“আমি লেখক। লেখালিখি করি”।
আমি শুনেও শুনলাম না। তাকিয়েও তাকালাম না। ভদ্রলোক নিজ থেকেই নিজেকে লেখক হিসেবে ঘোষনা দিচ্ছেন। ধরেই নেয়া যায় ঐরকম উচ্চ পর্যায়ের কোন লেখক না। যদি হতেন তাহলে এইভাবে শুরু করতেন, “আচ্ছা আপনি কি ঐ বইটা পড়েছেন, অমুক দেশের তমুক রাইটারের বই। ওয়ান অব দ্যা বেস্ট সেলার। বেশ গবেষনা করে লেখা। লোকের কপাল ভালো, ঐ দেশে জন্মেছেন বলে বইটা বেস্ট সেলার হয়েছে। এ দেশে হলে মুড়ির ঠোঙা হতো। আমাদের হা ভাতে মানুষ কি আর সাহিত্য বোঝে”।
লোকটার চোখে চশমাও নেই। হাতে ভরিক্কি কোন স্বদেশী বিদেশী বইও দেখা যাচ্ছেনা। এই লক্ষণগুলোও লোকটার বিপক্ষে গেলো। চোখে চশমা নাই, মানে চোখ ভালো। যে নিজের চোখ বিসর্জন দিয়ে অন্যের বই পড়েনা, তার বই মানুষ আর কি পড়বে। আমি উপসংহারে উপনীত হলাম। এই লোক ভীষণ রকমের বকবকানি লোক। এইসব হাবিজাবি কথা বলে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পাত্তা না দিলেই লাইনে চলে আসবে।
“কথাটা বিশ্বাস হলোনা, তাই না”।
“না, হয়নি”। সোজা মুখের উপর উত্তর দিয়ে দিলাম। ভদ্রতার ধার ধারলাম না। ইদানীংকালে ভদ্রতা বেশ বিরল জিনিস; যখন তখন যেখানে সেখানে যাকে তাকে দেখিয়ে বেড়ানো যায়না। এমনিতেই লম্বা ট্রেন জার্নি, কিন্তু সিটটা ভালো, জানালার পাশে। উঠে অন্য কোন খালি সিটে যেতে ইচ্ছে করছেনা। একই সাথে আজাইরা প্যাঁচাল শুনতে এবং করতেও ইচ্ছা করছেনা। নিরবতা দরকার।
“তুমি বই টই কেমন পড়ো। চেহারা দেখে তো পড়াশোনার মেয়ে মনে হচ্ছে। বইমেলায় যাও? এই জেনারারেশন তো বই পড়তে চায়না”।
আমার কানের পিছনটা গরম হয়ে গেলো। চেনেনা, জানেনা এই লোক আমাকে তুমি করে বলছে। মাথার চুলে পাক ধরলেই কি দুনিয়ার সবাইকে তুমি করে বলতে হয়।
“লেখক হওয়ার বড় যন্ত্রণা কি জানো। মাথার মধ্যে সারাক্ষণ গল্প ঘুরে। এখন যেমন তিনটা গল্প মাথায় ঘুরছে। এই গল্পগুলোর পেছনে একটা রহস্য আছে। তিনটা গল্পই আমার মাথায় খুব সুন্দর করে সাজানো। কিন্তু কখনো কাগজ কলমে লেখা হয়ে উঠেনি। যখনই লিখতে যাই, মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। তোমাকে দেখে বেশ বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছে। বলতো কেন এমন হয়”?
