সুবীরের একটা আজিব ব্যামো হয়েছে। ইদানীং অফিস শেষ করে ভদ্র মানুষের মতো ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করেনা। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে এবং ঘুরেও বেড়ায়। আজকে যেমন এসেছে নীলখেতের মোড়ে। উদ্দেশ্য বই টই কিছুনা, এমনিই ঘুরাঘুরি। তারপরও সে অনেকক্ষণ একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। বই টই নেচেচেড়ে দেখলো তারপর খেয়াল করলো দোকানদার গামছা টাইপের কিছু একটা দিয়ে সমানে বইগুলোর উপর বাড়ি মেরে যাচ্ছে। সুবীরের একবার বলতে ইচ্ছে হল, এটা বইয়ের দোকান, মিষ্টির দোকান না যে গামছার বাড়ি মেরে মাছি তাড়া করতে হবে। কিন্তু পরক্ষনেই মাথায় আসলো, কে জানে ব্যবস্থাটা হয়তো মাছি তাড়ানোর জন্য না, তাকে তাড়ানোর জন্যই।
“আপনের কোন বইটা লাগবো কন তো”। গামছা পদ্ধতি কাজ না করার স্পষ্ট বিরক্তি দোকানীর চোখে মুখে।
“ও রকম কোন বইয়ের নাম তো ঠিক ঠাক করে আসিনি। ভাবলাম ঘেঁটে টেটে দেখি ভালো কিছু পাওয়া যায় কিনা”।
“ভাই এইডা কি শাক সবজির দোকান। ঘেঁটে ঘেঁটে টিপে টুপে টমেটো কিনবেন। আসছেন বই কিনতে। আগে থেকে ঠিক না কইরা আসলে হইবো। আপনে একলাই যদি দোকান দখল কইরা খাঁড়ায়ে থাকেন বাকি কাস্টমার খাড়াইবো কই”?
সুবীরের কান গরম হয়ে উঠলো। ইচ্ছা করছিলো টমেটো না দোকানির গলাটা লেবুর মতো চিপে দিতে। কিন্তু এর পরিবর্তে সে যা করলো তা হল, সামনের দিকে হাঁটা দেয়া। সবসময় তাই করে।
“ভাইজান, এইদিকে আহেন, কি লাগবো দেখেন”, গামছা দোকানির পাশের দোকানি বিপুল উৎসাহে তাকে ডেকে চলছে। সুবীর দাড়াবেনা দাড়াবেনা ভেবেও দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো।
“বই খুজতে আসছেন তো। দাঁড়ান। আপনেরে সেইরকম বই দেখাইতেছি”। বলেই বইয়ের স্তূপের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা জরাজীর্ন বই তুলে আনে। “ধরেন ক্ল্যসিকের বাপ এইটা। এই তল্লাটে আর পাইবেন না। অরিজিনাল এডিশন। পইড়া সেইরকম আরাম”।
“এর তো মলাটই নাই। পেইজ সব আছে বলেও তো মনে হচ্ছেনা”।
“আররে ধুর মিয়া, মলাট দিয়া কি করবেন, শোনেন নাই-বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়। ফল ভালা লাগলে, বৃক্ষের নাম এমনেই জাইনা যাইবেন। ঝাকানাকা মলাট দিয়া যদি বই বেচা যাইতো, তাইলে আমি মনা মিয়া, সব ফালায় থুইয়া শুধু নার্সারি কেলাসের বই লাগাইতাম। ছাকনি দিয়া ছাইকা ছাইকা এইসব খানদানি বই রাখনের কোন দরকার আছিলো। কন ভাইসাহেব”।
অকাট্য যুক্তি। প্রতিউত্তরে সুবীর শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কি করা যায়, ভেবে পেলোনা। অতঃপর মিনিট দশেক পর সুবীরকে দেখা যায় ছেড়া ফাটা বইয়ের স্তূপের একাংশ নিয়ে বাসের খোঁজে হাঁটা দিতে। বাসে উঠার পর খানদানি বইগুলোর কিছু খুলে আসা পাতা বেআক্কেলের মত বাতাসের তোড়ে উড়ে গেলো। সুবীর হা হা করেও সেগুলোর নাগাল পেলোনা।
*****
সুবীর বাসার বেল টিপলো ভীষণ অস্বস্তির সাথে। ইদানিং ব্যপারটা খুব বেশী হচ্ছে। বাসায় ঠিক ঢোকার সময়টায় কেন যেন তার অস্বস্তি লাগতে থাকে। যেন অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়তে যাচ্ছে, বিনা দাওয়াতে। আজকে সেই অস্বস্তির মাত্রাটা আরো বেশী। সাথে এতোগুলো ছেড়া ফাটাবই। বই পড়া ছেড়েছে সে অনেক দিন হল। বেনু যদি জিজ্ঞেস করে কেন বই কিনেছে কিছুই বলতে পারবেনা। কিন্তু ভালো সম্ভাবনা আছে বেনু তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করবেনা। হয়তো খেয়ালই করবেনা তার হাতে কিছু আছে। দরজায় যদি এই বেলিং সিস্টেমটা না থাকতো তাহলে হয়তো এইটাও খেয়াল করতোনা সুবীর নামের কেউ এই বাড়িতে থাকে। সুবীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করতে থাকে। দু’বার বেল টেপা হয়ে গিয়েছে। বেনুর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। বাসায় কি নেই। ইদানিং বেনু রাত করে বাড়ি ফেরা শুরু করেছে। প্রথম প্রথম সুবীর বেশ চিন্তায় পড়ে যেতো। ইদানিং অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আগে মনে হত বেনু কোথায়, কতক্ষণ লাগবে ফিরতে। আর এখন মনে হয়, বহুদিনের চেনা মুখটার পেছনে এই মানুষটা কে, তার বেনু আদৌ কি কোনদিন ফিরবে।
“ভাই, ঘটনা কি? বইখাতা নিয়ে এইখানে দাঁড়িয়ে যে। ঘরে কারফিউ নাকি? ঢোকা নিষেধ?” কথাটা বলেই মোস্তাক সাহেব হাসা আরম্ভ করলেন। হাসির দমকে একবার ডানে হেলে যাচ্ছেন আরেকবার বামে। সুবীর কোন কথা বললোনা। এই লোকটার অহেতুক হাসির ব্যামো আছে। সারাক্ষণই হা হা হো হো। আশে পাশের মানুষের জন্য এই রোগটা যতটা বিরক্তিকর। মোস্তাক সাহেবের জন্য ব্যপারটা মনে হয় ততই আরামের। এইভাবে প্রান খুলে হাসার কপাল কি সবার হয়। সুবীরের মাঝে মাঝে মনে হয় এই রোগটা যদি ছোঁয়াচে হত খুব ভালো হত। মোস্তাক সাহেবের সাথে তাহলে একটু গা ঘষাঘষি করে নিতো। শেষ কবে এরকম হা হা করে হেসেছে মনে করতে পারেনা।
“আসেন ভাই। কেচি গেট খুলে দিচ্ছি। প্রথম ধাপ পার। ফাইনালটা রাউন্ড কিন্তু বস আপনাকেই ম্যনেজ করতে হবে। ঐখানে হেল্পিং হ্যান্ড অ্যালাউড না। হা হা হা”।
সুবীর মোস্তাক সাহেবকে হাস্যরত অবস্থায় রেখেই তিনতলায় উঠে এলো। দরজা লক করা। বেনু বাসায় নেই। সুবীর টের পায়, তার অস্বস্তিভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। এই অস্বস্তি কি তাহলে বেনুর মুখোমুখি পড়ার জন্য। একই মাটির উপর থেকে তারা যে কখন দুই ভিন্ন গ্রহের মানুষ হয়ে গেলো, সুবীর জানেনা। জানলেও কিছু করার ছিলোনা। দুইটা মানুষের সম্পর্ক গলিত লোহার মতো, যখন গরম থাকে যে কোন আকারে ফেলা যায়। কিন্তু যখন শীতল হতে থাকে, হয় ভেঙে ফেলতে হয় নয়তো ছুঁড়ে ফেলতে হয়। তাদের সম্পর্কটাও এখন শীতল। কে কাকে ছুঁড়ে ফেলবে তারই হয়তো অপেক্ষা চলছে। সুবীর ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। অন্ধকারের ভেতরই বইগুলো সোফার রেখে লাইট জ্বালায়। এলোমেলো একটা ঘর। সকালে যেমন ফেলে গিয়েছিলো এখনও তেমন আছে।
দরজা লাগানোর জন্য পেছনে ফিরতেই দেখে একটা বই পড়ে আছে, দরজার কাছেই। চাবি বের করতে গিয়ে কোন ফাঁকে হয়তো পড়ে গিয়েছে। অন্ধকার থাকায় দেখেনি। বইটা অন্যগুলোর মতো এতটা ছেড়া ফাটা না। পেপার ব্যাক, কিন্তু বাইন্ডিং ভালো। সুবীর বইটা হাতে নিয়ে উল্টে দেখে। প্রচ্ছদটা কিছুটা অন্যরকম। বইয়ের নাম যেখানে লেখা থাকার কথা সেই জায়গাটা উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে কিন্তু প্রচ্ছদের ছবিটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গাঢ় কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর একটা চোখের ছবি। একটা মানুষের চোখ যতটা বড় হতে পারে, প্রচ্ছদের চোখটাও তত বড়, কিন্তু অনেক বেশী জীবন্ত। মনে হবে বইটা যেন তার পাঠকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শিকারী পাখি শিকার করার আগ মুহুর্তে তার