বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম
চৌধুরী সাহেবের নীল রক্ত
বছর দুই আগের কথা, আমার স্বম্মন্ধির স্ত্রী একজন পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। নাম রাখা হল কাল্পনিক(আব্দুল বাতেন)চৌধুরী। আমি আমার সহধর্মিনিকে জিজ্ঞাস করলাম চৌধুরীটা কোথা থেকে আসল? তোমার নাম, তোমার ভাই আর বাবার নামেতো চৌধুরী নাই!! এমন কি তোমার ভাইয়েই বড় মেয়েটার নামেও চৌধুরী নাই!! নতুন আমদানি নাকি? সাথে সাথেই উনি আমাকে তার পূর্ব পুরুষের pedigree আর জমিদারির কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমি মেনে নিলাম আর ভাবলাম it’s alright. আমার উনি আমাকে আরো মনে করিয়ে দিলেন যে তার দাদা আসলে নিজে চৌধুরী হয়েও এবং আরেক চৌধুরী পরিবারে বিয়ে করার পড়েও কোন সন্তানের নামেই চৌধুরী রাখেন নাই। নিকট অতীতে তার চাচাগন নিজেদের ও নিজেদের সন্তানদের নামে চৌধুরী কথাটা যুক্ত করেছেন!!! উচ্চ শিক্ষিত এই মানুষ গুলো আসলেই কি সুশিক্ষিত?
আমার দাদা শ্বশুর খুব ভালো মানুষ ছিলেন বলে শুনেছি। বোধ করি উনি সুশিক্ষিত ছিলেন। পূর্ব পুরুষের চৌধুরী নামক কলঙ্ক হয়ত ঝেড়ে ফেলতে চায়ে ছিলেন। যাদের নামের সাথে চৌধুরী টাইটেলটা আছে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু সাথে সাথে এও জানতে চাচ্ছি, আপনারা কি জানেন এই নামের ইতিহাস? আপনাদের এই নাম প্রমান দিচ্ছে আপনাদের পূর্ব পুরুষরা কেউ ছিলেন ধনী কাপুরুষ আর কেউ কেউ ছিলেন তৎকালিন রাজাকার। আবার কেউ কেউ ছিলেন “অয়ময়” নাটকের আবুলহায়ৎ এর মত মাঝি পরিবারের লোক। অর্থৎ ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল পলেসিতে ব্যাবহারিত বস্তু ছিলেন আপনারা। আমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে যারাই পার্ফেক্টলি ওদের গোলামী করেছেন তারাই কেউ হয়েছেন খন্দকার, কেউ হয়েছেন তালুকদার আর কেউ চৌধুরী। যে যত অত্যাচার করতে পেরেছেন মানুষকে বিপদে ফেলতে পেরেছেন, ইংরেজ মালিকরা সেই গোলামদের তত বড় পদ দিয়েছেন। এই খন্দকার আর তালুকদারদের কেউ কেউই ছিলেন কুমার বা চর্মকার বা মাঝি!!! এই পাশা উল্টানো ইতিহাস স্কুল পাস করা সবাই জানেন। তারপরও কিভাবে এই যুগে এই নাম নিয়ে নীল রক্তের বড়াই??
