বাবাকে নিয়ে ব্লগ, ফেসবুক সবখানে এতো এতো পোস্ট দেখে কান্নায় চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার. বাবা'র জন্য মনটা কেঁদে ভেঙ্গে যাচ্ছে অন্ত:পুর. কিভাবে বলি, বাবার হাজারো স্মৃতির কথা. বাবা হারিয়ে এখন বুঝতে পারছি পৃথিবী কতো নিষ্ঠুর. বাবা এতো আগে কেন চলে গেলো সেই বেদনা ভরা মন নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবি. আজ নানা জনের এতো কথা দেখে আরো বেশি করে শুধু কাঁদতেই ইচ্ছা করছে. বেঁচে থাকতে তার কথার কোন গুরুত্ব তো দেইনি. এড়িয়ে গেছি হাজার বার. বাবা'র কাছ থেকে দূরে পালিয়ে থাকতে চেয়েছি. আর বাবা সব সময় আকড়ে ধরে পাশে রাখার কতো চেষ্টাই না করে গেছে.
মধ্যবিত্তের সংসারে বাবা সারা জীবন দেখেছি শুধু সবাইকে খুশি করাতেই ব্যস্ত ছিলেন. বুঝি নাই তখন, কনে এতো এতো বাহানা নানা ভাবে চাপা দিয়ে রাখতেন. সব সময় তাকে শুধু মন্দ বাবা বলেই ভেবে গেছি. আমার অন্য ভাই বোনদের চোখে বাবা ভালো-মন্দ ছিলো হয়তো. নিজে বাবাকে একজন চেপে যাওয়া মানুষ মনে করতাম. তার চেপে যাওয়ার পেছনে সন্তানদের সুরক্ষার আকুলতা চোখে পড়েনি. যতো বার দেশের বাইরে, হজ্বে গেছেন, বিমানের খাবারটুকু পর্যন্ত না খেয়ে সাথে নিয়ে এসেছে ছেলে-মেয়েদের সাথে শেয়ার করার জন্য. এতো ভালোবাসা উপলদ্ধি করতে পারিনি.
স্কুলে পড়ার সময় বাবাকে দেখেছি শুধু অন্যের জন্য করেই যেতে। নিজে সেই স্কুলটি গড়েছিলেন, আমাদের ভাই বোনদের প্রায় সবাই সেখানেই স্কুলের পড়া শেষ করেছে. কিন্তু এক সময় সততার পুরষ্কারস্বরুপ তার সহকর্মীরাই তাকে সেখান থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করেছে. বাবাকে তখনও বুঝতে পারিনি. সংসারের একমাত্র উপার্জনকারীর জন্য জীবন কতোটা দুর্বিষহ ছিরো সেটা বুঝার মতো জ্ঞান হয়নি, বাবাও তা বুঝতে দেয়নি. মুখ বুজে সহ্য করে গেছে সব.
ব্যবসার জন্য তার বন্ধুদের নিয়ে চেষ্টা করেছেন-প্রতি বারই তার সরলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ঠকিয়েছে তার বন্ধুরা. স্কুল, কলেজে পড়ুয়া আমরা বাবার সেই সব কষ্ট বুঝতে পারিনি, বাবাকেই দোষ দিয়ে গেছি দিনের পর দিন. গ্রামের মধ্যবিত্ত বাবার একমাত্র সন্তান বাবা তেমন কোন সম্পদ করে যেতে পারেননি. চেয়েছেন সব সময় তার ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হোক. দাদার তেমন সম্পত্তিও ছিলো না যা দিয়ে বাবা আমাদের জন্য আরো কিছু কর যাবেন.
পড়ালেখার প্রতি তার আগ্রহ নিয়ে মানুষের টিটকারি তো ছিলোই. ঘরে আমরা ভাই বোনরাও ভাবতাম ছেলে মেয়ে কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে আর বাবা আবার নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে মাস্টার্স করার জন্য. ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের জণ্য চাকরিতে ভালো সুবিধার আশায় তার এই প্রচেষ্টার কথা সেদিন বুঝতে পারিনি.
দেশের বাইরে আসার জন্য বাবা কোন মতেই রাজি ছিলেন না. তারপরও তার চোখের পানি দেখেই বিমানে উঠতে হয়েছে. আজ কাল করে করে বাবা'র সাথে কথা বলারও সময় পেতাম না. আর উপদেশ শোনে কান ভারী হবে ভয়ে বাবাকে ফোন করাও হতো অনেক কম. বাবা এই কষ্ট বুকে চেপে রেখে গেছে দিনের পর দিন. উপলদ্ধি করতে পারিনি - বাবার প্রতি এই অবহেলা তাকে শুধু কাঁদিয়ে বেড়াবে. বাবা'র জন্য কিছুই করতে পারিনি. বাবাকে ভালো করে বলাও হয়নি বাবা, তোমায় অনেক ভালোবাসি.