শিকারের দিকে যেভাবে তাকায়। ঠিক তখনই চারপাশ হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে গেলো। প্রথম দফায় সুবীরের মনে হল লোডশেডিং। কিন্ত পরক্ষনেই মনে হল এই অন্ধকারের কিছু সমস্যা আছে। ঢাকা শহরের লোডশেডিং এ কখনই পুরোপুরি অন্ধকার নামেনা। এর ওর বাড়ির চার্জ লাইট, মোবাইলের আলো কিছু না কিছু থাকে। সবচেয়ে বেশী যেটা থাকে সেটা হল শব্দ। কিন্তু অন্ধকার নামার সাথে সাথে চারপাশও যেন নিরব হয়ে গেলো। রাস্তার গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছেনা, মোস্তাক সাহেবের হাসি শোনা যাচ্ছেনা। সুবীর যখন পকেট থেকে মোবাইল বের করার জন্য একটু ঘুরলো ঠিক তখনই দেখতে পেলো সেটা।
একটা চোখ।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে একটা হলুদ রঙ্গা চোখ জ্বলছে। চোখের উপরে কোন পাতা নেই। অপলক, স্থির, আবেগহীন দৃষ্টি। সুবীর প্রথমে নিজের চোখ বন্ধ করতে চাইলো। পারলোনা। কেউ যেন তার চোখের পাতাও কেটে নিয়েছে। চীৎকার করতে চাইলো কিন্তু জিহ্বা অনড়। একটা তীব্র ভয় তার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে যেন একটু একটু করে গুড়িয়ে দিতে থাকে।
সুবীরকে মোস্তাক সাহেব যখন উদ্ধার করেন তার গায়ে তখন প্রচণ্ড জ্বর। ঘোরের মধ্যেই সে বিড় বিড় করে উঠে, বেনু ও বেনু পানি দাও। বেনু পানি দাও। সুবীর তখনো জানতোনা বেণু সে রাতে ঘরে ফেরেনি।
*****
বেণুর খুব সকাল সকাল উঠার অভ্যাস। তার কাছে দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা হল ভোরবেলা। আর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা দিনের প্রথম সুর্য। সকাল বেলায় কেউ যেন বালতি ভরতি নরম আলো চারপাশে ঢেলে দেয়। সুবীর কিন্তু পুরোই উল্টো। তার ধারণা সৃস্টিকর্তার সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি হল ঘুম। সকালে ৫ মিনিট বেশী ঘুমানোর মতো সুখ পৃথিবীর আর কিছুতে নেই। একটা সময় ছিলো সুবীরের এ জাতীয় কথা শুনলে বেণু হেসে কুটি কুটি হতো। কিন্তু এখন প্রচণ্ড বিরক্তি লাগে। তবে স্বস্তির কথা সুবীর কথা বেশ কমিয়ে দিয়েছে। বেণু, দরজাটা খুলে দাও; বেণু, লাইট অফ কর; বেণু, টিভির সাউন্ড কমাও। ঘুরে ফিরে এইসবই ওদের সাংসারিক আলাপ। কিন্তু আজকের আলাপ এতো সংক্ষিপ্ত হবেনা। কিছু কথা বলে ফেললেই ফুরিয়ে যায়। আর কিছু কথা বলে ফেললে জীবন্ত হয়ে উঠে। তারপর সারাজীবন তাড়িয়ে ফেরে। আজকের আলাপটাও হয়তো ওরকমি কিছু হবে। বেণু বারান্দা থেকে সরে আসে। সুবীরের ঘরের দরজা খোলা। পর্দা গুটানো। খাটের উপর সুবীর খুব অদ্ভুত কায়দায় জড়সড় হয়ে আছে।
“আমার মনে হয় তুমি উঠে পড়তে পারো। সারারাত তোমার খাটের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে যে কেউ বুঝবে রাতে তোমার ঘুম হয়নি। শুধু এপাশ ওপাশ করে খাটটাকে আর জ্বালিওনা। মানুষ জ্বালিয়ে মজা আছে। জড় পদার্থ জ্বালিয়ে মজা নেই”।
সুবীর সাথেই সাথেই খাটের উপর উঠে বসলো। বেণু এটা ঠিক আশা করেনি। তার ধারণা ছিলো সুবীর আরো কিছুক্ষণ মটকা মেরে খাটে পড়ে থাকবে। থাকলে ভালো হতো, কথাগুলোকে আরেকটু গুছিয়ে নেয়া যেতো।
“তুমি মোস্তাক সাহেবকে বলেছো আমি রাতে ফিরিনি। উনি উনার স্ত্রীকে বলেছে। উনার স্ত্রী পুরো বিল্ডিংকে বলেছে। এমনও হতে পারে, একটু পর যখন অফিসের বাস ধরতে স্টপেজে যাবো, ওখানকার কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করবে, আফা, আজকে রাতের প্ল্যান কি”?
