনা। কেন, কে জানে। সে সিঁড়ি দিয়ে ভালোয় ভালোয় উঠে যাচ্ছিলো তখনই ঘটলো ঘটনাটা।

“চাচা, আপনি সিঁড়ির লাইটটা ঠিক করেন না কেন। কেউ যদি এই অন্ধকারে আছাড় খেয়ে পড়ে প্রথম ধাক্কা তো আপনার উপর দিয়েই যাবে। গেট সামলাবেন না মানুষ সামলাবেন”।

গলাটা নিঃসন্দেহে শিপুর। রায়হান তার জায়গায় আটকে গেলো, নড়তে পারলোনা। অনড় অবস্থাতেই শুনলো অল্পবয়সী দাড়োয়ান বলছে, “মারে। তিন বার বাত্তি লাগাইছি। সুইচ টিপলেই ফিউজ হইয়া যায়। ইলেকট্রিশিয়ানের কাম। বয়স হইসে কারেন্টের কাম করনের সাহস পাইনা আর”। রায়হান মনে মনে বললো ধরণী দ্বিধা হও।

“কাল সক্কাল সক্কাল ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে আনবেন। অন্ধকার দিয়ে দিনের প্রথম যাত্রা শুরু হওয়া ঠিক না”। বলেই শিপু তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে উঠা শুরু করলো এবং মিনিট খানেকের ভেতরেই একেবারে রায়হানের ঘাড়ের উপর এসে পড়লো। রায়হানের বুক এতক্ষণ ঢিপ ঢিপ করছিলো। এইবার পুরো ঢক ঢক করা শুরু করলো।

“আপনি এইখানে ছিলেন? আমি আপনাকে দেখতেই পাইনি। ব্যাথা পান নি তো আপনি”?
রায়হান যেই উত্তর করতে যাবে নিচ থেকে দাড়োয়ান তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো, “আপনি এখনো যান নাই। দাঁড়ায় আছেন ক্যান”।
“অন্ধকারে যাবো কিভাবে। দেখে দেখে পা ফেলতে হচ্ছে”।
“পুরুষ মাইনশের রাস্তায় চলতে বাত্তি লাগে নাকি”।
পুরুষ মানুষের অনেক কিছুই লাগেনা এইটা রায়হানের জানা ছিলো। কিন্তু রাস্তায় চলতে যে বাতিও লাগেনা আজ প্রথম শুনলো। তার সাথে এই লোকটার এতো শত্রুতা কেন। শত্রুতা হয়তো আরো বেশ কিছুদূর এগুতো কিন্তু শিপু মাঝখানে পড়ে গেলো।

“বাদ দেন তো চাচা। ভাই আপনি একটু মোবাইলের লাইটটা ধরবেন। আমারটায় একদমই চার্জ নাই। আমি তো সোজা রাস্তাতেই আছাড় খাই। এখানে তো কথাই নেই”।

রায়হান বাধ্য ছেলের মতো মোবাইল বের করে লাইট ধরলো। তার মনে হল এই সিঁড়িঘরের বাতি যেন কখনই ঠিক না হয়। কখনই না। সিঁড়ির গাঢ় অন্ধকারের ভেতর এই দুই নর নারী এইটাও খেয়াল করলোনা, উপর তলা থেকে রাহেলা বেগম খুব মনোযোগের সাথে এইদিকেই তাকিয়ে আছেন।

(২)

রাহেলা বেগম খুব তীক্ষ্ণ চোখে রায়হানকে দেখছিলেন। ছেলেকে নাকি সামনে বসিয়ে খাওয়ানোর মধ্যে একটা আরাম আছে। কিন্তু এই আরামটা তিনি পান না। ছেলেটা সবসময় খাবার সময়ে মাথা নিচু করে থাকে। কেন থাকে? বাথরুম লুকিয়ে করার কাজ, খানা-পিনা কি লুকিয়ে করার কাজ? রাহেলা বেগম কি বিয়ে বাড়ির ক্যামেরা, যে খাওয়ার সময় সব রেকর্ড করে রাখবে। তিনি সামনে বসে থাকলেই এই ছেলে এমন করে। অন্য কারো সামনে দিব্যি ভালো। তার সাথেই এতো লুকো ছাপা কেন। তিনি ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকেন।

“মা,রুম্পু খেয়েছে “?
“না”
“কেন”
“কাল পরীক্ষা”
“পরীক্ষার আগের দিন কি খাওয়া মানা। ও কি খালি পেটে হাসপাতালে গিয়ে গ্লুকোজের পরীক্ষা দিবে”?
“খালি পেটে নাকি পড়া বেশী মনে থাকে”।
“তুমি কিছু বললেনা”।
“কি বলবো, ছোট বাচ্চা নাকি যে ফিডার বানিয়ে মুখে তুলে দিবো”।

