সমকাল (১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭)
জামায়াতের গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে
সমকাল প্রতিবেদক
'খুনকার' থেকে 'অৎকা সৈয়দ' :
পরিচিত ছিলেন খন্দকার তাহের হিসেবেই। এখন তিনি সৈয়দ তাহের। গ্রামের মানুষ তাকে ডাকে 'অৎকা সৈয়দ'। বাবার ছিল তাবিজ-কবজের ব্যবসা। লোকে 'খুনকার' (খন্দকার) বলত। পাঁচ ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় তাহের ২০০১ সালে চারদলীয় জোটের সুবাদে চৌদ্দগ্রাম আসনের (কুমিল্লা-১২) সাংসদ হয়ে যান। অভিযোগ আছে, নির্বাচনের দিন সবক'টি কেন্দ্র দখলে নিয়ে জয় নিশ্চিত করেন। এরপর চৌদ্দগ্রামকে 'আওয়ামী লীগমুক্ত' করতে কাছা মেরে নামেন। সেই থেকে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের অভয়ারন্যে পরিণত হয় চৌদ্দগ্রাম।
উপজেলার রক্তঝরা ইউনিয়ন আলকরার পশ্চিম ডেকরা গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে তাহেরের জন্ম। নিজ ইউনিয়নে তার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার পবরাউ এক এক করে পাঁচটি হত্যাকা- ঘটে। এর পর আলকরার পার্শ্বার্বতী গুণবতী আর জগন্নাথদীঘির একাংশ পরিণত হয় তাহেরের সাম্রাজ্যে। দরিদ্র পরিবারের তাহের বনে যান গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল মিলের মালিক। আছে আদম ব্যবসা। কুমিল্লার বেসরকারি সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তিনি হন চেয়ারম্যান। নারায়ণগঞ্জে হায়দরি টেক্সটাইল মিলস ও গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন তার তিন ভাই সাদেক, হারুন ও সরোয়ার।
১৯৯১ সালেই তিনি চৌদ্দগ্রামের আসনটি করায়ত্ত করতে প্রতি্টন্ি্টতা শুরু করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। ১৯৯৬-এ আওয়ামী লীগের মুজিবুল হকের কাছে হেরে যান। এরপরই শুরু করেন সন্ত্রাসী লালন। তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে খুন হন আলকরা ইউনিয়নের কুলাসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা জসীম (২৫), একই ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের যুবলীগ কর্মী আনোয়ার (৩০), ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর (২২), সোনাইছা গ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী আবুল (৪০) ও কুলাসার গ্রামের ছাত্রলীগ নেতা বাদল (২৫)। কুপিয়ে হত্যা করা হয় গুণবতী ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা হাজী আবদুল মালেককে (৬০)। সম্প্রতি জোট সরকারের ক্ষমতার শেষ সময়ে চিওড়া ইউনিয়নের শাকতলা গ্রামের যুবলীগ নেতা হেদায়েত উল্লাহকে (৩৪) অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এটা জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের কাজ বলেই অভিযোগ করা হয়েছে।
তাহেরের সন্ত্রাসে পঙ্গু হয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। বোমার আঘাতে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লক্ষ্মীপুরের যুবলীগ কর্মী হেলানের (২৮) ডান পা ও একই গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী মোহাম্মদ আলীর পা। কুলসার গ্রামের ছাত্রলীগ কর্মী জানু (৩০) এখন অন্দ। তাহেরের বাহিনীর বীভৎসতার ইতিহাস ও সংখ্যা বেশ দীর্ঘ।
২০০১-এর নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন তাহের। তাই কৌশল হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ সহস্রাধিক ক্যাডারকে আনা হয় চৌদ্দগ্রামে। রাখা হয় সমর্থকদের বাড়িতে। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলো পরিণত হয় ওইসব ক্যাডারের আস্তানায়। গ্রামবাসীকে বলে দেওয়া হয় ওরা সবাই 'মেহমান'। ভোটারদের জানিয়ে দেওয়া হয় ভোটকেন্দ্রে না যেতে। কারণ এবার ভোট দেবে মেহমানরা। নির্বাচনে জয়লাভের পর এলাকাবাসী বলতে শুরু করেন 'মেহমানের এমপি'।