সুবীর কিছুক্ষণ বোকার মতো বেনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। বেনুর একবার মনে হচ্ছিলো সে হয়তো আজকে আর কোন কথাই বলবেনা, কিন্তু সে বললো। বেশ স্পষ্ট গলায়ই বলল।
“বেণু, কথাটা এইভাবে না বললেও পারতে। নিজেকে ছোট করে তো লাভ নাই। কাল রাতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর মোস্তাক সাহেব আমাকে ঘরে নিয়ে আসেন। বেশ কিছুক্ষণ সাথেও ছিলেন। উনি বাসায় তোমাকে দেখেননি। সেটাই হয়তো উনার স্ত্রীকে বলেছেন। এতোটা হৈ চৈ করার মতো তো না”।
“তুমি বলছো এটা হৈ চৈ করার মতো না। খুবই সাধারণ ব্যপার”।
“খুব সাধারণ বলিনি। বলেছি হৈ চৈ করার মতো না”।
“একই কথা”
“না এক কথা না। রাগ করে গ্লাস ভেঙে ফেলা সাধারণ ব্যপার। কিন্তু রাগ করে কারো মাথা ভেঙে ফেলাটা হৈ চৈ করার মতো ব্যপার। এখানে হৈ চৈ করার মতো কিছু ঘটেনি”।
“আমি তোমাকে যাবার আগে বলে গেলাম, ঢাকার বাহিরে যাচ্ছি। তিন দিন লাগবে। দুই দিন আসা যাওয়া। একদিন সাইট ভিসিট। তুমি সেটা বেমালুম ভুলে গেলে। মোস্তাক সাহেব যখন জিজ্ঞেস করলো কিছুই বললেনা। এমন একটা ভাব করলে আমি কোথায় সেইটাই তুমি জানোনা। এটা খুব সাধারণ ব্যপার”?
“আমি শকের মধ্যে ছিলাম। মনে করতে পারিনি”।
বেণু হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। দাঁতে দাত চেপে বলে, “আমাকে শক শিখাও তুমি। কি মনে কর তোমার এইসব শকের ঢং আমি বুঝিনা? চশমা ছাড়া দুই হাত দুরের জিনিস দেখতে পাওনা, আর তুমি অন্ধকারে ঘরের কোনায় চোখ দেখো?
