ফিনল্যান্ডের গল্প সিরিজ লেখার কয়েক পর্ব শেষে দীর্ঘ বিরতিতে আবার একটু লেখার চেষ্টা করি. দীর্ঘ বিরতির জন্য দু:খিত. হেলসিংকির কিছু অভিজ্ঞতা পরে একবার লেখার চেষ্টা করবো. আপাতত বলি পড়তে আসার পর গন্তব্যস্থল রভানিয়েমি নগরীতে আমার প্রথম দিন.
শীতকাল, আমার বাসার প্রবেশ পথ।
ঘরের বাইরে অন্য কোথাও যাবার পরই আপনি সব জেনে যাবেন এটা আসলে ঠিক না. সব সময়ের জন্য তো নয়ই. ফিনল্যান্ড আসার পর ঠান্ডা আসলে বেশ ভালোই ছিল. শীত শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে. রাজধানী হেলসিংকিতে কয়েকদিন থাকার পর সময় হলো নিজের ঘরে যাবার. আমি যেখানে পড়তে এসেছিলাম সেটা ফিনল্যান্ডের উত্তরের সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়. এটা একইসাথে আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সর্ব উত্তরের বিশ্ববিদ্যালয়ও বটে. আসলে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলা. সে কারণে ভাবলাম দু একদিন আগে গিয়ে একটু জায়গাটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করা খারাপ হবে না. সেই চিন্তা থেকে শুক্রবার রাতের ট্রেনে জিনিসপত্র নিয়ে রওয়ানা দিলাম. এই ট্রেন ছাড়লো প্রায় রাত ১০ টায়. সারা রাত ট্রেনেই থাকতে হবে. সকাল সাড়ে ১০ টায় গন্তব্যে পৌঁছার কথা.
রাতযাপন ট্রেনে. সাধারণ সিট যেগুলা থাকে ঐগুলাতেই সবাই যায়. লোকজনের কথা মতো আমিও সেই টিকিট কাটলাম. ইউনিভার্সিটির ভর্তির কাগজপত্র দেখানোর পরও কোনো ডিসকাউন্ট পাওয়া গেলো না. তার যুক্তি স্টুডেন্ট কার্ড থাকতে হবে. কিন্তু আমি আজই আসলাম, কার্ড এখনো হয় নাই, এগুলা বলে লাভ হয় নাই. যদিও সেই কাগজ দেখিয়েই ডিসকাউন্ট পাওয়ার কথা. কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে টুট টুট করার পরও কোনো লাভ হলো না। প্রায় শ খানেক ইউরো দিয়ে টিকেট করা লাগলো. ছাত্র হলে তার অর্ধেক লাগে. ট্রেনে উঠার আগে কেক জাতীয় কিছু ছিলো, সেটা দিয়ে একবার খাওয়ার কাজ কিছুটা সেরেছি. তবে সত্যি কথা হলো, খাওয়া নিয়ে তেমন বিশেষ কোন চিন্তা ছিলো না. উঠে দফায় দফায় ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ ছিলোনা. পরের দিন সকালে পৗেঁছানোর আগে দুই তিন রাতের ঘুম এক সাথে ঘুমানো যাবে. সে কারণে ঘুমে মন দিলাম.
কিন্তু চাইলেই যদি সব পাওয়া যেতো তাহলে তো হতোই. আমার অবস্থাও হলো কেরোসিন. সোজা লম্বা সিট একটু পেছনে নামিয়ে,আবার উঠিয়ে, আবার নামিয়ে এভাবে করতে করতে সারা রাতই গেলো. এদিক ওদিক কাত হওয়া তো ছিলই. তাও ভালো শেষ রাতের দিকে ঘুম চাপলো কিছুটা. সকাল হবার আগেই ঘুম থেকে উঠছিলাম. তাই জেগে উঠা নিয়ে সমস্যা হয় নাই্.
আগে ভাবছিলাম, যে এতো দূরে যাবো, রাস্তার দু ধারে দেখতে দেখতে গেলে খারাপ হয় না. কিন্তু কিসের কি! তখন ফিনল্যান্ডে শীত সবে শুরু হয়েছে. আর শীত শুরু হওয়া মানে হলো শীতলতার সাথে সাতে দিনের আলোও শীতল হয়ে যায়. অর্থা্ত আলোর তেজ কমে অন্ধকার গ্রাস করে. আর যেখানে আমার সেখানে তো অবস্থা আরো খারাপ.