আমি মুহুর্তের মধ্যেই রহস্যের সমাধান করে ফেললাম। পৃথিবীতে প্রতিটা জীবিত মানুষের মাথা থাকে। কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক মানুষের মাথায় ঘিলু থাকে। বেশীরভাগের মাথায়ই থাকে গোবর। এই মানুষটা দ্বিতীয় প্রজাতির। এর মাথার গল্প মাথায়ই থাকবে। সংগত কারনেই কাগজে কলমে বের হবেনা। আমি আর কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ আগে কেনা পত্রিকায় মন দিলাম। এই পদ্ধতিটার নাম উপেক্ষা পদ্ধতি। পেপারের প্রতি আমার এমন হঠাত উদয় হওয়া মনোযোগ দেখে লোকটার বুঝা উচিত আমি কোনভাবেই তার গল্প শুনতে আগ্রহী নই।
“আমার মনে হয় কি জানো। এই গল্পগুলোর জীবন আছে। এরা ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে বদলায়। কাগজে কলমে জীবনকে বন্দী করা মুশকিল। আমি তিনটা গল্পের দুইটা তোমাকে বলবো। গল্প দুইটা শোনার পর তুমি ঠিক করো তিন নম্বরটা শুনতে চাও কিনা”।
আমি উপেক্ষা পদ্ধতি চালিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু খুব একটা কাজে লাগছে বলে মনে হচ্ছেনা। লোকটাও মনে হয় আমার উপর উপেক্ষা পদ্ধতি খাটাচ্ছে। আমি কি বলি কি করি তাতে তার কিছুই আসে যায়না। সে তার গল্প শুরু করলো।
প্রথম গল্পটা হচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা এক ছেলের। আধুনিক মফঃস্বল না, একেবারে অজঃপারাগেয়ে গ্রাম। বাবা মা ছেলের ভার্সিটিটার নাম ঠিকমতো বলতে না পারলেও দিনের হিসাব ঠিকই রাখে। ছেলে কবে ভার্সিটি পাশ দিয়ে বের হয়ে বড় চাকরি নিবে। বুঝতেই পারছো এই ধরণের ছেলের দিন কাটে ক্লাসে লাইব্রেরিতে, সন্ধ্যা কাটে স্টুডেন্ট এর বাসায়। আর রাতে হলের গনরুমের এক কোনার চুপচাপ পড়ে থেকে ছারপোকা মারে। এই ধরণের ছেলেদের লাইফে খুব একটা বৈচিত্র্য থাকেনা। না এরা ভালো ছাত্র হয়, না ভালো ব্যাকবেঞ্চার হয়। নিম্নবিত্তের গন্ডি পেড়িয়ে মোটামুটি মধ্যবিত্ত হতে পারলেই এদের জীবন সার্থক। কিন্তু ছেলেটার লাইফে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। ছেলেটা প্রেমে পড়ে গেলো। প্রেমে পড়াটা তেমন দুর্ঘটনা না। দুর্ঘটনা হল, যেই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলো সেই মেয়েটা। সেই মেয়ে গাড়ি ছাড়া চলেনা, হাই হিল ছাড়া নড়েনা। মেয়ের এক কথায় ট্রাকের তলায় লাফিয়ে পড়ার মতো ছেলের অভাব নাই। গ্রামের ছেলেটা এই মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলো। ছেলেটা সাদা মাঠা হলেও বুদ্ধি ভালোই ছিলো। বিপদ টের পেতে সময় লাগেনা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যা হয়, নিজেকে পোষ মানানোর সব চেষ্টাতেই গুড়ে বালি। বিপদ আপদ পদার্থবিজ্ঞানে স্বীকৃত পদার্থ না হলেও এদেরও আকর্ষণ বল আছে। এরা মানুষকে কাছে টানতে থাকে। একটা সাদা মাঠা ছেলের বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল করে ছেলেটাও বিপদের কোলে ইয়াহু বলে ঝাপিয়ে পড়লো। ছেলেটা মেয়েটার ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফেললো।