রায়হান আর কিছু বললোনা, আবারো মুখ নামিয়ে খাওয়া শুরু করলো।

“আমার উপর তোদের অনেক রাগ তাইনা”। বলেই রাহেলা বেগম আবারো তীক্ষ্ণ চোখে রায়হানের দিকে তাকালেন। ছেলেটা এখন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলবেনা। চিন্তা ভাবনা শেষ হলে উত্তর দিবে। মায়ের সাথেও এতো চিন্তা করে কথা বলতে হয়?

“তোমার কেন মনে হচ্ছে মা, আমরা তোমার উপর রেগে আছি”।
“তোদের বাবা বেঁচে থাকতে তো বেশী যত্ন আত্তি করিনি। মরে যেতেই নিজের বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠলাম”।
“তোমার ওখানে অসুবিধা হচ্ছিলো তাই চলে এসেছো। বাড়িটা তো তাতে অন্যের হয়ে যায়নি। আমাদেরই আছে”।
“অসুবিধে আমার না। রুম্পুর হচ্ছিলো। দেখিসনি তুই। ওই বখাটে ছেলেটা কি উৎপাত শুরু করেছিলো। সহ্য করা যায় এসব”?
“মা, দাঁতে ব্যাথা হলে আমরা ডাক্তারের কাছে যাই ব্যাথা কমানোর জন্য। হাতুড়ী দিয়ে দাঁত ভেঙে দেইনা”।
“কি বলতে চাস তুই”।

রায়হান আর কোন কথা বললোনা। চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলো। রাহেলা বেগম ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলে মেয়েরা যত দ্রুত বড় হতে থাকে বাবা মায়েরা কেন যেন তত দ্রুত বুড়ো হতে পারেনা। ছেলেমেয়েদের ছোটবেলার মুখগুলো মাত্র ক্যামেরায় তোলা ছবির মতো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করতে থাকে। কিন্তু বেচারা ক্যামেরা শুধু স্মৃতি বন্দি করে, সময় নয়। বড় হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েগুলো তাই সেই ছোট ছোট মুখগুলোর চেয়ে কতটাই না আলাদা। কিন্তু রাহেলা বেগম আর দশটা গড়পড়তা মায়েদের মতো নন। তিনি খুঁটির মতো শক্ত হয়ে এই সংসারটাকে আগলে রেখেছেন। এখনো রাখছেন। ভবিষ্যতেও রাখবেন। তিনি এবার তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, “রায়হান, রায়হান”।

রায়হান হুড়মুড়িয়ে ছুটে এলো। রাহেলা বেগম জানতেন, ছেলেটা এইভাবেই ছুটে আসবে। এই ছেলের অল্পতেই নার্ভাস হয়ে যাওয়ার রোগ আছে। টেনশন নিতে পারেনা। রায়হান সামনে এসে দাঁড়াতেই রাহেলা বেগম আর অপেক্ষা করলেন না।

“আমি ঠিক করেছি তোর জন্য মেয়ে দেখা শুরু করবো। কাল থেকেই অভিযান শুরু। চাকরি বাকরি হয়ে গিয়েছে। এবার ফরয কাজটাও হয়ে যাবে। এখন ঘুমাতে যা”।

রায়হান নড়লোনা। হা করে একই জায়গায় রইলো। রাহেলা বেগম উঠে চলে এলেন। মাটি নরম থাকতেই তাকে আদলে আনতে হয় তারপর ফার্নেসের আগুনে পোড়াতে হয়। তবেই একটা মাটির ঢেলা শক্ত ইট হতে পারে । তার এই ছেলেটা বড়ই নরম। দুনিয়ায় নরম মানুষের জায়গা নেই। দুনিয়াটা ইটের মতো শক্ত মানুষের বাসস্থান। তারা ইটের ঘরে থাকে তারপর নিজেই একটা ইট হয়ে যায়।

