বদিউর রহমান,(সিএইচটিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম):- দেশপ্রেম নিয়ে সংজ্ঞার হয়তো শেষ নেই। সলিমুদ্দি-কলিমুদ্দিরাও যার যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ স্বার্থে দেশপ্রেমের সংজ্ঞা দিয়ে যেতে পারেন। সময় এবং পারিপার্শ্বিকতার পরীক্ষায় হাজারও সংজ্ঞা বিলীন হয়ে যাবে, যায়ও। কিন্তু ক্ষমতার বলয়ে থাকাকালীন কারও কারও দেয়া সংজ্ঞা সাময়িকভাবে চাটুকারদের প্রচার-প্রচারণায় তাদের মেয়াদে কিছুদিন হয়তো বহাল থেকে যায়। আমার বাল্যবন্ধু মরহুম আদর তার থেকে বেশি দেশপ্রেম নেই বলে বলত। তার যুক্তি ছিল, সে যে পয়সা নিয়ে হলেও শীতকালে বাড়ি বাড়ি মোয়া পৌঁছে দেয় এটা ক’জন পারে? তার যুক্তি কি উড়িয়ে দেয়া যাবে? আমাদের প্রিয় মরহুম নাদু কাকা যে অন্য মজুরের ঘুম থেকে ওঠার আগেই ঘণ্টা খানেক বেশি কাজ করে ফেলতেন সেটা কি তার অগাধ দেশপ্রেমে পড়বে না? ভোটে না দাঁড়ালে, রাজনীতির গলাবাজি না করলে যে দেশপ্রেমিক হওয়া যাবে না তা তো নয়। তবে সেসব দেশপ্রেমিকের কিন্তু প্রচলিত অর্থে স্বীকৃতি নেই। বেচারা মুটে-মজুর-কৃষক-শ্রমিকের সব কাজই বিবেচিত হবে তাদের ক্ষুধার জ্বালায়, পেটের তাড়নায় বাধ্য হয়ে করা হিসেবে, দেশপ্রেম হিসেবে নয়। কেবল খালেদা-হাসিনা-মির্জা-আবুলদের কাজগুলোই হবে দেশপ্রেম, নাকি?
শেখ হাসিনার দেশপ্রেম নিয়ে আমার কখনও প্রশ্ন নেই, অবশ্যই তার দেশপ্রেম আছে। আর তিনি যখন নিজেই নিজের দেশপ্রেম নিয়ে নিজকে সার্টিফিকেট দেন যে তার চেয়ে দেশপ্রেম আর কারও বেশি নেই তখন তো তা আর না মেনে পারাই যায় না। কেননা তিনি একাধারে বঙ্গবন্ধুর কন্যা, তিনি প্রধানমন্ত্রী, তিনি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলÑ বঙ্গবন্ধুর দল, স্বাধীনতা আনয়নকারী দল আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাও সেই যে শুরু তার আর শেষ নেই, তারপর আবার তিনি জননেত্রী, হালে আবার চাটুকারদের ভাষায় দেশরতœ, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু কন্যা বলতে গিয়ে ভুলে বঙ্গকন্যা লিখে ফিললেও তিনি হয়ে যান বঙ্গকন্যা। অতএব তিনি যদি তার থেকে বেশি দেশপ্রেম আর কারও নেই বলেন তা তো অসত্য হতে পারে না! আমার মনে পড়ে যায়, এনালগ বক্তব্য ডিজিটাল হলে যা হয় আর কি, আপনাকে বড় বলে বড় সেই হয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই নয়। ঢোল নিজেরটা নিজেই বাজাতে হবে, অন্যেরা যদি আবার ফাটিয়ে ফেলে! এটা দোষের কিছু নয়, উদ্যোগী হতে হয়, ইনিসিয়েটিভ থাকতে হয়। নিজে অগ্রণী হলে তো অন্যেরা তা বলবে, এগিয়ে আসবে। আজ কেন যে সহকর্মী সিরাজের (চাঁদ সিরাজ) কথা মনে পড়ছে। আমাদের সঙ্গে দু’জন সিরাজুল ইসলাম ছিল, চেনার সুবিধার জন্য চাঁদপুরের সিরাজকে চাঁদ সিরাজ আর লক্ষ্মীপুরের সিরাজকে লক্ষ্মী সিরাজ নামে ডাকা হতো। চাঁদ সিরাজ প্রথমবার সরকারি টিমে অল্প বয়সে হজ করে আসার পর