এক শীতের রাতে ধুরু ধুরু বুকে ছেলেটা মেয়েটাকে ফোন দিলো। রিং হচ্ছে। ছেলেটার মনের এক পাশ বলে রিং হোক, হতেই থাক, কেউ ফোন না ধরুক। প্রিয় মেয়েটার মোবাইলে তার নাম্বারটা কিছুক্ষণ ভেসে থাকুক। কিন্তু মনের অন্যপাশটা আবার একটু সাহসী। সে চায় মেয়েটা ফোন ধরুক। তার গলার আওয়াজটা আজকের রাতের জন্য তার কানের সাথে লেগে থাকুক। মানুষের মনই তো। কত কিছু যে চায়। মোবাইলের অন্যপাশে যত রিং হতে থাকে ছেলেটার বুকের ধুকপুকানি ততো বাড়তে থাকে। এক সময় রিং বন্ধ হয়ে যায়। একটা মিষ্টি রিনরিনে গলার স্বর ভেসে আসে,”হ্যালো”। ছেলেটা চুপ হয়ে যায়। মাথার ভেতর কত কথা। মুখ দিয়ে কিচ্ছু বের হলোনা। মেয়েটাও মনে হয় ফোনের ওপাশ থেকে তার হৃদপিণ্ড লাফানোর শব্দ পাচ্ছে। নিশ্চয়ই পাচ্ছে নইলে অমন চুপ হয়ে গেলো কেন। বার কয়েকবার হেলতে বলে মেয়েটাও এখন চুপ। ফোনের এপাশে নিরবতা ওপাশেও নিরবতা। আর হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ। কতক্ষন হবে, মিনিট পাঁচেক। একটা খুট করে শব্দ। লাইনটা কেটে গেলো। ছেলেটা একটা অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে সে রাতে ঘুমাতে গেলো। তার মনে হতে থাকে জীবনটা বড়ই সুন্দর। জীবনের চেয়ে সুন্দর কিছু নাই।
ব্যপারটা এরপর রুটিন হয়ে গেলো। সকালে ক্লাস, সন্ধ্যায় ছাত্র পড়ানো আর রাতে ফোন। সেই ফোনের আলাপও মধুর। এপাশে নিরবতা ওপাশেও নিরবতা। মাঝে মাঝে খুক খুক কাশি। ফ্যানের শব্দ। হালকা শ্বাসের শব্দ। এই ছোটখাটো শব্দগুলো দিয়েই কত যে কথা বলা হয়ে যায়। ছেলেটা প্রতি রাতে নিয়ম করে ফোন দেয়। কিন্তু কোন কথা বলেনা। মেয়েটাও নিয়ম করে ফোন রিসিভ করে কিন্তু কোন কথা জিজ্ঞেস করেনা। ফোন কলের ডিউরেশনই শুধু প্রতিদিন লম্বা হয়।
এভাবে খুব বেশিদিন চলার কথা ছিলোনা। কিন্তু কিভাবে কিভাবে যেন ছেলেটা নিজেকে অনার্স শেষ বর্ষে আবিস্কার করে। মেয়েটাও তাই। কি অদ্ভুত! মেয়েটার সাথে ছেলেটার কখনো সামনা সামনি কথা হয়নি। ছেলেটা বুঝেনা, দিনের আলোয় মেয়েটার উচ্চস্বরের হাসি যতটা অপরিচিত লাগে, রাতের বেলায় সেই মেয়েটার নিরবতা ততটাই আপন লাগে। দিনের বেলায় সেই হাসিতে কি উদ্ধত ঝংকার। আর রাতের বেলায় নিরবতার মাঝেও কি মায়া। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে কত রহস্যই না তৈরি করে রেখেছেন।