আমার টিউটর (নতুন ভর্তি হবার পর সব ছাত্রছাত্রীর জন্যই একজন সিনিয়র শিক্ষার্থী টিউটর হিসাবে দেয়া হয়, নতুনদের প্রথম দিকে বিভিন্ন বিষয়ে গাইড করার জন্য ) রওয়ানা দেয়ার আগেই আমাকে জানালো যে, আমি শনিবার যে সময় আসতেছি সেটাই ভালো সময়. কারণ ট্রেন যখন পৗেঁছাবে , তখন সূর্যোদয় হবে. তাই এসেই অন্ধকারে পড়তে হবে না. তার কথা আসলে ঠিকই ছিলো. কারণ এসে কিছুদিনের মধ্যে হাড়ে হাড়ে টের পাই যে, সূর্যের আলো বিহীন থাকা আসলে কি রকম! কারণ এর কয়েক দিন পর থেকে আলো আরো কমে গেলো. এক সময় ডিসেম্বরে এসে ঘন্টা দুয়েকের সূর্যের আলো আর বাকি পুরো সময় রাত, অন্ধকার. কি করবো, চিনি না রাস্তা ঘাট ভালো করে . আবার চারদিক বরফে ঢাকা, তুষার দিনে রাতে সব সময়ই পড়ে.
আমার ঘরের জানালা দিয়ে কয়েক ঘন্টার সূর্যের আলো. ছবি ঘরের ভিতর থেকেই তোলা. বাইরে যে অবস্থা তাতে নিজে বরফ হওয়া ছাড়া গতি নাই!
বাসা থেকে বরফ ঠেলে ঠুলে প্রতিদিন ক্লাস যাওয়া লাগে ক্লাস করতে. প্রতিদিন ক্লাস না থাকলেও যেতাম কারণ বাসা থেকে দুরত্ব ছিলো ৩০০ মিটারের মতো. সে কারণে ভালোই ছিলো. কিন্তু গায়ে কয়েকটা গরম কাপড় চড়ায়ে, বুট জুতা পড়া-এসব করতে করতেই লাগতো আধ ঘন্টা. এরপর ৫ মিনিটের রাস্তা তুষারঢাকা বরফ ঘেরার কারণে লাগতো ১৫ মিনিট. তারপরও কি আর করা. বাইরে মানুষজন দেখতে পেতাম না তেমন. ইউনিভার্সিটিতে গেলে তাও কিছু মানুষ পাওয়া যেতাে.
আক্কেল সেলামী
আসার দিন টিউটর মাত্তুসের কথা অনুযায়ী রভানিয়েমি রেলস্টেশনে এসে পৌঁছার পর দেখলাম আসলেই রোদেলা আবহাওয়া. যাক ভালোই হলো. আমি এদিক ওদিক করে মাত্তুসকে খুঁজতেছি, কিন্তু তার দেখা পেলাম না. ইমেইলে একটা ছবি এটাচ করে দিয়েছিলো, সে অনুযায়ী লোকজন দেখে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম. না পেয়ে ভাবলাম, বসে থাকি. মাত্র তো পৗেঁছলাম, কিছুক্ষণ দেখা যাক. আর তার যেহেতু আসার কথা, সে কারণে অধৈর্য হবার কারণও নেই. আরো বড় কারণ হলো, সব লোকজনই ভিতরে অপেক্ষা করছে. কারণ বাইরে ঠান্ডা.আমিও দেখলাম তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৪ এর মতো, কিন্তু বাইরে রোদেলা আবহাওয়া.
যাই হোক, কিছুক্ষণ পর মাত্তুস এলো জ্যাকেট, টুপি, গ্লাভস সব লাগিয়ে, পুরাই রেডি. আমি গাট্রি বোচকা একটা ওর হাতে দিলাম, একটা আমি নিলাম. হাত মোজা, টুপি ব্যাগের ওপরের দিকে রেখেছিলাম যাতে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়, যদি ঠান্ডা লাগে. কিন্তু যা চাই তা সেভাবে কি আর হয়! জিনিসপত্র এটা ওটা করতে করতে সেগুলা কিছুটা নিচেই পড়ে গেলো. আর বাইরে রোদ দেখে ভাবলাম দেখি, পরে লাগলে বের করবো. মাত্তুস বললো ট্যাক্সি নিবো নাকি হাটবো, সে বললো হাঁটলে হাঁটা যায়. আমি ভাবলাম হাঁটল্ই ভালো যখন হাঁটি. আমার হাঁটতে ভালোই লাগে. মাত্তুস বললো বেশি সময় লাগবে না, সো ঝামেলা নাই. সায় দিয়ে হাটা শুরু করলাম. কিন্তু সমস্যা হলো কয়েক মিনিট পর হতেই ঠান্ডা লাগা শুরু হলো, আর আস্তে আস্তে সেটা বাড়তেই থাকলো. একবার থেমে ব্যাগ থেকে গ্লাভস আর টুপি বের করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঠান্ডায় খুঁজতেও সমস্যা হচ্ছিল, আবার দাড়িয়ে না থেকে হাঁটলে পথও আগাবে এই করে করে হলো না.