“বেণু আমি সত্যি দেখেছিলাম”।
“হ্যাঁ অবশ্যই। কাল বইয়ের মধ্যে চোখ দেখেছো, এর আগের দিন প্লেটের কোনায় রাখা ডিমের উপর দেখেছো, তারও আগে অফিসের ফাইলের ভেতর। এর পর বাথরুমে কমোডের মধ্যেও দেখবে। সকালে একবার দেখবে, দুপুরে একবার দেখবে, রাতে খাবারের পর দেখবে। তিন বেলা নিয়ম করে। একদম সহজ স্বাভাবিক ব্যপার”।
“বেণু, তুমি অসুস্থ রোগীর মতো আচরণ করছো”।
“আমি অসুস্থের মতো আচরণ করছি। আমি? তুমি মানুষকে বলে বেড়াবে তোমার বৌ রাতের বেলা ঘরে থাকেনা। কই থাকে তুমি জানোনা। আর আমাকে অসুস্থ বলছো। তুমি জানো, কাল সন্ধ্যায় মোস্তাক সাহেব কি বলছেন, ঘরে অসুস্থ স্বামী রেখে রাতে বাহিরে থাকা ঠিক না। ঘরের মেয়েদের ঘরেই ভালো মানায়। সেটা সকাল, দুপুর, রাত যাই হোক। আমি জানতে চাই, উনি এই কথা বলার সাহস কোত্থেকে পায়"।
“তুমি হিস্ট্রিয়ার রোগীদের মতো আচরণ করছো। একটু খাটের উপর স্থির হয়ে বস”। সুবীর বেণুকে টেনে বসানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। বেণু হাত ধরলোনা। কিন্তু ধপাশ করে খাটের উপর বসে পড়লো। মেয়েটা প্রচণ্ড রেগে আছে। কিন্তু সেই রাগ তার গালের গোলাপী আভাকে ঢাকতে পারেনা। মেয়েটা ভোরের মতোই স্নিগ্ধ, শান্ত, সুন্দর।
“আমি যে সত্যি সত্যি চোখ দেখতে পাই, তুমি এটা বিশ্বাস করোনা তাইনা। তোমার ধারণা সবই আমার ভান”।
বেণু কোন কথা বললোনা। সুবীরের দিকে তাকালোনা পর্যন্ত। তার চোখ বাহিরের দিকে।
“বেণু, জানো প্রথম যেদিন চোখটা দেখেছিলাম, আমার একটুও ভয় লাগেনি। খুব কৌতুহল হয়েছিলো। বুঝতে পারছিলাম পুরোটাই আমার উর্বর মাথার কল্পনা। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই আবার দেখলাম চোখটা। তারপর দেখতেই থাকলাম, দেখতেই থাকলাম। এখন আমার ভয় ধরে গিয়েছে কারণ আমি জানি চোখটা মিথ্যা নয়। চোখটা সত্যি। চোখটা আমাকে এমন কিছু দেখাতে চায় যা আমি খুব কাছে থেকেও দেখতে পাইনা। আমি বোঝাতে পারবোনা বেণু। কি যে একটা যন্ত্রণা। মনে হয় আমাকেও কেউ মেরে ফেলুক। বেণু, একটু বোঝ প্লিজ। আমার খুব কষ্ট হয়। খুব বেশী কস্ট। একটু কি থাকা যায় আমার পাশে”।
বেণু ঘরের চারপাশটায় একবার তাকায়। একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,”এখানে আমারও খুব কষ্ট সুবীর। আমি এখানকার কেউ নই। আমাকে চলে যেতে হবে”।
“এভাবে কেন বলছ বেণু। আমরা একসাথে থাকবো। এতদিন যেভাবে ছিলাম। হঠাত কি হয়েছে তোমার। আমি বুঝতে পারিনা। আমার প্রচণ্ড কষ্ট হয় বেণু”।
বেণু এবার সুবীরের দিকে তাকালো। আহা। কি মায়াময় একটা মুখ। কি মায়াময়।
“সুবীর, সাইকোলজির ভাষায়, একটা বিষয় আছে, কমফোর্ট জোন। একটা মানুষ তার মনের ভেতর একটা বাউন্ডারি আঁকে। এই বাউন্ডারির ভেতর থাকে তার পরিচিত কাছের মানুষ, তার বহুদিনের চেনা পরিবেশ। মোট কথা এমন একটা মানসিক এলাকা যেখানে মানুষটা নিজেকে সব চেয়ে নিরাপদ অনুভব করে আর সেখান থেকে সহজে বেরোতে চায়না। তুমি এতোদিন সেই কমফোর্ট জোনের ভেতরে ছিলে। তোমার সেই নিরাপদ এলাকাতে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে। তুমিও সেটা টের পাচ্ছো। চোখ দেখাটা হচ্ছে তার খুব ছোট একটা প্রভাব। যে প্রভাবটা আরো বড়, আরো ভয়ঙ্কর, সেটা তুমি টের পাচ্ছোনা। কিংবা বলা যায়, পেতে চাচ্ছোনা"।
