রিকশার প্যাডলে পা ফেলতে ফেলতেই দিন পার হয় রহমত আলী স্যারের আজকাল।৭০ ছুঁই ছুঁই তারপরও এই রিকশার প্যাডল মারাই ক্ষুধা মেটানোর একমাত্র যুৎসই পেশা তাঁর।ভাড়া গুনতে গিয়েই বিপত্তি হলো যত।আমি একজন মু্ক্তিযো্দ্ধাকে চিনতে ভুল করেছিলাম(কারণ-ওনার কোন সার্টিফিকেট নাই,ওনার কোন লবিংও নাই যে ভদ্রলোক সেজে মিডিয়ার সামনে এসে কোন সেমিনার রুমে “মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণ”করবেন)তাই স্যারকে রিকশাওয়ালা ভেবেই জিজ্ঞেস করেছিলাম,রাজাকারদের বিচার এবং গার্মেন্টস কর্মীদের ওপর নিপীড়নের বিষয়টি নিয়ে তিনি কি ভাবছেন।রহমত আলি হাসলেন,ভাবটা এমন তিনি রাজ্যের সব ঘটনা আগে থেকেই জানেন,নির্বাক থাকলেন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে।আমিও ভাড়া মিটিয়ে খামাখাই জ্ঞান বৈরাগ্যের ধার না করে হাটতে উদ্যত হলাম।ভাবছি,দেশের “আমজনতা”রা তো কোনকিছুই বুঝেনা,খামাখাই প্যাচাল পাড়ি সারাদিন,ধ্যাত!হঠাৎই পিছন থেকে রহমত আলীর কণ্ঠ শুনা গেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে গেলেন একে একে সব কথা;কখনো কখনো ৭১’র কথা,কখনো কখনো নিজের ভিটে দখলের কাহিনী।তারপর শুনালেন জোতদারদের সার্টিফিকেট লাভ করে মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার কাহিনী আর রাজাকার কাসেম মিয়ার হঠাৎ ফেরেস্তা বনে যাওয়ার কাহিনী।(এইসব বলার আগ পর্যন্ত রহমত আলি আমার কাছে শুধুই একজন বয়োবৃদ্ধ রিকশাওয়ালাই ছিলেন)
রহমত আলী স্যার যখন এগুলা বলছিলেন,নির্লিতভাবেই বলে গেলেন।আরো কিছু শুনতে চেয়েছিলাম,আবারো প্যাডল মেরে চলে গেলেন নতুন গন্তব্যে।
রহমত আলী স্যার গত ৩৮ বছর রিকশা চালিয়েছেন,বলতে পারেন তিনি পুরোদস্তর রিকশাওয়ালা,এতে তাঁর কোন ক্ষোভ নেই,এই রিকশা চালাতে গিয়ে কখনো কখনো ট্রাফিক পুলিশের চড় খেয়ছেন,কখনোবা উঠতি বয়সের ছেলেপান দাঁড় করিয়ে রেখেছেন হলের সামনে ভাংতি নেই বলে। কোন ক্ষোভ নেই তাতে,কোনকিছুতেই তাঁর কোন রাগ নেই।শহীদ মিনার সামনে দিয়ে রিকশা চালিয়ে গেলেও থেমে যান না কখনো।যে রহমত আলী একটা সবুজের মাঝে লাল টকটকে সূর্য এনে দিয়েছিলেন জীবন বাজি রেখে,আমি তাঁকে চিনি শ্রমজীবী এক মানুষ হিসেবে,তাঁকে আমি সন্মান দেখাইনি তাঁর অবিনাশী কীর্তির জন্যে।সালাম ফ্রিডম ফাইটার,সালাম!আমি তোমার কাছে আজ ক্ষমা চাই সবার হয়ে।
গুরুদাসী মন্ডল,আমার মা,তবে আমার গর্ভধারিণী নন,তারপরও উনি আমার মা।আমার এই মা-কে রাষ্ট্র যন্ত্রের শাসকেরা সুন্দর একটা পদবী দিয়েছেন, “বীরাঙ্গণা”।
পাইকগাছার কোন এক গ্রামে অন্তঃসত্ত্বা মা গুরুদাসী মন্ডলকে ৭১-এ ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে রাজাকার আর পাকিস্তানি হানাদারেরা।মা’র চোখের সামনে নবজাতককেও মেরে ফেলেছে নরপশুরা ।শুধু তাই নয়,একদল মা’র সন্তান এরপর এক মা’র সম্ভ্রমহানি করলো পৈশাচিকতার উল্লাসে,সেই উল্লাসের মাশুল দিচ্ছেন আমার মা গুরুদা মন্ডলী গত ৩৮ বছর,কখনো ক্যাম্পে,কখনো নিষিদ্ধপল্লীতে,সামাজিকভাবে আমি আমার মা’কে স্বীকৃতি দেইনি,কেন দেইনি?
আমার এই মাকে নিয়ে আমি এখন গর্ব করি,লুকিয়ে লুকিয়ে মা’র চোখে স্বপ্ন জাগাই,মা’র চিতায় আমি আগুন ধরাই।সেই মা জীবিত থাকলে হয়তো আমি এই গর্বটুকু করতাম না।
আমি এই মা কে ফ্রিডম ফাইটার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম,কিন্তু ইতিহাসের কোথাও তাঁর নাম পেলাম না,হয়তো ধর্ষিতা মা-কে রাষ্ট্র যন্ত্রও সামাজিক মানহানির ভয়ে অস্বীকার করেছে।
নিজের মাথা হেট হয়ে আসলো,সমগ্র মহাসাগরের জল চোখের অশ্রু হলো আমার,আমার মূল্যবোধ আর লোক দেখানো দেশপ্রেম এখন স্থবির,আমি ফ্রিডম ফাইটারদের সন্মান দেইনি।