সময় বড় স্মৃতি বিস্মৃত । ভিকারুননিসা নূন স্কুলের উগ্র শিক্ষিকাগণও এক সময় প্রয়োজনীয় প্রভাবশালী লোকজনকে হাত করে নিরাপদে স্বপদে ফিরে আসবেন। আচরণে উগ্রতার ব্যারোমিটার ক্রমশঃ বাড়বে। অরিত্রীরা গুমড়ে কাঁদবে, কাঁদবে মানবতা, কাঁদবে শিক্ষাব্যবস্থা। প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে আরো কতো অরিত্রী বলি হবে ওদের শাণিত নখরের আঘাতে। কতো অরিত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবে, অসুস্থ হবে। দুঃসহ হবে তাদের শৈশব, কৈশোরের শিক্ষাজীবন, ম্লান হবে আনন্দময় নির্ভিক স্বপ্নগুলো। তার হিসেব কে কত রাখবে?
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী। পরিক্ষা কক্ষে মোবাইল ফোন নেবার অপরাধে তাকে বহিস্কারসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে অধ্যক্ষা, উপাধ্যক্ষার, রূঢ় আচরণ, অভিভাবককে অপমান সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি এই কিশোরী। ফলশ্রুতিতে লজ্জা ও চরম অভিমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে। এটা অতি সাম্প্রতিক ঘটনা।
নব্বইএর দশকে তৎকালীন ঢাকা চারুকলা ইন্সটিটিউটে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) এমনই একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল। মাসুদ নামে একজন মেধাবী ছাত্র জলরঙ পেইন্টিংএ তার সুখ্যাতি ছিল। অঙ্কন পাগল এই মাসুদ ছবি আঁকার নেশায় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চষে বেড়াতেন। একারণে একটি বিষয়ে তত্ত্বীয় ক্লাসে তার উপস্থিতির হার কিছুটা কম ছিল, দায়িত্বশীল শিক্ষিকার দাবী শ্রেণি পরীক্ষা নাকি দুএকটা বাদ ছিল। সকল বিষয়ের শিক্ষকদের ছাড় পেলেও এই একজনের কঠোর অবস্থানের কারণে তাকে প্রি ডিগ্রী (উচ্চমাধ্যমিকের সমতূল্য) পরিক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল। কোনভাবেই তিনি টললেন না মাসুদের করুণ আর্তির কাছে। প্রতিভাদীপ্ত মাসুদ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
দুটো ঘটনা প্রায় একই সূত্রের। ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের অনমনীয় রূঢ় আচরণ।
অরিত্রীর ঘটনাটা নিয়ে প্রতিবাদ চলছে। মাসুদের বেলায়ও প্রতিবাদ হয়েছিল। পুরো চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীদের ঘৃনাভরে নিক্ষিপ্ত থুথুয় ভিজেছিল সেই উগ্র শিক্ষিকার বস্ত্র, দেহ। অনেকদিন চারুকলা অঙ্গনে আসতে পারেননি তিনি। তৎকালীন প্রভাবশালী এক শিক্ষকের প্রশ্রয়ে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন পরে এবং অধিকতর দাপুটে হয়ে উঠেছিল তার আচরণ। কোন ছাত্রই তাকে মন থেকে সম্মান করতে পারেনি। তাকে দেখলেই মাসুদের নিথর মরদেহটার কথা মনে ভাসতো। মনে হতো এই খুনী নারী মাসুদের দেহটার উপর দিয়ে উচু জুতায় হনহন করে হাঁটছে। সবাই হিংস্র শ্বাপদের মতোই তাকে ভয় পেতো, ঘৃনা করতো।
ছাত্র-ছাত্রীদের সব দোষই ক্ষমা করে দিতে হবে এমন তো নয়। তাকে যেমন স্নেহ দিতে হবে, তেমনই শাসনও প্রয়োজন। একজন শিক্ষককে সবার আগে ছাত্রের বন্ধু হতে হবে, তার সাথে একাত্ম হয়ে তাকে গড়ে তোলার মন্ত্রণা দিতে হবে। অযথা ভারিক্কী ভাব দেখিয়ে দুরত্ব বজায় রেখে শিক্ষাদানের দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই। যুগ পাল্টেছে, পাল্টেছে শিক্ষা পদ্ধতিও। সময়ের সাথে শিক্ষককেও আপডেট হতে হয়। কিন্তু এখনো কিছু শিক্ষক সেই মান্ধাত্বার অহমবোধ, রূক্ষ আচরণ বজায় রাখেন ছাত্র ও অভিভাবকদের প্রতি। সুযোগ পেলেই ফৌজদারী দিন্ডবিধি প্রয়োগ করতে চান এখানে। এটা অন্যায়। সমাজে সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন পেশা শিক্ষকতা, কতিপয় দুষ্টু লোকের কারণে তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। ভাল শিক্ষকগণ লজ্জা পান এদের কর্মকাণ্ডে।
একজন শিক্ষক, একজন শিক্ষা প্রশাসকের কি গুনাবলী থাকতে হয় সে বিষয়গুলো বিবেচনা না করে তাদের নিয়োগ দিলে একটা দুটো স্কুল শুধু নয়, আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম সত্যিকারের নির্ভিক ও স্বাবলম্বী মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না কখনোই।
আত্মহনন কখনোই ভাল কোন সমাধান হতে পারে না। কঠিন বাস্তবতায় সংগ্রাম করে বাঁচাই শ্রেয়। জীবনের প্রতি মানুষের ভালবাসা গভীর। কোন অবস্থাতেই সে মরতে চায় না, তারপরও কখনো কখনো মৃত্যুর বিভীষিকা তাকে আঁকড়ে ধরে। কোন পরিস্থিতিতে সে এই করুণ মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করে, তা অনুধাবন করতে হবে। যে যায়, সে আর ফিরে আসে না, ফিরে আসবে না অরিত্রী, মাসুদ বা এমন আরো অনেকেই। হয়তো এমন করে আরো কেউ কেউ চলে যাবে। তবে এই অবরুদ্ধকর পরিস্থিতির সমাধান করা প্রয়োজন সময় থাকতেই। আমরা চাই না এধরনের আত্মহননের পুনরাবৃত্তি হোক। চাইনা শাণিত হোক শিক্ষক নামে কোন হিংস্র শ্বাপদের নখর।
(অরিত্রীর মৃত্যু নিয়ে যে কোন রাজনৈতিক খেলা বর্জন করা উচিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:১৮