পাড়া-পড়শিরা, সহকর্মী-আত্মীয়-স্বজনরা তাকে হাজী বা আলহাজ বলছে না দেখে সে নাকি আরেকজন হাজীর সঙ্গে বুদ্ধি আঁটলো। মসজিদ থেকে বের হলে, বাজারে-জমায়েতে দেখা হলে, অফিসে-মিটিংয়ে সাক্ষাৎ হলে একে অপরকে হাজী সাহেব নামে সম্বোধন করবে। পরে নাকি কাজও হয়েছে, দেখাদেখি-শোনাশুনি অন্যেরাও পরে তাদের হাজী সাহেব বলেছে। কী যে বুদ্ধি, কী মোক্ষম ফলদায়ক ইনিসিয়েটিভ। বলেছিলাম, সিরাজ, একটু পয়সা খরচ করে কিছু চাটুকার রাখলে কি আরও দ্রুত হাজী সাহেব হওয়া যেত না। আমি একজনকে চিনি, তার নামই হয়ে গেছে হাজী সাহেব। শেখ হাসিনা যদি তার চাটুকারদের দ্বারা এ মেয়াদে বঙ্গরত্ম, দেশরত্ন, বঙ্গকন্যা এসব হতে না পারেন তবে ভবিষ্যতে কিন্তু তার হতে কষ্ট হতে পারে। এরশাদ বঙ্গবন্ধুর আদলে পল্লীবন্ধু হতে কম চেষ্টা করেননি, কিন্তু পারেননি। বঙ্গবীর ওসমানী আর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কতটুকু বঙ্গবীর হতে পেরেছেন তা বুঝতে আরও হয়তো সময় লাগবে। তবে একজন বঙ্গবীর যে ‘অসমাপ্ত সেতুবীর’ হতে পেরেছেন তা বোধহয় আমরা জেনেছি। অতএব শেখ হাসিনার গত মেয়াদের ডক্টরেট থেকে এ মেয়াদে অনেক-খেতাবি হওয়ার বিষয়টি সময়ে নির্ণীত হবে, এখনকার চাটুকারদের পোস্টার-ব্যানার আর শ্লোগানে নয়। তেমনি তার দেশপ্রেমের নিজের সার্টিফিকেটও সময়ে প্রমাণিত হবে, এখন ক্ষমতায় থাকার সময়ে নয়।
আগে শেখ হাসিনার দেশপ্রেম নিয়ে আমার একরকমের ভাবনা ছিল। সাহসের সঙ্গে মাইনাস পদ্ধতি ঠেকিয়ে দিয়ে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসার ঘটনা আমাদেরও সাহসী করেছিল। অনেকে তখন বাবার সঙ্গে মেয়েকে তুলনাও করেছিল বাপকা বেটি। শেখ হাসিনাকে অনেকে অনেক সময়ে প্রত্যাশার আঙ্গিকে তার বাবার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চান, এতে শেখ হাসিনারও দুঃখ হয় হয়তো। কারণ বঙ্গবন্ধুর উচ্চতায় তাকে প্রত্যাশা করা যেমন সম্ভব নয়, তা সঙ্গতও নয়। তারপরও মাঝে মাঝে তার মধ্যে আমরা তেমন ঝলকানি দেখি, আমরা আরও আশাবাদী হই, আমরা সাহসে বুক বাঁধি। তখন আমাদের মধ্যে তার দেশপ্রেম নিয়ে যেন আর খাদ থাকে না। কিন্তু তার কিছু কিছু বক্তব্যে, মন্তব্যে, লাগামছাড়া অপরিশীলিত আবেগপূর্ণ উক্তিতে আমরা যেন আবার ধপাস করে পড়ে যাই। তখন অনেক উচ্চতা থেকে বিমানের হঠাৎ নেমে যাওয়ার মতোই আমাদের বুকের ভেতরটা ধপাস করে ওঠে। পার্থক্য হল, বিমান মেঘের বা ঝড়ের বেড়াজাল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তেমন করে থাকে, আর হাসিনা যেন বিনা কারণে, অযাচিতভাবে, তুচ্ছ গোঁ বা আবেগজনিত অরাষ্ট্রনায়কোচিত আমেজেই তা করে ফেলেন। তাতে ফল হয় কী? আমজনতার কাছে, তার প্রকৃত হিতাকাক্সক্ষীদের কাছে, অবশ্যই চাটুকারদের কাছে নয়, ফল হয় ‘শত মণ দুগ্ধ নষ্ট বিন্দু গোচনায়’। ছোট মানুষ হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হিসেবে তার কন্যা, তদুপরি দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে, অন্তত জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তির ধারক হিসেবে কোন কটু কথা বলা অনেক সময়ে অসৌজন্যমূলকও মনে হয়। