রক্তচাপ বা blood pressure হচ্ছে রক্ত কতৃক ধমনীর বা আর্টারীর গায়ে প্রয়োগকৃত চাপ। এই চাপকে দুটি টার্মের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়; ১. সিসটোলিক রক্তচাপ (হৃৎপিন্ড বা heart সংকোচনের সময় ধমনীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে রক্ত ধমনীর গায়ে যে চাপ প্রয়োগ করে), ২. ডায়াসটোলিক রক্তচাপ (প্রতিবার সংকোচনের পর হৃৎপিন্ড আবার প্রসারিত হয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার সময় ধমনীর দেয়ালে প্রয়োগকৃত চাপ)।
যারা ডাক্তার দেখিয়েছেন বা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখেছেন তারা ১২০/৮০ mmHg (millimeters of mercury) জাতীয় লেখা দেখে থাকবেন। উল্লেখ্য এখানে প্রথম সংখ্যাটি সিসটোলিক ও দ্বিতীয় সংখ্যাটি ডায়াসটোলিক প্রেসার নির্দেশ করে। হৃৎপিন্ডের সংকোচনের সময় রক্তচাপ সবসময় বেশি থাকে অর্থাৎ সিসটোলিক প্রেসার সর্বদাই ডায়াসটোলিক প্রেসার অপেক্ষা বেশি।
স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ mmHg, কিন্তু বিভিন্ন সময় এই চাপ বেড়ে যেতে পারে, যেমনঃ শারীরিক পরিশ্রম, উত্তেজনা, দুঃশ্চিন্তা। এই পর্যায়গুলো কেটে গেলে সাধারণত ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসে। কিন্তু যদি তা না আসে এবং বর্ধিত রক্তচাপ পারসিস্ট করে তবে বুঝতে হবে আপনি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে ভুগছেন।
স্বাভাবিক রক্তচাপঃ ১২০/৮০ mmHg এর কম।
প্রিহাইপারটেনশনঃ ১২০/৮০ mmHg থেকে বেশি ১৪০/৯০ এর কম।
উচ্চ রক্তচাপঃ ১৪০/৯০ এর বেশি।
কারণঃ
মজার ব্যাপার হচ্ছে ৯০-৯৫% রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণ জানা যায়না। একে বলা হয় প্রাথমিক বা এসেনশিয়াল উচ্চ রক্তচাপ।
আর যে কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে এথেরোস্কেলোরোসিস বা রক্তনালীর ভেতরে চর্বি জমে যাওয়া, কিডনীর বিভিন্ন রোগ, এড্রেনাল গ্রন্থি টিউমার, করটিসন (স্টেরয়েড জাতীয় এক প্রকার ঔষধ) ও গর্ভনিরোধক ঔষধ দীর্ঘদিন যাবত ব্যবহার অন্যতম।
কিছু ফ্যাক্টসঃ
* উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ ও স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
* যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে হৃদরোগের আশংকা সাধারণ রক্তচাপ বিশিষ্ট লোকের চেয়ে দ্বিগুন বা তিনগুন বেশি। স্ট্রোকের আশংকা তিনগুন বেশি থাকে।
* শারীরিক ওজনের সাথে উচ্চ রক্তচাপের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
* সোডিয়াম অতিরিক্ত গ্রহণের ফলে অনেকের রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
(শরীরের চাহিদা পূরণের জন্য দৈনিক ৫০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম দরকার। কিন্তু বিভিন্ন খাবারের সাথে আমরা নিয়মিত প্রায় ১০ থেকে ২০ গুন বেশি সোডিয়াম খেয়ে থাকি। এক চা চামচ পরিমান লবনে ২৩০০ মিঃ গ্রাম সোডিয়াম থাকে। দিনে ৫০০০ মিঃ গ্রামের বেশি লবন খাওয়া উচিত নয়। যাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাদের অতিরিক্ত লবনযুক্ত খাবার না খওয়াই ভাল।)
** নিচের খাবার গুলোতে অতিরিক্ত লবন বা সোডিয়াম থাকে তাই এগুলো পরিহার করুনঃ
@ পনির
