ঠোঁট দুটিকে পরাজিত করে মুহূর্তেই দুই পাটি দাঁত বের হয়ে এল। কিছুতেই ঠোঁট দুটিকে এক করতে পারছেন না গেদু চাচা। তিনি এখন এতটাই খুশি। খুশি হবেন না কেন! গেদু চাচার একমাত্র ছেলে পল্টুু এই মাত্র ফোন করে বলেছে, ‘বাবা, আগামীকালই মাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এসো। ঢাকা থেকে এবার ঈদের শপিং করে দেব।’ গেদু চাচা মুখে ক্লোজআপ মার্কা হাসি নিয়ে চাচির সামনে এসে দাঁড়ালেন। চাচি তো হতবাক। ‘এ কি! তোমার ডান চোয়ালের তিন-তিনটা দাঁত পোকায় খেয়ে ফেলেছে অথচ আমাকে একটিবারও বললে না?’ খাইছেরে, শেষতক বউয়ের কাছে দাঁত নিয়ে অপমান হতে হলো। গেদু চাচার স্ফীত ঠোঁট দুটি এবার টপ করে এক হয়ে গেল। রাত পোহালেই গেদু চাচা ঢাকার উদ্দেশে জীবনে প্রথমবারের মতো ফুরুত্ দেবেন। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। এবার তিনি লাল-নীল বাতি দেখবেনই। আনন্দে তার ঘুম আসছে না। তিনি ডানে বামে হাত-পা ছুড়ছেন। হঠাত্ লাথিতে চাচির কাঁচা ঘুম ভেঙে ফেলায় তিনি গেদু চাচাকে ঝাড়ি দিয়ে বললেন, ‘ব্যাঙের মতো হাত-পা ছুড়ছ ক্যারে? এই মধ্যরাতে তোমাকে আবার মৃগী রোগে ধরল নাকি?’ গেদু চাচা ঝিম মেরে গেলেন। তিনি জানেন, বউকে রাগালে তাকে খাটের নিচে রাত্রিযাপন করতে হবে।
সকাল হতে না হতেই গেদু চাচা শপিংয়ে রওনা দিলেন। শপিং মলে ঢোকার পথে দরজায় তিনি ঠাস করে ধাক্কা খেলেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন না কোথায় তিনি ধাক্কাটা খেলেন। দারোয়ান এসে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘কাহা, এইডা অইলো গ্লাসের দরজা। দেইখ্যা ঢুকবেন না? আরেকটু অইলেই কোনো দুঘর্টনা ঘইট্যা যাইত।’ গেদু চাচা লজ্জা পেলেন, তিনি বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘শুনেছি ঢাকায় টাকা উড়ে অথচ এত বড় শপিংয়ের দরজায় গ্লাস আটকানো। আরে বাবা, মেহগনি, নিম কাঠ কেনার টাকা না থাকলে অন্তত রেইনট্রি কাঠ দিয়ে হলেও একখান দরজা বানাও। চোর, ডাকাত পড়লে একজন দারোয়ান সামলাতে পারবে? বিড়াল দিয়ে যদি হালচাষ করা যেত তাহলে মানুষ গরু কিনত?’
মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে গেদু চাচার চোখ আটকে গেল একটি ডল দেখে। তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, ‘দেখছনি, কী সুন্দর চেহারা সুরত! ঝলমলে শাড়ি পরা, কত আদবের সাথে সবাইকে কুর্নিশ করছে। শহুরে মহিলা বলে কথা। এই মহিলার তুলনায় আমার বউ তো রাস্তার ফকিন্নির মতো। কেন যে বাবা আমাকে শহরে বিয়ে করাল না।’ গেদু চাচার মাথা হ্যাং মারছে দেখে চাচি তাকে পিছন থেকে চিমটি দিলেন। তিনি ডলের মোহ নিয়েই সামনে অগ্রসর হলেন। বউয়ের জন্য একখান শাড়ি পছন্দ করলেন।
দোকানদার শাড়ির দাম বিশ হাজার টাকা চাওয়াতে গেদু চাচা এদিক সেদিক তাকালেন। দাঁত কিটমিট করলেন। বউকে অন্যত্র ডেকে নিয়ে বললেন, ‘দেখ তো, এখানে কোনো বাঁশ আছে কি না?’ চাচি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বাঁশ দিয়ে তুমি কী করবে?’ তিনি বললেন, ‘কী করমু মানে? দোকানদারকে বাঁশ দিমু। আমাদের গফাকুঁড়ির মোড়ে এই শাড়ির দাম চাইত মাত্র পাঁচশত টাকা আর বেটা কিনা চায় বিশ হাজার টাকা!’ চাচি বললেন, ‘মাথা গরম না করে সামনে চল।’ খানিক যাওয়ার পর চাচি আবার বললেন, ‘আমার জন্য অনেক কিছুই তো কেনা হলো, এবার চলো তোমাকে একখান রুমাল কিনে দিই।’ বউয়ের জন্য যে বাজার করা হয়েছে তাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে তার দু’হাত, দু কাঁধ ভরে গিয়েছে। আরো কিছু কেনা মানে বোঝা বাড়ানো। তাই গেদু চাচা চাচিকে রবি ঠাকুরের একটি কবিতার ক’টি লাইন শুনিয়ে দিলেন, ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’
মার্কেট থেকে বের হয়ে দেখলেন, হঠাত্ বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটু সমান পানি জমে গেছে। রাস্তার পানির স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটতে খুব মজাই লাগছে গেদু চাচার। তিনি যেন একটি নদীর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, যার পানি হাঁটু সমান। মজা করে হাঁটতে গিয়ে তিনি ম্যানহোলের ফাঁক গলে নিচে পড়ে গেলেন। কিছু বুঝার আগেই তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন বিশাল এক ড্রেনের মধ্যে। এত টাকার শপিংয়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তিনি দু’হাতে শপিং ব্যাগ জাপটে ধরে ভাসতে লাগলেন। ইতিমধ্যে কয়েক ঢোঁক পানি তার পেটে চলে গেছে। তিনি এবার জীবনের আশা জিইয়ে রাখতে দামি শপিংয়ের আশা ত্যাগ করলেন। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি শেষবারের মতো সজোরে চিত্কার করলেন, ‘ওরে পন্টুর মা-রে.... আমারে বাঁচা...।’ কিন্তু না! কারো কোনো শব্দ তিনি শুনতে পেলেন না। অত্যধিক ভয়ে প্রাকৃতিক কাজটিও তিনি সেরে ফেললেন। জীবনের অন্তিম লগ্নে তার মনে পড়ে গেল রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গানের অংশ, ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না...।’ এদিকে গেদু চাচার গোঙানির শব্দে চাচির ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘাড় উঁচিয়ে গেদু চাচাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললেন, ‘এই, তুমি গলাকাটা মুরগির মতো এমন ধড়ফড় করতাছ ক্যারে?’ গেদু চাচা চোখ মেলে তাকালেন। তিনি এতক্ষণে বুঝে গেছেন, কিছুক্ষণ আগে যা দেখেছেন তার পুরোটাই মিথ্যা। সত্যি শুধু একটিই, তাহলো ভয়ে প্রাকৃতিক কাজটি তিনি ড্রেনে সারেননি, সেরেছেন বিছানায়। বিষয়টি ধরতে চাচির বেশিক্ষণ সময় লাগল না। তিনি আহত বাঘিনীর মতো চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘একি! বিছানা তো পুরোটাই ভেজা। তাহলে কী তুমি...? ছিঃ এই বুড়ো বয়সেও...!’ গেদু চাচা টু শব্দটিও করছেন না। শুধু মনে মনে বললেন, বিড়াল কি আর কম সহজে গাছে ওঠে। তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে ঢাকায় শপিং করতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করলেন।
সুত্র
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৭ সকাল ১১:১৫