নবম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একই কায়দায় জিততে এবারো মেহমানদের আনা হয়েছিল। কিন্তু দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরদিন দ্রুত পালিয়ে যায় মেহমানরা।
২০০১-এর নির্বাচনে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরে নির্বাচনী কাজে অংশ নিয়েছিল ওইসব ক্যাডার। সে সময় কাশীনগরে সেনা পোশাক পরা এক ক্যাডার আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে বোমাসহ ধরা পড়ে। উত্তেজিত জনতা তাকে পুলিশে তুলে দিলেও ক'দিন পরই সে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়।
২০০১-এর নির্বাচনে জয়লাভ তাহেরকে অপ্রতি্দ্বন্দী করে তোলে। শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিধন ও বিএনপি তাড়াও অভিযান, টেন্ডার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও জমি দখল। তার ছোট ভাই সৈয়দ একরামুল হক হারুন চৌদ্দগ্রামের 'ছোট সাহেবে' পরিণত হন। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা হয় ক্যাডার বাহিনী। এ চত্রেক্রর অপর দুই সদস্য ছিলেন মেশকাতউদ্দিন সেলিম ও উপজেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহজাহান। তাদের নেতৃত্বে প্রতিটি ইউনিয়নে ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এ বাহিনীর অন্যরা হলেন বাচ্চু মেম্বার, হামিদা চোরা, রাসেল, রিপন, মমিন, মামুন, অলি আহম্মদ, আবু সায়েদ, আঃ আজিজ, বেলাল, জামাল, মহিন ডাইক, মোবারক, মিঠু ওরফে মিঠাইয়া চোরা, হানিফ, বাহার প্রমুখ।
উপজেলার কালুজুড়ি খালের ৩০ হেক্টর এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের লিজ পেয়েছিলেন মেসার্স এমআর এন্টারপ্রাইজের মিজানুর রহমান। তাহেরের ক্যাডার গাজী আবু বকর, ইকবাল হোসেন কাজল, জাফর ইকবাল লিটন, খোকন ও জহির ঠিকাদারকে মারধর করে থানায় সোপর্দ করে এবং বালুমহালটি দখল করে রাখে। তার নিদরাউশে উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপুর মৌজার দীঘিটি ২০০১ সালের ১১ অক্টোবর অবৈধভাবে দখল করে নেয় জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। ওই দখল অভিযানে নেতৃত্ব দেয় জামায়াত ক্যাডার শাহাবউদ্দিন ও নূর ইসলাম। দীঘিটি জবরদখলের পর কুমিল্লা সার্কিট হাউসে এক সভায় সাবেক সাংসদ তাহের বলেছিলেন, 'এখন থেকে আমি না বললে চৌদ্দগ্রামে কোনো পাতা নড়বে না।'
উপজেলার বাতিসা গ্রামের অসহায় মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন ১৫ বছর ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোবিন্দমানিক্য দীঘি লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে আসছিলেন। পরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা লিজ নিয়ে একটি অস্থায়ী খাবার হোটেল খোলেন। জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই দীঘিটি দখল নিয়ে নেয় তাহেরের ক্যাডাররা। হোটেলটি দখল করার পর উল্লাসে মেতে রান্না করা খাবার রাস্তায় ছিটিয়ে আনন্দ করেছিল ক্যাডার বাহিনী।
শুধু তাই নয়, ১৯৫২ সালের দীঘির চন্দ্র নাগের দান করা বিদ্যালয়ের ৮ শতক জায়গাও জবরদখল করেন এ সাবেক সাংসদ। দখল করা জায়গায় প্রতিষ্ঠা করেন 'ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ সংস্থা'। চৌদ্দগ্রামের ঐতিহাসিক জগন্নাথ দীঘিও জবরদখল করে ভোগ করেন ওই সাবেক সাংসদ ও তার ক্যাডার বাহিনী।
২০০৩-এর ২৯ অক্টোবর জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা পল্লী বিদু্যতের ডিজিএমকে প্রকাশ্যে মারধর করে। এলাকার ডাকাত ও সড়ক ডাকাতরাও জোট সরকার আমলে জামায়াত-শিবির করেছে। চোরাকারবারিরাও তার দলে নাম লিখিয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লালবাগ থেকে মোহাম্মদ আলী বাজার পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সীমান্তর্বতী মহাসড়কে চোরাকারবারি ও সড়ক ডাকাতির মূল নেতা তাহেরের ছোট ভাই হারুন ওরফে ছোট সাহেব।