“বেণু, তুমি কি বলছো এসব আমি বুঝতে পারছিনা। তুমি তো সাইকোলজির ছাত্রী না। কিভাবে জানো এসব? প্লিজ, বুঝিয়ে বলো”।
“আমি আর আগের বেণু নেই সুবীর। কেন তুমি বুঝতে পারছোনা। আমাদের মধ্যে দূরত্ব এতোটাই বেশী। চাইলেও ফিরে আসা সম্ভব না। কিছু কিছু পথ আছে যেখানে হাঁটার সময় পিছনে ফিরে দেখতে হয়না। কারণ পেছনে থাকে অতীত, যে দিতে জানেনা, শুধু ছিনিয়ে নিতে পারে। আর সামনে থাকে ভবিষ্যৎ, যে দিতে চায়। বোকা মানুষেরা নিতে চায়না”।
“আমি তোমাকে ছাড়া কোন ভবিষ্যৎ চাইনা বেণু”।
“তোমার জগতে আমার অস্তিত্ব অতীতে, ভবিষ্যতে না। আমাকে পেছনে থাকতে দাও। পেছনে আর ফিরে তাকিওনা”।
বলে বেণু, আর বসলোনা। ধীর পায়ে উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর পর্দা সরিয়ে হারিয়ে গেলো দৃষ্টির আড়ালে। ঠিক তখনই সুবীর ওটাকে দেখতে পেলো। সেই চোখ। সেই হলুদ রঙের চোখ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ যেন বলছে, সুবীর চোখ খুলো। তোমার চারপাশে তাকাও। তোমার চারপাশের মাটির মানুষ দেখো। যে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে তাকে খুজোনা। সুবীরের প্রচণ্ড পানির তেষ্টা পায়। এই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়না। এই চোখ মিথ্যা কথা বলে। তাকে মিথ্যা দেখাতে চায়। সুবীর চীৎকার করে বলতে চায়, বেণু বেণু, যেওনা, প্লিজ থাকো। একটু পানি দাও। বড় তেষ্টা পাচ্ছে। বেণু, পানি দাও।
******
মোস্তাক সাহেব হাসি খুশি টাইপের মানুষ। কান্না তার ধাতে সয়না। কিন্তু প্রায়ই এই লোকটাকে এই অবস্থায় দেখলে তার চোখে পানি চলে আসে। সুবীর যতক্ষণ অজ্ঞান ছিলো, মোস্তাক সাহেব তার হাত ধরে পাশে বসে ছিলেন। বৌ এসে দু’বার টিপ্পনী কেটেছে। কাটুক, কিছু আসে যায়না। আল্লাহ, সবাইকে সব কিছু দেন না। যেমন এই মহিলাকে রুপ দিয়েছেন, বুদ্ধি শুদ্ধি কিছু দেন নাই। সুবীরকে খুব সুন্দর একটা মন দিয়েছেন, কিন্তু শান্তি দেন নি। কি সুন্দর একটা সংসার ছিলো অথচ বৌটা কি ভয়ঙ্করভাবে মারা পড়লো। অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে কই যাচ্ছিলো যেন। রাস্তায় এক্সিডেন্ট করলো। কি চমৎকার একটা মেয়ে ছিলো। নামটাও কি চমৎকার, বেণু। যাওয়ার দিনও বলে গিয়েছিলো তার জামাইটাকে যেন দেখে রাখা হয়। খুব নাকি আলাভোলা। আসলেও তাই। তিনমাস হয়ে গেলো অথচ এখনো ভুলতে পারলনা। এইভাবে কাউকে ভালবাসতে আছে। সব মাথামোটা লোকজনে দুনিয়া ভরে গেলো। ঘোরের মধ্যে মরা বৌয়ের খোঁজ করছে, তার সাথে কথা বলছে। লোকটা কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। যে কুয়াশায় কোন ভোর থাকেনা। কেবলই ভ্রম থাকে। সুবীর আবারো অস্ফুট স্বরে ডাকল, “বেণু বেণু”। মোস্তাক সাহেব ফতুয়ার কোনাটা চোখে চেপে ধরলেন। ছিঃ পুরুষ মানুষের কাঁদতে আছে।
______________________________________________
আমি যখন লিখছিলাম তখন মাথায় ছিল ভুতের গল্প লিখব। কিন্তু কোনভাবেই এইটা ভুতের গল্প হচ্ছিলনা। সব চেনা জানা ভুতের গল্প হয়ে যাচ্ছিলো। পরে ভাবলাম একটু সাইকো টাইপ করি। কি করবো চিন্তা করতে করতে আমারই সাইকো হওয়ার জোগাড়। শেষমেশ একটা যা তা লিখলাম
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১১:৫০