আযাদের বিরুদ্ধে অপরাধের তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থা
তারিখ: ০৪-০৪-২০১২
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে ফরিদপুরে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। ফরিদপুরের মানুষের কাছে তিনি এখনো খাড়দিয়ার ‘বাচ্চু রাজাকার’ নামে পরিচিত।
রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তদন্তকালে এসব তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংস্থা। গতকাল মঙ্গলবার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। রাষ্ট্রপক্ষ সুষ্ঠু ও কার্যকর তদন্তের স্বার্থে গত ২৫ মার্চ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করে।
আবেদনে রাষ্ট্রপক্ষ বলে, আবুল কালামের সহযোগীদের হুমকিতে ফরিদপুরের স্থানীয় মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছে। একজন সাক্ষীকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ায় তিনি থানায় জিডিও করেছেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে আটক রাখা না হলে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হবে। বক্তব্যের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ সোমবার তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে।
জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সদস্য এম সানাউল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আবুল কালাম প্রভাবশালী হওয়ায় তদন্তে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলে তদন্ত সংস্থা তাঁকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করবে। তদন্তে পাওয়া তথ্য জিজ্ঞাসাবাদে যাচাই করা হবে।
আবুল কালামের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ পর্যায়ে উল্লেখ করে সানাউল হক বলেন, দু-তিন মাসের মধ্যে তদন্ত সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
রাষ্ট্রপক্ষ ও তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান আবুল কালাম আযাদের গ্রামের বাড়িতে আগে একটি ঘর ছিল। এখন সেখানে রয়েছে দুটি পাকা ও দুটি টিনের ঘর। রাজধানীর উত্তরায় তাঁর একটি বহুতল বাড়ি আছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি পাঁচটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) গড়ে তুলেছেন। নিজেই সেগুলো পরিচালনা করেন।
আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: রাষ্ট্রপক্ষের সূত্রগুলো জানায়, আবুল কালাম আযাদ স্থানীয় মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। একাত্তরের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা ফরিদপুরে যায়। উর্দু ভাষার ওপর দক্ষতার কারণে তিনি সহজে তাদের ঘনিষ্ঠ হন। ফরিদপুর স্টেডিয়াম, পুরাতন সার্কিট হাউস, রাজেন্দ্র কলেজ প্রভৃতি স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বর্তমানে কারাগারে আটক জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের সঙ্গে জোট বেঁধে তিনি ফরিদপুরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গড়ে তোলেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেন। তাঁর বিভিন্ন অপরাধে সহযোগিতা করতেন শ্বশুর চান কাজী ও শ্যালক মোহাম্মদ কাজী। তাঁদের সঙ্গে আরও লোকজন নিয়ে তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন।
রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, একাত্তরের ২৭ মে বোয়ালমারীর কলারণ গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায়কে আবুল কালাম গুলি করে হত্যা করেন। ডহরনগর গ্রামের জীবন চক্রবর্তীকে তিনি বটগাছের নিচে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে মারেন। ১০ মে ভোরে তিনি রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে বড়দিয়া গ্রামের বিশ্বাসবাড়িতে হামলা করেন। সেখানে গোপাল বিশ্বাসসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়। একই দিন তিনি হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়া লুট করে ৪০-৫০টি ঘর পুড়িয়ে দেন এবং যোগেশ্বর সাহাসহ নয়জনকে হত্যা করেন। আবুল কালাম এ সময় এক ব্যক্তির হাত-পা বেঁধে আগুনে ছুড়ে মারলে তিনি জীবন্ত দগ্ধ হন। ময়েনদিয়া বাজারের হরিপদ সাহা ও পুটিয়াকেও তিনি গুলি করে হত্যা করেন। ১৬ মে তিনি মোহাম্মদ কাজী ও ১০-১২ জন রাজাকারকে নিয়ে সালথার মন্টু বকসী ও অশ্বিনা মণ্ডলের বাড়ির অর্থ ও স্বর্ণালংকার লুট করেন। একই দিন তিনি পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধব বিশ্বাস ও জ্ঞানেন্দ্রকে গুলি করে হত্যা করেন।
ট্রাইব্যুনালে গ্রেপ্তারের আবেদন উপস্থাপনকালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী বলেছিলেন, আবুল কালাম রাজাকারদের নিয়ে ফরিদপুর পুলিশ লাইনে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ নেন। পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র পেয়ে তিনি ফরিদপুরের জসীমউদ্দীন রোডে হীরালাল মুক্তারের দোতলা বাড়ি দখল করে রাজাকারদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র, চকবাজারের একটি দোতলা বাড়ি দখল করে নির্যাতনকক্ষ ও রাজাকারদের কার্যালয় স্থাপন করেন।
রাষ্ট্রপক্ষ আরও জানায়, ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদনে আবুল কালামের মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও অনেক ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্তে এসব অভিযোগের পক্ষে অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। একাত্তরের ৮ জুন আবুল কালাম, মুন্সি রাজাকারসহ ১৪-১৫ জন হিন্দুপাড়ার দুই নারীকে ধর্ষণ করেন। তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের আরও ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রাষ্ট্রপক্ষ ও তদন্ত সংস্থার সূত্র জানায়, আবুল কালামের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় মধুখালী, কামারখালী, নগরকান্দা, ডোমাইন, বোয়ালমারীসহ অনেক জায়গায় পাকিস্তানি সেনারা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। সালথা থানার জয়কালী, যোগারদিয়া, উজিরপুর, শ্রীফলতলী গ্রামে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। এসব ঘটনার তথ্য সংগ্রহের জন্য তদন্ত সংস্থা ফরিদপুরের ১২টি বধ্যভূমি পরিদর্শন করে সাক্ষ্য নিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ১০:৪৬