অনার্স জীবন শেষ হতে চলেছে। ক্লাসের সবাই মিলে প্ল্যান করলো ইন্ডিয়া ঘুরে আসবে। ছেলেটা যাবেনা। কিন্তু মেয়েটা যাবে। মেয়েটাই মোটামুটি নেতৃত্ব দিয়ে যাবার প্ল্যান প্রোগ্রাম ঠিক করে ফেললো। ছেলেটার মন খারাপ। রুটিন ফোন কলে বিরতি পড়ে গেলো। যেদিন সবাই মিলে হই হই করে বাসে উঠে ট্যুরে বেড়িয়ে গেলো, সে দিনের পুরোটা সময় ছেলেটা লাইব্রেরীতে পড়ে থাকলো। মাঝে মাঝে একাকীত্বও খুব ভালো সঙ্গী হতে পারে। সে রাতে ছেলেটা চুপচাপ ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু পরদিন আর থাকতে পারলোনা, ফোন দিয়ে বসলো। একটা যান্ত্রিক মহিলার দুঃখবোধ শুনতে হবে। তাও ভালো, এতে যদি নিজের দুঃখবোধের কিছুটা লাঘব হয় ক্ষতি তো নেই। কিন্তু ছেলেটাকে অবাক করে দিয়ে ওপাশে রিং হলো। কয়েকটা রিংএর পর সেই মিষ্টি রিনরিনে গলার আওয়াজ, “হ্যালো”। ছেলেটা হা হয়ে বসে থাকে। মেয়েটা কি তাহলে ট্যুরে যায়নি। এমনকি হতে পারে, সে যাচ্ছেনা দেখে মেয়েটাও যায়নি। নাহ, সে তো স্পষ্ট দেখলো চাঁদার লিস্টে সবার উপরে মেয়েটার নাম। পরের দিনটা কাটল ভীষণ ব্যস্ততায়। ছেলেটা অনেক বার করে খবর নিলো। না! কোন ভুল নেই। মেয়েটা পুরো দলের সাথে দার্জিলিং এ আছে। ওখানকার নাম্বারও সে যোগাড় করে ফেললো। মেয়েটা কি তাহলে ফোনটা এখানে কাউকে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে যে স্পষ্ট শুনলো গলার আওয়াজ। ছেলেটা বেশীক্ষণ ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতে পারলোনা। পরের দিন রাতেই জোগাড় করা নাম্বারে ফোন দিলো। রিং হল। ঘুম ঘুম গলায় একটা মেয়ে ফোন ধরলো। রিনরিনে নয়; খসখসে কড়া কন্ঠ। কণ্ঠটাকে ছেলেটার আপন মনে না হলেও খুব পরিচিত মনে হতে থাকে। ওখানে খুব ঠাণ্ডা পড়ে হয়তো, মেয়েটা শব্ধ করে কেশে উঠলো। কি অদ্ভুত মেয়েটার কাশির মধ্যেও কি হাসির সেই উদ্ধত ঝংকার থাকতে হবে।
আগেই বলেছি, ছেলেটার বুদ্ধি ছিলো ভালোই। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগেনা। সে এতদিন যেই নাম্বারে ফোন দিয়েছে, সেটা এই হাই হিল মেয়ের ফোন নাম্বার না। যে দিয়েছে সে হয়তো ভুল করে দিয়েছে বা ইচ্ছে করেই ভুল নাম্বার দিয়েছে। এখন এসব জানতে চাওয়ার কোন মানে নেই। এসব ক্ষেত্রে ছেলেটার মন ভেঙে চুরে খান খান হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এসব কিছুই হলোনা। ছেলেটা খুব অবাক হয়ে আবিস্কার করলো নিজেকে খুব হালকা লাগছে। কেমন যেন খুশি খুশি লাগছে। এইবার আর রাতের আধারে নয়। ফকফকা দিনের আলোয় মেয়েটাকে ফোন দিলো। প্রায় সাড়ে তিন বছরের পর সে প্রথমবারের মতো কথা বলল, “তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি আসবে”।
এই পর্যন্ত বলে লোকটা থেমে গিয়ে চুপচাপ ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “থেমে গেলেন কেনো? কি হল তারপর, মেয়েটা কি এসেছিলো?”