মাত্তুস একটু পর পর বলে এই তো সামনে, কিন্তু বাস্তবে সামনে আর শেষ হয় না, মূল সমস্যা হলো আমার যে ঠান্ডায় অবস্থা কাহিল সেটা ওরে ভালো করে বলতেও পারছিনা. আগে যেহেতু নিজেই বলছি, হাঁটল্ই ভালো আর সমস্যা নাই. এখন যদি আমার ভেবে বসে এটুকুই হাঁটতেই এ অবস্থা! আর সে নিজে বলছেও যে রাস্তা খুব সামনেই, বেশি দূর নাই. তো এই করতে করতে কাছাকাছি আসলাম. কোথাও যে ঢুকে একটু জিরিয়ে নেবো সেই উপায় নেই. কারণ এমন কোন জায়গা নেই বাসায় যাবার আগ পর্যন্ত। তারপরও ভাগ্য ভালো, আমি যখন পুরোপুরি কাত হয়ে পরার অবস্থা তখন দোকান চোখে পড়লো. বাসার সবচেয়ে কাছের দোকান এটাই ছিলো. দোকানে মাত্তুসকে নিয়ে ঢুকলাম. কিছুক্ষণের জন্য জানে পানি পেলাম. চাল, ডিম, তেল, রুটি, একটা টুথপেস্ট এসব কিনে আবার যা্ত্রা. এবার মাত্তুস বললো রাস্তার মাথায়ই আমার বাসা. যাই হোক, কিছুটা খুশি হলাম. কিন্তু খুশি আর সইলো না. সে আমারে আরেক দিক দিয়ে ঘুরায়ে নিয়া আসলো, বললো ঐদিকের রাস্তায় গেলে তোমার বাসার লোকেশনটা ভালো করে কনফার্ম হতে পারবো. আমি কি আর বলবো, না বুঝে হু করে গেলাম, আর হাঁটা তো চললোই- এদিকে আমার অবস্থা খারাপ. বরফ ঢাকা পথ ব্যাগ নিয়ে এতোক্ষণ ধরে শীতের মাইনাস ৪ এর মধ্যে হাঁটার অভিজ্ঞতা বুঝতে বুঝতে আমি অচেতন হবার অবস্থা. দোকান থেকে বের হয়ে আরো ১৫ মিনিট পর বাসার গেট পাওয়া গেলো. শান্তি পেলাম মনে মনে.
মাত্তুস চাবি আগেই নিয়ে আসছিলো অফিস থেকে. সে দরজা খুলে মালপত্র ভিতরে দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, কবে আবার দেখা হবে বা আর কি কি লাগবে এসব কিছু. আর এদিকে আমার অবস্থা খারাপ. অচেতন হবার অবস্থা. ওরে বললাম, আমি তোমারে ফোন করবো. বললো কাল, পরশু! আমি আবারো বললাম আমি ফোনে তােমারে জানাইতেছি. এর মাঝে বেচারা বোধোদয় হলো, বললো ঠিক আছে, আমি তাহলে যাই. ওর যাই বলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে আমিও গেলাম. ভাবছেন কই গেলাম! দরজা বন্ধ করার পর যেভাবে ছিলাম সেভাবেই ফ্লোরে অচেতন হয়ে পড়ে রইলাম. কিছুক্ষণ কি হইছে কিছুই বুঝি নাই, কয়েক মিনিট পর একটু স্বাভাবিক হলাম. পরে আস্তে আস্তে তাপমাত্রার সাথে এডজাস্ট হবার পর শরীরে জোর পাওয়া গেলো. বাইরে যতো মাইনাসই হোক, ঘরের তাপমাত্রা ২১ এর মতো. খামখেয়ালি করে লাভস, টুপি না লাগানোর কারণে আক্কেল সেলামী পেতেই হলো! ঠান্ডা হয়তো তারপরও ঐরকমই লাগতো, কিন্তু ওভাবে অচেতন হয়ে জ্ঞান হারানাের মতো অবস্থা হতো না! কি আর করা, এভাবে ধরা খেতে খেতে চলতেই হবে! বিদেশ বিভূই বলে কথা!
(চলবে..)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১৬ রাত ৩:০৪