পরদিন দুপুরে রুম্পু খুব শান্ত ভঙ্গিতে রাহেলা বেগমের ঘরে ঢুকল। ঢুকেই বললো “মা, এক মহিলা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিগ্যেস করলাম কে, উত্তর দিলো ঘটক আপা। তবে সে কার আপা সেটা বুঝিনাই। আমার না তোমার”।
“তুই তাকে দরজার বাহিরে দাড় করিয়ে চলে এলি। ঘরে বসতে বলবিনা”?
“আইডেন্টিটি কনফার্ম না করে কিভাবে ঢুকতে দেই। ঘটক আপারা তো প্রতিদিন আমাদের বাসায় ঘুরতে আসেনা”।
“ফিচলামি মার্কা কথা বলবিনা। খবরদার”।
“ঐদিন মাংসের কোপ্তা বানাইনি দেখে তুমি কি ঠিক করেছো বিয়ে দিয়ে আমার পুরা লাইফটা কোপ্তা বানিয়ে দিবে”।
“তোর লাইফ তুই নিজেই কোপ্তা বানাবি। কাউকে বানিয়ে দিতে হবেনা। আপাতত তোর ভাইয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ওই মহিলাকে ভেতরে এনে বসা। চা আর দুইটা টোস্ট এনে দিস। বেশি কিছু দিতে যাসনা”।
“মা, শুধু শুধু চা আর দুইটা টোস্ট পানিতে ফেলছো। ভাইয়া এই ঘটক আপার আনা কোন মেয়েকেই বিয়ে করবেনা। ভাইয়া আগে থেকেই মেয়ে ঠিক করে রেখেছে”।

রাহেলা বেগম এবার পুর্ন দৃষ্টিতে রুম্পুর দিকে তাকালেন। এই মেয়েটা পুরোই তার গড়ন পেয়েছে। শুধু গড়ন নয়, ধরণ, ধারন, চাল-চলন সবকিছুই তার কাছ থেকেই পাওয়া। কে জানে হয়তো কপালটাও পাবে। অল্প বয়সেই কস্ট পাবে তারপর সারাজীবন সেই কষ্ট পুষে বুড়ো হবে। উনি যেমন হয়েছেন। ইতিহাসের একটা মজার খেলা আছে। সে নানাভাবে বর্তমানের মধ্যে ঠাই করে নিতে চায়। নিজেকে খুব বেশী পুরোনো হতে দিতে চায়না। রাহেলা বেগম এবার গলা চড়ালেন, “তুই কি বললি আবার বল?”

“ভাইয়া মেয়ে আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছে”।
“কে সেই মেয়ে”?
“যার কথা মনে করে তুমি দিনে দুবার জগিং করে বেড়াও”।
“ঐ বিধবা মেয়েটা”।
“মা, তুমি নিজেও তো বিধবা। আরেকটা মেয়েকে এইভাবে বলা কি তোমার ঠিক হচ্ছে”।
“রুম্পু তুই এক্ষন আমার চোখের সামনে থেকে বের হয়ে যা। যাওয়ার সময় ওই ঘটক গাধীটাকেও বের করে দিবি। তোদের সাথে ফায়সালা করার টাইম হয়ে গিয়েছে”।

রুম্পু ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই রাহেলা বেগম রায়হান কে ফোন লাগালেন। বেলা দুইটার মতো বাজে। খাওয়া দাওয়ার সময়। ভরপেটের কথা বার্তা সাধারণত আউলা ঝাউলা হয়না। রায়হান ফোন ধরেছে।

“তোর জন্য মেয়ে ঠিক করে ফেলেছি। ঘটক এসছিলো। মেয়ের বাবা বাইরে থাকেন। অল্প দিনের ছুটি নিয়ে দেশে এসছেন। শুক্রবারেই চাচ্ছেন আকদ করে ফেলতে। বাসায় আসার সময় কিছু টাকা তুলে আনিস। আমি আর রুম্পু মিলে কাল দেখি কিছু কেনাকাটা করে ফেলবো”।
“মা, এতো তাড়াতাড়ি মেয়ে ঠিক করে ফেললে”।
“মেয়ে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। আজ ঘটক মারফত কথা পাকাপাকি করে ফেললাম”।
“কিন্তু শুক্রবারে আমার প্রজেক্ট ভিসিটে যেতে হবে, ঢাকার বাহিরে”।
“আগে তো বলিসনি”।

ফোনের ওপাশে বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা। তারপর রায়হানের কম্পমান গলা শোনা গেলো, “কিছুক্ষণ আগেই ডিসিশন হয়েছে মা। ফাইলটা আমিই হ্যান্ডেল করছিলাম, আমাকেই যেতে হবে”।

রাহেলা বেগম ফোন নামিয়ে রাখলেন। রুম্পু ঠিক কথাই বলছিলো। তিনি মনে মনে কিছু হিসাব কষে নিলেন। এই ধরণের হিসেবগুলো করার সময় তার খুব কষ্ট হয় কিন্তু কিছু করার নেই। তার ছেলে মেয়েদের ভালোর জন্য তিনি সব কিছুই করতে পারেন।

