একদম ছোটবেলা থেকে কারণে-অকারনে কান্নাকাটি করার স্বভাব ছিলো। তাও আবার শব্দ না করে ,চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ঠিকই মুখ শক্ত করে চেপে বসে থাকি....যাতে কান্নার আওয়াজ কেউ না শুনে। এভাবে কান্নার ফলে পরে একটাই সমস্যা হতো ,সেটা হলো পরে হেঁচকি উঠে যেত। এরপরে কান্নাকাটি বাদ হেঁচকি কিভাবে বন্ধ হবে সেটার চিন্তায় শেষ। আগে মারামারি করলে বড়ভাইকে সবসময় দেখেছি হাউমাউ করে কাঁদে আর ছোট প্রাণপণ চেষ্টা করত কান্নার শব্দ যাতে না হয় ....তারপর ও বেচারা ক্ষীণস্বরে চি চি নয়তো পো পো শব্দ করে কাঁদতো। এমন করার জন্য কতবার যে ঐ সময় ছোটকে আবারো কষে চড় লাগিয়ে বলতাম "চিচি শব্দ করবানা"। ভাইরা বরাবরই এটা বলে ক্ষেপাতো যে ঐসময় নাকি নাক ফুলিয়ে কান্না করতাম বলে মোটা নাক ফুলতে ফুলতে পাহাড় সাইজের দেখাতো... .. .।
বড় হবার পর ও স্বভাবটা গেল না। প্রথমবার যেদিন স্কুলে গেলাম,এস.এস.সি দিলাম কিংবা জবে জয়েন করলাম....সবটাই শুরু করেছি কান্না দিয়ে। এখনকার বাচ্চারা কত সুন্দর করে স্কুলে যায়। অথচ আমার মা প্রথম একটা মাস বাড়ীর কাজ বাদ দিয়ে স্কুলে আমার সাথে দুই ঘন্টা বসে থাকতো। ক্লাশ করতাম আর একটু পর পর পিছন ফিরে দেখতাম মা আছে নাকি। বাড়ীর কাছেই একটা মিশনারী স্কুলে কেজিতে ভর্তি হয়েছিলাম, সেখানে ব্যাগ,খাতা,পেন্সিল যাবতীয় সবকিছু তো দিতোই আবার ছুটির সময় প্রায়ই বিস্কুট নয়তো চামচে করে গুড়ো দুধ দিতো টিফিন হিসেবে। এসবের কথা বলে মা স্কুলে নিয়ে যেত।কয়েকমাস যাবার পর মা ভাবলো আর কান্নাকাটি করবো না ভেবে বাবাকে দিয়ে স্কুলে পাঠালো.. স্কুলের কাছে এসে বাবা ভাবলো আর বোধহয় ভয় নেই মনে করে চলে গেল। ক্লাশে বসেই দেখি বাবা নেই। সাথে সাথে ব্যাগ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার পিছনে পিছনে আবার বাড়ী চলে এসেছি।ক্লাশ ফাইভে থাকতে যখন জীবনে প্রথমবারের মতন কোন সাবজেক্টে ডাবল জিরো পেলাম। গার্জিয়ান ডেকে নিয়ে ক্লাশ টিচার কত যে বকা দিলো।সবার সামনে দাড়িয়ে চুপচাপ কাঁদছি......মা একটু ও বকা দেয়নি কারণ মা জানে পরে আমার হেঁচকি থামতে পারবে না। এরপর ক্লাশ ফাইভে সরকারী বৃত্তি পরীক্ষার সিট আরেক স্কুলে পড়লো। হলে ঢোকার আগে বাবাকে বার বার বলছি"বাবা,তুমি কিন্তু এই গাছতলা থেকে নড়বানা"। যে রুমে বসে পরীক্ষা লিখবো সেখান থেকে ঐ গাছতলা স্পষ্ট দেখা যায়। পরীক্ষার মাঝে মাঝে হুট করে বার বার উঠে চেক করি বাবা আছে কিনা? প্রথমবার ক্লাস সিক্সে উঠে যখন মিশনারী হোষ্টেলে দেওয়া হলো। খুব খুশী মনে গেলাম মনে হলো যেন মামার বাড়ীতে আসছি। বাবা-মা যেই আমাকে হোষ্টেলে দিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে আবার সেই কেজিতে পড়া ছোট বাচ্চার মতন কাঁদছি। আমাদের হোষ্টেলের সামনে একটা ফুলের বাগান ছিলো সেখানে দাঁড়িয়ে মাথানিচু করে দুনিয়া এক করে কাঁদছি.....হোষ্টেলের ইনচার্জ,দিদিরা কত যে হাত ধরে টানাটানি করলো আর নড়াতে পারে না। বার বার মনে হয়েছিলো বাবা-মা নিশ্চয় একটু পরে এসে আমাকে বাসায় নিয়ে যাবে। সেখানেই পাঁচটা বছর কেটেছে। সেই পাঁচ বছরে কান্নাকাটি করার স্বভাবটা বদলে নতুন করে অকারণে বক বক করা আর হাসাহাসি করার অভ্যাস হয়ে গেছে। দেখা গেল হোষ্টেলের ইনচার্জ বকা কিংবা শাস্তি দিলো তাও হাসছি।এস.এস.