আমার মামী শ্বাশুরী তার বড় সন্তানের বিয়ে দিলেন কয়েক দিন আগে। এই বিয়ের কয়েকদিন আগে আমার সত্যি মনে হচ্ছিল, আমার ঐ শালাটার কোন এক চৌধুরী পরিবারের “কোন এক কুকুরীর” সাথে বিয়ে হবার সম্ভাবনা আছে, যাই হোক তা হয় নাই!! আমার নিজের সম্মন্ধির স্ত্রী মোটামুটি একক ভাবে উনিই পছন্দ করেছেন, আমার নিজ শ্বাশুরীর মারফতে শোনা কথা এই যে, অন্য আরো উপযুক্ত যোগ্য এবং সুন্দরী পছন্দনীয় কন্যা তার পছন্দ হবার পড়েও ঐ মহিলার ভেটোর কারনে শেষ পর্যন্ত আরেক চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক করা। এই মহিলার(আমার সম্মন্ধির স্ত্রীর) অহংকারও দেখার মত!! কিছুদিন আগে ভাইয়া আর ভাবীকে বললাম সিলেটের এয়ারপোর্ট রোডের আশে পাশে কিছু যায়গা কিনে রাখেন, ভবিষতে মূল্যবান হবে। উনি আমাকে উত্তর দিলেন ওইটা নাকি জেলেদের এলাকা, ওইখানে ভদ্রলোক থাকে না। বড় মানুষ মুখের উপরে কিছু বললাম না, খালি মনে মনে বললাম, ঢাকার ফকিরা পুলেও এখন আর ফকিররা থাকে না আর ধানমন্ডিতেও কেউ ধান ভাঙ্গে না!! আমি ঢাকার ছেলে। সারা বাংলাদেশের কথা জানিনা, তবে শ্বশুর বাড়ির সুবাদে সিলেটি চৌধুরীদের এই জাত্যাভিমানের সঙ্গে আমি পরিচিত। চৌধুরীর সন্তানের নামের শেষে চৌধুরী থাকুক, কোন সমস্যা নাই কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যদি এই নাম নিয়ে কেউ এ্যরিস্টোক্রেসি আসা করেন।
ইউরোপিয়ান রাজ পরিবার গুলোর ইতিহাস আজ অনেকেরই জানা। তারা পারস্পরিক এত যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যেও এক রাজা শুধু মাত্র অন্যকোন রাজার পরিবারেই সম্পর্ক করত। তাদের ভাবনায় ছিল ব্লু ব্লাডের নেশা। তারা ভাবত তাদের রয়েলনেস এবং এর পিউরিটি মেইন্টেইন করতে পারলে, তাদের বংশ পরম্পরায় শারীরীক ও মানষিক সক্ষমতা বাড়বে। তারা চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা ভুল ছিল। এই পিউরিটি মেইন্টেইন করতে করতে তারা তাদের জীন কে দুর্বল করেছে, তৈরি হয়েছে কিছু ইনকিউরেবল জেনেটিক অসুখ। ঠিক ইহুদীদের কিছু গোত্রের যেমন নিজ ব্র্যান্ডের জেনেটিক অসুখ আছে ঠিক তেমন। “চৌধুরী” তারাও তাদের জেনেটিক পিউরিটি চায়। ভাগ্যিস আমাদের চৌধুরীদের ইতিহাস বেশী পুরানো নয়। কিন্তু দিনে দিনে আমাদের সিলেটের চৌধুরীদেরও জীন গত দূর্বলতা আর মানষিক অসুখ বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যাবে। যদি না সময়ে সময়ে আমার মত জেনেটিক রেসকিউয়াররা সিলেটি জিন পুলে না ঢুকে, তো।
আমার দাদিকে, নানাকে আর বড় চাচাকে দেখেছি, আমার মা আর আমার স্ত্রীকে দেখছি, ইনাদের দেখে আমার মনে ক্রমেই মনে হচ্ছে প্রকৃত আভিজাত্য হচ্ছে জ্ঞান, সততা আর সরলতায়। মানুষ যখন আপনাকে বিশ্বাস করবে, আপনার উপরে নির্ভর করবে তখন, আপনার নিজের কোন উচ্চতায় যাবার ইচ্ছা না থাকলেও মানুষ আপনাকে উপরে তুলবে।