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা, মির্জা ফখরুলরা না হয় যাচ্ছে তাই বলতে পারেন, আমরা আমজনতা তা যেন পারি না। আমাদের কষ্ট হয়। কিন্তু আমরা কী করব? শেখ হাসিনা খোদ নিজেই যখন আমাদের কটু কথা বলতে সুড়সুড়ি দিতে থাকেন তখন আমরা নালায়েকরা আর কতক্ষণ সভ্যতা-ভব্যতা মেনে সহনশীল থাকতে পারি? তখন আমাদের বাধ্য হয়েই বলতে হয় তৃতীয় সারির কোন নেতার মুখে মানালেও, তার মুখে অনেক কিছু মানায় না তা তাদের শত্রু ভাবাপন্ন বিবেচিত ড. ইউনূস সম্পর্কেই হোক, আর মিত্রভাবাপন্ন আবুল সম্পর্কেই হোক। শত্রু ভাবাপন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধেই হোক আর মিত্রভাবাপন্ন ব্যক্তির পক্ষেই হোক শেখ হাসিনার বক্তব্য হওয়া উচিত উদার, পরিশীলিত, মার্জিত এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত সম্ভব না হলেও নিদেনপক্ষে প্রধানমন্ত্রীসুলভ। কিন্তু আমরা তার লক্ষণ প্রায়ই দেখি না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কটু কথা বলতে হয় শেখ হাসিনার বাচন কি আরও সংযত করা যায় না?
প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব বাচনভঙ্গি, স্বভাব এবং রীতি বা স্টাইল রয়েছে, থাকেও। একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর নাকি তা আর বদলানো সম্ভব হয় না, ইনকরিজিবল পর্যায়ে এসে যায়। দু’দুমেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্বের পর, তিন দশকের অধিক একটি বড় দলের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী নেতা থাকার পর আমাদের ‘প্রিয়’ নেতা শেখ হাসিনারও হয়তো ইনকরিজিবল স্টাইল থেকে আর রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু তারপরও একটা মাত্রা থাকা প্রত্যাশিত। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল নিয়ে তিনি দেশপ্রেমের যে আশাজাগরুক বক্তব্য দিয়েছেন, যে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সবই প্রশংসনীয়। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ (এখনও কথিত) বিশ্বব্যাংক এনেছে, তার বিরুদ্ধে তার অবস্থানের বিপরীতে একজন আবুলের দেশপ্রেম নিয়ে এবার লন্ডনে তিনি যে সাফাই গাইলেন তা এককথায় ন্যক্কারজনক বললেও বোধহয় কম বলা হবে। আমরা বুঝতে পারি না আবুলকে নিয়ে তার ‘দুর্বলতা’ কোথায়, বাবু সুরঞ্জিতের কথা না হয় বাদই দিলাম। শেখ হাসিনার দেয়া আবুলের দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট থেকে খোদ শেখ হাসিনার দেশপ্রেমের সংজ্ঞা নিয়েই আমরা দ্বিধাগ্রস্ত। তাই আজ মনে বড় কষ্টসহ প্রশ্ন জাগে, শেখ হাসিনা আর কত নামবেন? লেখক: সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।
লিংক:: এখান থেকে পাওয়া