৩৯ বছর বয়সে ফ্রান্সের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের বাইরে সাবেক একজন ব্যাংকার ইমানুয়েল ম্যাক্রন ফ্রান্সের এ যাবতকালের সবচেয়ে কমবয়সী প্রেসিডেন্ট। তার কাছে হেরেছেন উগ্রডানপন্থী প্রার্থী লো পেন। তাই নতুন এক সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন ম্যাক্রন। তিনি উদারপন্থী হলেও এর আগে কখনো তিনি নির্বাচিত হননি আর তার দলও দেশ শাসন করেনি। সিএনএন এক শিরোনামে বলেছে, ‘রাজনৈতিক নবজাতক থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট’। আগামী জুনে ফ্রান্সের সংসদ নির্বাচন যেখানে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে কারণ তার রাজনৈতিক দল অতটা সংগঠিত নয়
এক সময় ফ্রান্সের রাজনীতিতে ম্যাক্রন উপহাসের বিষয় হলেও তিনিই শেষ হাসি হাসলেন। স্বাধীন মধ্যপন্থী হিসেবে পরিচিত ম্যাক্রন কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ছাড়াই ব্যাংকার থেকে রাজনীতিতে আসেন। প্রতিপক্ষের কাছে তিনি ছিলেন অভিজ্ঞতাহীন। তারপরও বিস্ময়করভাবে তিনি মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার বিবাহিত জীবনও বেশ চমকপ্রদ এবং যা ভোটারদের নজর কেড়েছে আস্থার প্রতীক হিসেবে। ১৭ বছর বয়সে ম্যাক্রন তার শিক্ষিকাকে বলেছিলেন, একদিন তাকেই তিনি বিয়ে করবেন। ম্যাক্রন তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেছেন তার চেয়ে ২৪ বছরের বড় ব্রিজিত ট্রোগনিউক্সকে বিয়ে করে। তাই ‘ইমানুয়েল ম্যাক্রন: এ পারফেক্ট ইয়ং ম্যান’ নামে ফ্রান্সের সাংবাদিক এ্যানি ফুলদা’র বইটি বেশ সাড়া ফেলেছে। বইটিতে উঠে এসেছে কিভাবে নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পিতার আদেশ অমান্য করে ৩ সন্তানের জননীকে ম্যাক্রোঁ বিয়ে করেছেন। এ নিয়ে সমালোচনার জবাবে ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘যারা এই গুজব ছড়িয়ে দিতে চায় যে আমি প্রতারণা করছিৃ শুধু ব্রিজিতের জন্যে এটা অপ্রীতিকর নয়, কিন্তু আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমার পুরো জীবন তার সাথে ভাগ করে নেই। ব্রিজিতও অবাক হন কিভাবে আমি শারীরিকভাবে এটি করতে পারি।’
উত্তর ফ্রান্সের আমিয়েন্স শহরে জন্মগ্রগণ করেন ম্যাক্রোঁ। প্যারিসের অভিজাত লিসি হেনরি’তে পড়াশুনা করেন তিনি। রাজনীতির ওপর তালিম নিতে তিনি ইকোল ন্যাশনাল ডি’এ্যাডমিনেস্ট্রেশনেও ঢুকেছিলেন। এরপর ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলান্দের কর্মচারি হিসেবে ২০১২ সালে নিয়োগ পান। তার আগেই ব্যাংকার হিসেবে ম্যাক্রোঁ প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। দুই বছর তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার লক্ষ্যই ছিল ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা। এজন্যে উদার সংস্কার করলে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
সংসদে পিছনের আসনে বসে থাকলেও সরকারের কাজের সমালোচনা করতে ম্যাক্রন পিছপা হননি। শ্রমিকদের জন্যে সংস্কারে তার নীতিকে তথাকথিত ‘ম্যাক্রন ল’ হিসেবে উপহাস করা হয়েছে। দমে যাননি ম্যাক্রোঁ। শুধু অর্থনীতিতে পরিবর্তন নয় একই সঙ্গে সহায়ক সংস্কারে অবিচল থেকেছেন তিনি। নির্বাচনে দাঁড়াবার ঘোষণার সময় তিনি তাই বলেছিলেন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা তিনি তার আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করবেন অর্থাৎ দৃঢ় সংকল্পই দেখিয়েছেন ফ্রান্সের ভবিষ্যত প্রয়োজনীয় সংস্কারের পক্ষে। পেনশন ব্যবস্থায় সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার থেকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্থির সংকল্প নেন যা ভোটারদের মন কেড়েছে। প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে বলেছেন আরো ১০ হাজার পুলিশ বৃদ্ধি না করলে সন্ত্রাস মোকাবেলা করা যাবে না। আইএস জঙ্গিদের মোকাবেলায় ট্রাস্ক ফোর্স গঠনের ওয়াদাও করেছেন ম্যাক্রন। তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন আরো বৃদ্ধির কথা খোলাখুলি বলেছেন তিনি।
ইউরোপের প্রভাশালী দেশ হিসেবে ইইউ’এর পক্ষে বাজার আরো সুসংহত করতে চান ম্যাক্রোঁ। একক বাজারের পক্ষে তিনি। সিরিয়া সংকট নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছাড়াও রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক ও সৌদি আরবের সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনায় রাজি।
গত মার্চে ফ্রান্সের সাবেক সমাজবাদি প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল ভলস ঘোষণা দেন ম্যাক্রোঁর পক্ষেই নির্বাচনে লড়বেন তিনি। প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে এভাবেই এগিয়ে যান ম্যাক্রোঁ। এরপর বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে তার প্রতি সমর্থন আরো বাড়তে থাকে। পরাজিত সমাজবাদি প্রার্থী বেনইত হ্যামন, রিপাবলিকান ফ্রাঁসোয় ফিলন ও এ্যালেই জাপ্পি তাদের ভোটারদের ম্যাক্রোঁকেই দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আহবান জানান। ফলে সকল বয়সী ভোটারদের মন জয় করতে সক্ষম হন ম্যাক্রোঁ।
তার রাজনৈতিক দল এন মার্চি গঠনই হল গত সেপ্টেম্বরে, আর এসময়ের মধ্যেই নতুন এ রাজনৈতিক দলটির সদস্য ছাড়িয়ে গেছে ২ লাখ। দলটির সমাবেশে উপচে পড়া সমর্থকদের সোল্লাস লক্ষ্য করার মত। ম্যাক্রনর পেছনে তাই ফ্রান্সের সমাজবাদী ও রিপাবলিকানদের যথেষ্ট সমর্থন শেষ পর্যন্ত তাকে এলিসি প্রাসাদে ধাবিত করেছে। নির্বাচনী প্রচারণা শেষ তবে আসল কাজ মাত্র শুরু। ম্যাক্রোঁ সেদিকে লক্ষ্য রেখে নিজেই বলেছেন, ‘এ নিউ পেজ অব আওর হিস্টরি হ্যাস বিন টার্নড’, হ্যা ফ্রান্সের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করলেন ইমানুয়েল ম্যাক্রন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৭ সকাল ৯:৩৪