লোকটা জানালার দিকে তাকিয়েই হাসল। ট্রেন পুরোদমে ছুটছে। ট্রেনের সাথে তাল মিলিয়ে মাঠ ঘাট বাড়ি ঘর পেছন দিকে ছুটে পালাচ্ছে। মোটেও হাস্যকর কোন দৃশ্য নয়। লোকটা ভালো ড্রামা করতে জানে দেখা যায়।
“আমার ধারণা ছিলো, তুমি শুনছিলেনা”
“প্রথমে শুনছিলাম না। কিন্তু পরে খেয়াল করলাম গল্পটা গল্প হিসেবে তেমন জোরালো না হলেও আপনার বলার ভঙ্গি বেশ ভালো। ধারাবাহিকতা আছে। মনোযোগ দিয়ে শোনা যায়।”
“তোমার কেন মনে হচ্ছে গল্পটা গল্প হিসেবে তেমন জোরালো না”
“অনেকগুলো কারণ। প্রথমত, কোন কথা বার্তা ছাড়া কেবল ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলে কোন সম্পর্ক হতে পারেনা। তাও এতো দীর্ঘদিন। ফ্যান্টসির মাত্রাটা একটু বেশীই”।
“লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট হতে পারলে, লাভ উইদ আউট এনি সাইট কেনো হতে পারবেনা”।
“তাই বলে, উইদ আউট সাউন্ড”।
“আচ্ছা যাও গল্পটাকে যদি একটু বদলে দেই। ধরো এইটিস এর দিকে। যখন কোন মোবাইল টোবাইল ছিলোনা। ছেলে মেয়েদের এমন দহরম মহরম টাইপ মেলামেশার সুযোগও ছিলোনা। কেবল দূর থেকে এক ঝলক দেখা। আর সুযোগ বুঝে একে তাকে দিয়ে কিংবা বাসায় বারান্দার ছাদে ঢিল মেরে একটা ছোট্ট চিরকুট পাঠানোই ছিলো যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তখন কি এমন প্রেমে পড়া সম্ভব? যার হয়তো গলার আওয়াজটাও শোনা হয়নি ঠিক মতো তার ছোট্ট একটা চিরকুটে কেউ যদি বাল্যকালের ঘর বাড়ি বাবা-মা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে তবে কি গল্পটা তোমার কাছে জোরালো মনে হবে”।
আমি স্থির চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“কিছু বলছোনা যে, গল্পটা খুব পরিচিত লাগছে তাইনা”
“আপনি দ্বিতীয় গল্পটা বলুন”।
“শুনতে চাও”
“হ্যাঁ চাই”
“প্রথমটার শেষ তো শুনলেনা”
“আপনি দ্বিতীয় গল্পটা প্লিজ শুরু করুন”
এই গল্পটা একটা মেয়ের। তুখোড় মেধাবী যাকে বলে। ক্লাস ফাইভ, এইট দুটোতেই বৃত্তি পাওয়া। এসএসসি ও এইচএসসি দুইটাতেই মার মার কাট কাট রেজাল্ট। তাই বলে মেয়েটা যে সারাক্ষণ বই নিয়ে পড়ে থাকে তা না। গান নাচ খেলা সবকিছুতেই পারদর্শী। অলরাউন্ডার যাকে বলে। শুধু বাবা মার চোখের মণি বললে কম বলা হবে। পুরো এলাকারই আদরের দুলালী।
এইটুকু বলে লোকটা সোজা আমার দিকে তাকালো। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম না। সোজা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা একটা জটিল খেলা খেলার চেষ্টা করছে আমার সাথে। খেলুক। একজন তুখোড় মেধাবী মেয়ে জটিলতা ভয় পায়না।
মেয়েটা তখন মাত্র নতুন ভার্সিটিতে উঠেছে। এক সেমিস্টারও মনে হয় যায়নি। মেয়ের বাবা মা হজ্বে গেলেন। হজ্ব থেকে আসার পর একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেলো। তারা দু’জনেই ভীষণ রকমের ধার্মিক হয়ে গেলেন। সেই পরিবর্তনের প্রথম ধাক্কাটা গেলো মেয়েটার উপর দিয়ে। এক ছুটিতে বাড়িতে যেতেই এক হুজুর পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
এক মুহুর্তে মেয়েটার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। যে পরিবারে মেয়েটার বিয়ে হল সেখানে কঠিন পর্দা প্রথা। গান, বাজনা, আবৃতি তো দূরে থাক মেয়েদের বাইরের কোন পুরুষের সামনে যাওয়াও নিষেধ। বিয়ের পুরো এক সপ্তাহ মেয়েটা ঐ বাড়িতে রইলো। এই এক সপ্তাহ সে কারো সাথে তেমন কথা বলল না। জামাই ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষের চেহারাও সে দেখলোনা। এমনকি জামাই মানুষটার চেহারাও ঠিকমতো দেখলোনা। ঠিক এক সপ্তাহ পর মেয়েটা শ্বশুরবাড়ির সবার সামনে দিয়ে তল্পি তল্পা গুছিয়ে চলে এলো। কেউ তাকে থামালোনা, কেউ তাকে যেতে বারণ করলনা, কেউ জিজ্ঞেসও করলোনা সে কোথায় যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করেনি তাতে মেয়েটার বরং ভালোই হয়েছে। কারণ সে নিজেও জানতোনা সে কোথায় যাচ্ছে।
“আপনার কি মনে হয়, মেয়েটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে”?