একটি সরল, সততায় ভরা মানুষের বাইরে প্রচন্ড রাগী রুপ ছিলো. আর অন্তরটা ছিলো কোমল, শান্ত. এগুলো বুঝতে পারিনি. ভয়ে ভয়ে বাবার কথা মেনে চলা এক বাবাবিমুখ সন্তান হিসেবে তাকে দেখেছি. এগুলো সব ভুল ছিল. বাবা'র জন্য ভালোবাসাটুকু প্রকাশ করতে পারিনি. তার চাপা স্বভাবের কারণে আমাদেরকে কষ্টও বুঝতে দিতেন না কখনোই. শাসন করে গেছেন সব সময় শুধু ভালো কাজ করার জন্য. শাসন করার পেছনে তার অকৃত্রিম ভালোবাসাগুলো বুঝতে পারিনি. কারো সাথে মারামারি করার পর ঘরে এলে আবারও মার খেতে হয়েছে আর ক্ষমা চাইতে যেতে হয়েছে. সন্তানকে ভালো করে মানুষ করার ক্ষেত্রে আজীবন এমন শাসন করে গেছেন. শরীরে হাজার রোগ ব্যাধি হলেও কখনো মুখ ফুটে বলেননি বাসায়. মা ও জানতো অধিকাংশ সময়. চেপে যাওয়া নানা রোগ এক সময় হঠাত করেই বেশি প্রকট হয়ে উঠে.
দেশের বাইরে আসার পর বার বার বাবা'র ফোন এসেছে - দেশে কবে আসবি, বিয়ে, সংসার এগুলো নিয়ে তার কথা থাকতো প্রতিবারই. এড়িয়ে যেতাম, উত্তর দিতে পারতাম না অনেক কিছুর. তখনো ভাবিনি বাবা, এতো তাড়াতাড়িই ছেড়ে যাবে. এই হাসপাতাল, সেই হাসপাতাল করে এক সময় এক হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হলো বাবাকে. জীবনের শেষ সময় চলে এসেছে বুঝতে পেরেই তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন. একদিন পর বাড়িতে আসার সময়. এর আগের দিন সকালে ভারাক্রান্ত মনে বাবা'র অকাল প্রয়াণের খবর শুনে শোকে পাথর হয়ে যাই. কিন্তু এর ঘন্টাখানেক সময়ে রওয়ানা দেয়ার পরও বাবাকে শেষ বারের মতো দেখার সৌভাগ্য হয়নি. কবরে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না. আমি বাবার অধম এবং অপদার্থ সন্তান বাবাকে শেষ দেখি তনি বছর আগে বাইরে পড়তে আসার সময়, যখন বিমানবন্দরে শেষ বিদায় জানাই. বাবা আমার অল্প বয়সেই জীবনটাকে আমাদের জন্য কোরবানি করে গেছে. নিজের জন্য কোন কিছু না চেয়ে ছেলে মেয়ের শত আবদারের মাজে কতটুকু দিতে পারবে এই নিয়েই সারা জীবন অংক কষে গেছেন. দিয়ে গেছেন, করে গেছেন.
আজ বাবা নেই, সংসারে শূন্যতা আর বাবা'র ছায়া খুঁজে ফিরি. বাবাকে অবহেলা করে যে পাপ করেছি তা এই জীবনে মাফ পাওয়া সম্ভব নয়. সন্তান হিসেবে বাবার জন্য কোন কিছুই করতে পারিনি. ভুল বুঝে বাবাকে দোষী ভেবে আজীবন ভুল করে গেছি. বাবা আজ অনেক দূরে. তার কাছে ক্ষমা চাইবো বলে হাজার বার পণ করেছিলাম. দেশে এসে বাবাকে বলবো এসব. কপালের দুর্দশার কারণে সেটা তাকে নিজের মুখে বলতে পারিনি, বাবা ক্ষমতা করো আমায়. আমি ভুল ছিলাম. আমার এতো ভুল এখন কে ক্ষমা করবে! মনের ক্ষোভ, দু:খ নিয়ে বাবা আজ চলে গেছে অনেক অনেক দূরে. বাবার কাছে এই পাপী সন্তানের ক্ষমা চাওয়া হলো না আর. চিতকার করে শুধু বলতে ইচ্ছা করে, বাবা আমাকে ক্ষমতা করো, আমাকে ক্ষমা করো, আমাকে ক্ষমা করো. আমি অধম, আমি দোষী, আমাকে ক্ষমা করো বাবা. তুমি যদি শুনতে পেতে বাবা! আমি জানি তুমি শুনছো আমার কথা, ঐ দূরে গিয়ে তুমি আরো ভালো করে দেখছো তোমার সন্তানকে. বাবা আমায় তুমি ক্ষমা করো, ক্ষমা করো.
আজ রিক্ত হস্তে বাবার কাছে আমি শুধু ক্ষমা চাই. মানুষকে দেখিয়ে কাঁদতে পারিনা, মানুষ ভাবে আমি অনেক শক্ত মনের. আড়ালে, বিছানায় শুয়ে দিনের পর দিন হাজারো কান্না আর বুক ভাঙ্গা কষ্ট মানুষ দেখে না. বাবা, সেই কান্না তুমিও যদি দেখতে পেতে এক বার. বাবার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত আমার কেঁদে বুক ভাসানোর. বাবাকে নিয়ে এসব কথা মনে মনে বলে গেছি. আজ বুকে আর চাপা দিয়ে রাখতে পারলাম না. বাবা'র জন্য দুনিয়ার সব ভালোবাসা, শ্রদ্ধাঞ্জলি. আমি শুধু কেঁদেই যাবো, কান্নাই সব আমার. বাবা, তুমি ভালো থাকো.
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৬