আচ্ছা যাইহোক, যেই ব্লু ব্লাড নিয়ে এত কথা, জানেন কি এই ব্লু ব্লাড ফ্রেসটার ইতিহাস? ব্লু ব্লাড শব্দটা ঠিক যেমন কারো কারো মনের অসুস্থতা তৈরি করে, শুনলে অবাক হবেন যে এই শব্দটা একটা অসুস্থতা থেকে ইন্সপায়ার্ড। রূপার ইংরেজি নাম সিলভার আর বৈজ্ঞানিক নাম আর্যেন্টাম। এই আর্যেন্টামের একটা বৈশিষ্ট হল এটি জীবাণু নাশক। এই জ্ঞানটা মানুষ অনেক আগেই অর্জন করেছিল। তাই আগেকার দিনের ধনীরা খাবার ও পানীয় গ্রহনের জন্য রূপার পাত্র ব্যাবহার করত। দীর্ঘ দিন ধরে এই সকল পাত্রে খাবার ও পানীয় গ্রহনের কারনে শরীরে ধিরে ধিরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত রূপা জমে যেত। যা আমাদের শরীর নিষ্কাশন করতে পারতোনা। ফলে আর্যেন্টাম সালফাইড নামক এক যৌগের রূপ নিয়ে রূপা আমাদের চামড়া চোখের পর্দা সহ অন্যান্য অঙ্গে জমা হতে থাকত। এর ফলে চামড়া নীল, নীলচে অথবা নীলাভ ধুসর দেখাত। এই রোগটাকে আর্যেরিয়া বলা হয়। এবং সাধারনত ধনীরা যারা রূপার পাত্র বা পান পাত্র ব্যাবহার করত তাদেরই এই রোগ হত। এবং যেহেতু শারীরীক এই বিকৃতি তাৎক্ষনিক কোন মৃত্যু ঘটাতনা, তাই চামড়ার এই নীলচে বিকৃতিটাই একটা অহংকারের রূপ নিল। আসলে যদিয় চামড়ার বা চোখের পর্দার পরিবর্তন হত, তখন কার মানুষ মনে করত রক্তটাই বুঝি নীল হয়ে গেছে। সেই থেকেই ব্লু ব্লাড।
সৈয়দ বংশে নাকি নবীজীর রক্ত। আমি বিশ্বাস করি না। এই ভাবে কিছু ঘটছে বা ঘটে। এমন বাজে লোক দেখেছি এই নামের যে বিশ্বাস হয় না। এই ধরনের যত আভিজাত্য তৈরি করা হয়েছে, প্রকৃত অর্থে সব মিথ্যা। মানুষের পরিচয় সে নিজে। অন্তত পক্ষে বর্তমান সমাজে বিশ্বাস না করে কি উপায়? তিতাসের গ্যাসচোর যে লাইন ম্যান কোটি কোটি টাকা চুরি করে আজ এম পি , মন্ত্রী হয়ে যায় তার রক্তও অতি শীগ্রই নীল হয়ে যাবে। এই নীল রক্তের আর গোলামীর অহংকার যারা করেন, তারা ভুল করেন। সবাইকে ভুল থেকে বাঁচার আহবান থাকল।
আর নবীজীতো বিদায় হজ্বে বলে গেছেন বংশ গত কারনে কারো উপরে কারো মর্যাদা বেশী নয়। আমরা সবাই তা জানি। আর কুরয়ানো একি কথা বলেঃ
সূরা হুজুরাতঃ আয়াত- ১৩ঃ
(يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ)
কাছাকাছি বাংলা অর্থঃ
(হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। )
আরো অনেক কথা লেখার ছিল বলার ছিল। সময়ের আর ধৈর্যের অভাবে লিখা হয় না। জানিনা আমার মূলকথাটা বুঝাতে পেরেছি কি না। কোন বিশেষ নামের কাউকে ছোট করার জন্য এই লেখা নয়। শুধু এইটুকু বলতে চাই, আমার কোন প্রেজিউডিস নাই। আমার কাছে মানুষ মানেই মানুষ। ক্রমেই আমি বুঝতে পারছি যে মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য মানুষের সাদৃশ্যে বৈসাদৃশ্যে নয়।
আসসালামুয়ালাইকুম। সবাই ভালো থাকুন।