“ভুল ঠিক বলা তো লেখকের কাজ না। লেখকের কাজ গল্প বলা। গল্পের প্রতিটা চরিত্রর সপক্ষে বলা। এতক্ষণ বললাম মেয়েটার কথা। এখন বলবো গল্পের অন্যন্য চরিত্রের কথা। মেয়েটার শ্বশুর বাড়ির কথা। মেয়েটা ছিলো ভীষণ জেদী অভিমানী। যেই এক সপ্তাহ মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে কাটিয়েছে সে পুরো সপ্তাহটা সে ছিলো অন্ধ। বাবা-মার প্রতি প্রচণ্ড রাগে তার বোধ শক্তি কাজ করেনি। যদি করতো তাহলে সে দেখতো তার শ্বাশুরির ঘোমটার নিচে স্নেহময় একটা মুখ। যে খুব ভালো করে জানে তার সদ্য বিবাহিতা পুত্রবধু এই পরিবেশে অভ্যস্ত নয়। সে তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলো। প্রথমেই কঠিন নিয়ম নিষেধে বাঁধেনি। কিংবা তার স্বামীটা। যার মুখের দিকে তাকালেই সে দাঁড়ির জঙ্গল দেখতে পেতো। দাঁড়ির পেছনের ভালোবাসাময় মুখটা দেখার তার ইচ্ছাই হয়নি। সব কিছু বাদ দিয়ে মেয়েটা তো এটাও ভাবতে পারতো এতো রক্ষনশীল একটা পরিবার অথচ সে চলে আসার সময় কোন বাধা দিলোনা কেন”!
“কেন বাধা দেয়নি তারা”?
“ভুল প্রশ্ন। প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিলো এমন একটা তুখোড় মেধাবী মেয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে এতো বোকা কি করে হয়ে গেলো যে সে এই চমৎকার মায়ার টানগুলোকে ধরতে পারলোনা। তুমি কি এখন তৃতীয় গল্পটা শুনতে চাও”।
“আমার মনে হয় আপনার তৃতীয় গল্পটা আমি জানি”
“আমার তো মনে হয় তুমি এই দুইটা গল্পও জানতে। তারপরেও শুনেছ। তৃতীয়টাও শুনতে চাচ্ছ। ভুল বললাম”।
আমি কিছু বললাম না। লোকটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
এই গল্পটা হচ্ছে একটা মায়ের। একটা খুব লক্ষ্মী মেয়ের জননী সে। এই মা তার কিশোরী বয়সে এক বিশাল ভুল করে ফেলে। প্রেমের টানে বাবা-মা ভাই বোন সবার কথা ভুলে গিয়ে এক অর্ধপরিচিত ছেলের সাথে ঘর ছাড়ে। নতুন সংসার শুরু করে। সেই সংসার ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। বিপত্তিটা বাঁধে যখন সে তার ভিতরে অন্য এক সত্তার অস্তিত্ব টের পায়। মেয়েটা প্রথম বারের মতো মা শব্দটার ব্যপকতা উপলব্ধি করে। প্রথম বারের মতো টের পায় সে কি পেছনে ফেলে এসেছে। মেয়েটা তার পরিবারের খোঁজে বের হয়। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। মেয়ের বাবা মারা গিয়েছিলো তার চলে আসার পর পরই। সে জানতোনা। তাকে জানানোর প্রয়োজনও কেউ বোধ করেনি। মেয়েটা তার মায়ের কাছে নতুন অতিথির কথা বলতে গিয়েছিলো। তার মা তার চেহারাটাও দেখতে চাইলেন না। যে ভালবাসার টানে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলো, আজ সে ঘরের ভালোবাসার প্রত্যাখ্যানে তার দুনিয়াটাই ভেঙে পড়তে থাকে। মেয়েটা তার সংসারে ফিরে আসে। একটা মেয়ের মা হয়। এক তুখোড় মেধাবী কন্যার মা।