শিপু স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তাঁর মা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। ঘরের মধ্যে একমাত্র স্বাভাবিক মানুষ বলতে আছে লাবনি। পুরো ব্যপারটার তাৎপর্য বুঝার বয়স তার এখনো হয়নি। দরজাটা খোলা। উঠে লাগাতেও ইচ্ছে করছেনা। ওই পথেই কিছুক্ষণ আগে বাড়িওয়ালা গেলেন। যাওয়ার আগে অল্প কিছু কথায় মুল কথাটা জানিয়ে দিয়ে গেলেন। এক মাসের মাথায় এই বাসাটা তাদের ছেড়ে দিতে হবে। উনি বাড়িওয়ালা ক্লাব সমিতির সভাপতি আর তার বাড়িতেই এইসব অসামাজিক কাজ কর্ম চলবে তিনি সেটা বরদাশত করবেন না। নিচের ফ্ল্যাট থেকে কমপ্লেইন এসছে। রাত বিরেতে নাকি শিপুদের বাসায় বাইরের লোক আসে। দারোয়ান তো আগে থেকেই ম্যানেজড। খোদ বাড়ির মালিকের কথা না শুনলেও এই বাড়ির মেয়েদের খাতিরের অভাব হয়না। বাড়িওয়ালা নিজে দেখেছেন শিপুকে মোবাইলের লাইট দিয়ে সিঁড়ি পার করে দিতে। নিচের বাসার ছেলেকেও নাকি কুপ্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ তো সরাসরি এলাকার মান সম্মানের উপর বিশাল চটোপাঘাত।

শিপুর মা একবার বলার চেষ্টা করেছিলেন এতোদিন ধরে এই বাড়িতে ভাড়া আছেন অথচ সেদিনকার এক মহিলার কথায় তাদের এতবড় অসম্মান তিনি কিভাবে করছেন। কিন্তু সভাপতির এক কথা। বাড়িওয়ালা মাত্রই ভাড়াটিয়ার চেহারা দেখে চরিত্র বুঝতে পারে। নিচের বাসার মহিলা নিজেও বাড়িওয়ালা। সমিতির বিশিষ্ট মেম্বার। ভুল তো তিনি করতেই পারেন না।

কথা বার্তার পুরোটা সময় শিপু একদম চুপচাপ ছিলো। একটা শব্দও করেনি। পুরো ব্যপারটায় ধাতস্ত হতে একটু সময় লেগেছে। কিন্তু এখন মাথা পরিস্কার। বাড়ি এক মাস কেন, চাইলে কালই ছেড়ে দিবে কিন্তু তার আগে ছোট্ট একটা কাজ করে যেতে হবে। শিপু দরজা খোলা রেখেই নিচে নেমে গেলো। তিন তলার ফ্ল্যাটে নক করলো। দরজা খুললো রুম্পু।

“রুম্পু, তোর ভাইকে আসতে বল তো”।

“বলছি, তুমি ভিতরে এসে বস”। বলেই রুম্পু ভাইয়া ভাইয়া করে চেঁচাতে লাগলো। শিপু হেসে ফেললো। ভালো মানুষগুলো আয়নার মতো হয়। এদের উপর অন্য কারো রাগ, ক্ষোভ, গালি গালাজ এসে পড়লে প্রতিফলত হয়ে ফেরত চলে যায় কিন্তু অন্যপাশের জগতটা কতটা তোলপাড় হয়ে গেলো সেটার হদিশ পাওয়া যায়না। শিপু দেখলো রায়হান বসার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রায়হানের পেছন পেছন এসছেন তার মা। তিনি অবশ্য এমন ভাব করলেন যেন শিপুকে দেখতে পান নি। টেবিল থেকে পানি নিতে এসেছেন।

শিপু সোফা থেকে উঠে একদম রায়হানের সামনা সামনি দাঁড়ালো। তারপর প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিলো তাঁর গালে। খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, “চড়টা আসলে আপনার বিবেককে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কি করবো বিবেকের তো হাত, পা, নাক মুখ থাকেনা, তাই আপনাকেই খেতে হল। আল্লাহ, মেয়ে মানুষকে হাতে জোর কমই দিয়েছেন। তাই বলে ভাববেন না, মনের জোরে কিছুমাত্র অভাব আছে। আমি পোড় খাওয়া মানুষ। পোড় খাওয়া চামড়া এমনিতেই শক্ত হয় আর আমি তো আস্ত মানুষ”। বলেই শিপু গটগট করে বের হয়ে গেলো। যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে দেখলো রাহেলা বেগম খুব অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শেষমেশ তিনি শিপুকে দেখতে পেলেন।

শেষ পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:৩৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×