সি পরীক্ষার দিন ও এত নার্ভাস ছিলাম যে ফাইলে প্রবেশপত্র ছিলো সেটা বাইরে রেখেই হলে বসে আছি...খেয়াল হবার দৌড়ে বাইরে এসে দেখি সেদিন ও বাবা বাইরে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।বাবা বকা দিচ্ছিল কান্না করার স্বভাবটা আর গেল না বলে। কলেজের প্রথমদিন ও অনেক মন খারাপ করে কলেজে গেলাম। কারণ আর্মিদের কলেজে আমি পড়তে চাইনি অথচ সেখানেই যেতে হচ্ছে। ক্লাশে গিয়েই দেখি এত মেয়ে অথচ কাউকে চিনিনা। আবারো কান্না পাচ্ছে বলে মাথানিচু করে এক জায়গাতে বসে আছি,কারো সাথে পরিচিত ও হতে চাচ্ছি না। ফ্রেন্ড মনি সবার আগে এসে কথা বললো। পরের দু'টা বছর ওরা আমাকে অনেক ক্ষেপাতো প্রথমদিনের কথা বলে। মনে বলতো"তুই এভাবে বাচ্চাদের মতন নাক ফুলিয়ে কান্না করলি,অনেক মায়া লেগেছিলো"।আমার বাবা বোধহয় জানতো তার মেয়েটা জীবনে যে কাজটা প্রথমে করবে সেদিনটাই শুরু করবে কান্না দিয়ে....এজন্য সবসময় সাথে থাকতো। ইডেনের এডমিশনের দিন টেনশনে আমি হলরুমই খুঁজে পাচ্ছি না.....একজন বলে অমুক রুমে যাও আরেকজন আবার আরেক বিল্ডিং এ যেতে ।দেড়ঘন্টার পরীক্ষার প্রায় ২০ মিনিটই লাগলো রুম খুঁজে পেতে। সীটে বসে দেখি সবাই লিখছে আমি গাধীর মতন কাঁদছি। যে ম্যাডাম ঐদিন হলে ছিলো উনি পাশে বসে বললো "লিখতে থাকো,সবার পরে তোমার খাতা নিবো".....ভেবেছিলাম টিকবো না,কিভাবে জানি টিকে গেলাম।যেদিন জবে জয়েন করি সেদিন বাবা ঢাকার বাইরে ট্যুরে ছিলো ......একাই গেলাম। বাস থেকে নামার পর আর অফিসের লোকেশন মনে করতে পারছিলাম না। সেদিন বাসা থেকে বের হবার সময় ঠিক করেছি আজ অন্তত যেন আমার কান্না না পায়। অফিসের লোকেশন না পেয়ে আস্তে আস্তে মন খারাপ হচ্ছে।HR এ গিয়ে সাথে আরেক ভাইয়া জয়েন করবে তার জন্য ওয়েট করতে হবে। উনার জন্য প্রায় দেড় ঘন্টা বসে আছি আর প্রাণপণ চেষ্টা করছি চোখের পানি আটকানোর। এরপর আমাকে যখন IT তে পাঠালো আমি দৌড় দিবো নাকি ভাবছি।বাসায় বলে ও গেছি IT ছাড়া অন্য যেকোন ডিভিশনে কাজ করতে রাজী আছি। সেখানে গিয়ে দেখি যে প্রজেক্টে কাজ করবো সেখানে এক ইন্ডিয়ান মেয়ে ছাড়া আর কোন মেয়ে কলিগ নেই। সারাদিন আমি ডেস্ক থেকে নড়িনি এত মন খারাপ হয়েছিলো।তার উপর টয়লেট খুঁজতে গিয়ে আরেক হাস্যকর কাজ করলাম। মেয়েদের টয়লেট কোনটা জানতে চাইলে এক কলিগ শুধু বললো ঐদিকে...আমি বুঝত না পেরে আন্দাজেই গেলাম। টয়লেট থেকে বের হয়েই দেখি সামনে সিনিয়র ভাই দাড়িয়ে আছে....তার মানে ছেলেদের টয়লেটে ভুল করে গেছি। মনে হয়েছিলো এটা নিয়ে উনারা অনেক হাসাহাসি করবে,কিন্তু ঐ ভাইয়াটা চুপ ছিলো। পরে একটা সময় আমি নিজেই এই কাহিনী সবাইকে বলে বেড়িয়েছি... .. .।
এখন অনুভূতিগুলো কেমন জানি ভোঁতা হয়ে গেছে।কাছের কেউ অনেক কঠিন কোন কথা বললেও কান্না তো দূরের কথা কেমন জানি একটা ভোঁতা অনুভূতি ছাড়া আর কোনরকমই লাগেনা। মনে হয় যার যা ইচ্ছা বলুক।কয়েকদিন আগে আমার এক আত্মীয় ক্যান্সারে মারা গেল। উনাকে আমি ঈদের সময় বাড়ীতে গিয়ে দেখে ও এসেছি তারপর ও মরার খবরটা শুনে খালি মনে হয়েছিলো মানুষটা অনেক কষ্ট পেয়েছে, এখন আর কষ্ট পেতে হবে না।ছোটভাই সেদিন বললো "দি, তোমার কি এখন আর মন খারাপ হয় না,আগের মত কান্নাকাটি করো না যে"। হাসতে হাসতে ওকে বলেছিলাম" মন খরাপ হলে ও কান্না আর আসে না। আর কয়েকদিন পরে দেখবা সিনেমার নায়িকাদের মতন চোখে গ্লিসারিন দিয়ে কাঁদতে হবে"... .. .।