আমি কোন কথা বললাম না। লোকটার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। আমি যখন ছোট ছিলাম আমার খুব প্রিয় একটা খেলা ছিল আম্মুর শাড়ি গয়নাগাটি পরে সাজুগুজু করা। তখনি আম্মুর ড্রয়ারে রাখা কিছু সাদা কাগজ দেখেছিলাম। বেশীরভাগ কাগজেই কিছু লেখা ছিলোনা। একদম সাদা। আরেকটু বড় হয়ে পরে আবিস্কার করে ছিলাম ঐগুলা ছিলো বিয়ের আগে আম্মুকে লেখা আব্বুর চিঠি। ঐ খালি চিঠি পড়েই মা নানা-নানু সবাইকে ছেড়ে বাবার হাত ধরে চলে এসেছিলেন। পুরো ব্যপারটা কি যে হাস্যকর ঠেকেছিল। মাকে যা বোকা মনে হয়েছিলো। কিন্তু দিন গেলে আস্তে আস্তে বুঝলাম, মানুষের মন অনেক জটিল জিনিস। বাবা মাকে অনেক ভালবাসতেন। আমিও মাকে অনেক ভালবাসতাম। আমাদের ছোট্ট সংসারটায় সবই ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু তাও মা, প্রতিরাতে কাঁদতেন। কোরআন শরিফ পড়তেন আর কাঁদতেন। তখনই প্রথম বুঝলাম, আমরা সবকিছুকে ভালবাসা নামের চারটা অক্ষরে বেঁধে দিলেও ব্যপারটা এতো সহজ নয়। এক ভালবাসা কখনো আরেক ভালবাসার পরিপূরক হতে পারেনা। বাবা-মার ভালোবাসা এক রকম, প্রিয় মানুষটার ভালবাসা এক রকম, সন্তানের ভালবাসা আরেকরকম। জীবনে প্রত্যক রকম ভালবাসাই ভীষণ রকম দরকারী।
আমি আমার সামনে বসা লোকটার দিকে তাকালাম। লোকটা হাসিমুখ করে জানালার বাহিরে তাকিয়ে আছে। যেন এইমাত্র খুব জটিল একটা সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। এখন আর কোন চিন্তা নেই। আমি পুরোটা দিন বিক্ষিপ্ত ছিলাম। এখন আরো বিক্ষিপ্ত হয়ে আছি। টের পাচ্ছি ট্রেনের গতি আস্তে আস্তে কমে আসছে। সামনে কোন স্টেশন আসছে হয়তো।
“আমি এই স্টেশনেই নেমে যাবো। চাইলে তুমিও নামতে পারো আমার সাথে”।
“আমার এখানে নামার কথা না”
“কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি এই স্টেশনেই নামবে। রাত এখনো বেশী হয়নি। একটা বাস ধরে চলে গেলে দুই ঘন্টার মধ্যেই চিটাগাং স্টেশনে পৌঁছে যাবে। তোমার হুজুর জামাই অনেক্ষন হল স্টেশনে তোমার খোঁজ করছে। বাড়ির বৌকে এই রাতের বেলায় এমনি এমনি কেউ একলা ছেড়ে দেয়না। মুখে দাড়ির জঙ্গল থাকলে মনটাও যে জংলী হবে এমন কোন কথা আছে”।
আমি কিছুই বললাম না। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি এই লোকটার সামনে কাদবোনা। কিছুতেই কাদবোনা।
“একটা মজার ব্যপার কি জানো মানুষের ভাগ্য নিজেই একটা রহস্যময় গল্প। অনেকখানি গল্প সে নিজে নিজেই লিখে, আর বাকিটুকু মানুষ নিজের হাতে লিখে নেয়। জীবনের কোন পথে ভালবাসা কোন মোড়কে আসবে তুমি জানোনা। তুমি বুদ্ধিমান মেয়ে। তোমার মায়ের ভুলটাই আবার করে রাতে বালিশ ভেজাবেনা নিশ্চয়ই। what goes around comes around। এমন কিছু করে বসোনা, যা পরে তোমার কাছে ফেরত এলে সহ্য করতে না পারো”।
“আপনি কে বলুন তো। আপনি কিভাবে এতো কিছু জানেন”?
“আমি লেখক। লেখালিখি করি। লেখকদের অনেক কিছু জানতে হয়”।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৩৬