@ টমেটো সস্
@ যেকোন ধরণের টিনজাত খাবার
@ মাখন
@ সব ধরণের মাংস ও মাংসজাত খাদ্য
@ বেকারীজাত খাবার (কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট, পাউরুটি, চিপস্, ক্র্যাকার্স ইত্যাদি)
@ সামুদ্রিক খাবার (প্রানীজ বা উদ্ভিজ্ব)
** নিচে একটি কম সোডিয়ামযুক্ত পথ্যতালিকা দেয়া হল যা উচ্চ রক্তচাপ বিশিষ্ট রোগীদের কাজে লাগতে পারেঃ
------------------------------------------------------------------------------
টোটাল ক্যালোরীঃ ১০০০, সোডিয়ামের মাত্রাঃ ৪০০০ মিঃ গ্রাম (প্রায়)
------------------------------------------------------------------------------
সকালের নাস্তাঃ
--------------------------------------------------
আটার রুটি (২টা, ছোট সাইজের)
ডিম ভাজি (কুসুম ছাড়া, ১টা)
ফল (আনারস, পেয়ারা, জাম্বুরা ইত্যাদি- যেকোন ১টি)
বি.দ্র. কলা খাওয়া নিষেধ
বেলা ১১টায়
--------------------------------------------------
ছোট ফল যেকোন একটা
দুপুরে
--------------------------------------------------
ভাত (১ কাপ পরিমান)
মাছ বা মুরগীর মাংস (ছোট ২ টুকরা)
সালাদ (প্রচুর পরিমানে)
পাতলা করে রান্না ডাল (১ কাপ)
রান্না সব্জি (১ কাপ)
বি.দ্র. আলু খাবেন না
বিকালেঃ
-------------------------------------------------
২৫০ মিলিলিটার দুধ
রাতেঃ
-------------------------------------------------
আটার রুটি (২টা, ছোট সাইজের)
মাছ বা মুরগীর মাংস (ছোট ২ টুকরা)
সালাদ (প্রচুর পরিমানে)
রান্না করা সব্জি (১ কাপ)
রান্নার ক্ষেত্রে ৩ চা চামচের বেশি ভোজ্যতেল ব্যবহার করা উচিত নয়।
# ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার, যেমনঃ ননি ছাড়া দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার খেতে পারেন।
# সুপারী, শুকনো সিমের বিচি, শালগম, শষ্য জাতীয় খাবার, গাঢ় সবুজ শাক সব্জিতে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম থাকে। ম্যাগনেশিয়াম যুক্ত খাবার গ্রহন করুন।
# প্রানিজ চর্বি খাবেন না।
# আঁশ জাতীয় খাবার বেশি খাবেন, যেমনঃ গম, ভুট্টা।
** জীবন-যাপন প্রনালীতে পরিবর্তন আনুনঃ
১. নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
২. ধুমপান বর্জন করুন।
৩. পান খাওয়ার অভ্যাস থাকলে জর্দা, খয়ের, সাদা পাতা, দোক্তা এড়িয়ে চলুন।
৪. কফি খাবেননা।
৫. মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে ত্যাগ করুন।
৬. দুই বছরের অধিক করটিসোন এবং জন্ম নিরোধক ঔষধ সেবন করবেন না, প্রয়োজনে জন্ম বিরতিকরণের অন্য উপায় অবলম্বন করুন।
৭. নিজেকে হাসিখুশি রাখুন, বন্ধুদের সাথে সময় কাটান।
৮. ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকলে নিয়মিত চেকআপ করান ও চিকিৎসা গ্রহন করুন।
৯. আবেগ, উত্তেজনা, দুঃশ্চিন্তা পরিহার করুন।
১০. সুষম খাদ্য গ্রহন করুন।
যেকোন স্বাস্থ্য সমস্যায় ডাক্তার দেখান, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ খাবেননা।
********************************************************************
প্রবন্ধটি রচনায় বিশেষ করে ডাঃ শাহ মোঃ কেরামত আলী রচিত হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার গ্রন্থটির সহায়তা নেয়া হয়েছে।